সে দিনের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি।
পায়ের নীচে মাটি নড়ে ওঠার সেই অনুভূতি এখনও তাড়া করে রাতে। বিশেষ করে বড়দিনের সময়টায়। দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না। ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। শুয়ে শুয়ে মনে হয়, এই বুঝি ফের দুলে উঠবে চারপাশ। শুরু হবে মহাপ্রলয়।
বারো বছর আগের বড়দিন শনিবার ছিল। কার নিকোবর জুড়ে উৎসবের মেজাজ। পরের দিন, রবিবার বেলা করে উঠব ভেবেছিলাম। তবু ভোরেই চা খেতে ডাকলেন রাঁধুনি মনিরুল। ভাগ্যিস! নইলে আজ এত দিন বাদে স্মৃতি হাতড়ানোর সুযোগ পেতাম না। চা খেতে-খেতেই হঠাৎ দুলে উঠল মাটিটা। সে কী দুলুনি! যেন গোটা দ্বীপটাই সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। আর কিছুর ভাবার জো ছিল না। পড়িমড়ি ছুটেছিলাম জঙ্গলের দিকে। পিছু ফিরে দেখছি, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে আমার বারো বছরের আস্তানা, অফিস কোয়ার্টার, মনিরুলের কাঠের ঘর, রান্নাঘর। আমার রুমমেট রশি-র কথাও মনে পড়ছিল। ও তো তখনও ঘরে সুখনিদ্রায়। এক মুহূর্ত চেঁচিয়ে ডাকার সুযোগও পাইনি। সেই যন্ত্রণা আমায় কুরে কুরে খায়।
ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম জঙ্গলের গভীরে। সেখানে তখন চারধারে গাছেদের মৃতদেহ। স্থানীয় আদিম জনজাতির একটা দলের সঙ্গে ওখানেই পড়ে রইলাম। তিন দিন, তিন রাত। কিছু প্রায় দাঁতে কাটিনি। মাঝেমধ্যে মাটিতে ভেঙে পড়া ডাব ফাটিয়ে গলা ভেজানো। ব্যস! মনে হচ্ছিল সভ্য জগতে ফেরাই হবে না।
তখনও মাঝেমধ্যেই মাটি কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে, এ ভাবেই সব কিছু শেষ হবে। কাহিল শরীর প্রায় জবাব দিয়ে দিয়েছিল। মন শক্ত করে তবু একটা শেষ চেষ্টা। ভাবলাম, এক বার এয়ারপোর্টে যাই! পা দু’টো যেন কয়েকশো কিলোগ্রাম ওজনের ভারী মনে হচ্ছে তখন। শরীরটা টেনে নিয়ে কোনওমতে পৌঁছলাম। দেখলাম বিমানবন্দরে আরও কিছু লোক এসেছেন। তাঁদের মধ্যে সহকর্মী ফারুকও ছিলেন। ওঁর কাছেই খবর পেলাম, আর কেউ বেঁচে নেই। এমনকী, আমাকে ঘুম থেকে তুলে চা খাওয়াতে ডাকা মনিরুলও কাঠের বাড়ি চাপা পড়ে শেষ! বিমানবন্দরেই জানতে পারলাম, রিখটার স্কেলে ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। সেই প্রথম শুনলাম আরও একটা শব্দ, সুনামি!
কার নিকোবর বিমানবন্দরে গোটা একটা দিন পড়ে ছিলাম। ভূমিকম্পে রানওয়েতেও ফাটল। ছোট ছোট ফৌজি প্লেন ছাড়া কিছু নামতে পারছে না। তাতেই নিয়ে গেল চেন্নাই। শরীরে জল নেই। তাই সোজা হাসপাতাল। আর কিছু মনে নেই। আরও দু’টো দিন বাদে, যেন হুঁশ ফিরল। তার পর বাড়িতে ফোন। দিনটা মনে আছে, ৩ জানুয়ারি, ২০০৫। আমার গলা শুনে কলকাতায় মা-বাবা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। ওরা ভেবেছিল, আমাকেও সুনামি গিলে নিয়েছে। বাড়ি ফিরলাম আরও চার দিন পর। শুধু জামাকাপড় সম্বল। পয়সাকড়ি, ঘরগেরস্থালি, বন্ধু— সব কার নিকোবরের ধ্বংসস্তূপের তলায়।
কলকাতায় ফিরেও চট করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারিনি! পাখা চললে বা একটু জোরে হাওয়া দিলেই মনে হতো প্রলয় আসছে। রাতের পর রাত জাগা। ডাক্তারবাবুর কথা শুনে ঘুমের ওষুধ খাওয়া ধরলাম। ১৯৯২ সালে শিপিং ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজার হিসেবে পাড়ি দিয়েছিলাম আন্দামান-নিকোবর। কিন্তু ফিরে এসে আর জাহাজের চাকরি করতে সাহসে কুলোলো না। কিন্তু পেট চালাবো কী করে! ৩২ বছর বয়সে নতুন করে ফিজিওথেরাপি শিখলাম। এখনও সেটাই করে যাচ্ছি।
বাবা-মা মারা গিয়েছেন। বোনেদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভবানীপুরের বাড়িটায় একাই থাকি। এখনও সমুদ্রে বেড়ানোর কথা ভাবলে শরীরটা কেমন করে। কিছু দিন আগে বন্ধুরা জোর করে দিঘায় নিয়ে গেল। বিশ্বাস করুন, স্নান করা তো দূর, জলে পা ছোঁয়াতেও পারিনি। আর কার নিকোবর? সেখানে যাওয়ার সাহস বোধহয় এ জীবনে হবে না।
এক যুগ আগের আতঙ্ক এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy