E-Paper

‘দাদা কি আর...’, হাত চেপে ধরে বললেন বিশ্বাস

দীর্ঘ অপেক্ষার পরে এ দিন সকালে খানিকটা ঘুরপথে, এক ফাঁকে ঢুকে পড়া গিয়েছিল সিভিল হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার ইউনিটে, বিশ্বাসের শয্যার কাছে। বেগুনি রঙা বালিশে গা এলিয়ে বসে রয়েছেন তিনি, ভেঙে পড়া এআই ১৭১ বিমানের ১১-এ আসনের যাত্রী।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২৫ ০৮:৪৩
হাসপাতালে হুইলচেয়ারে বিশ্বাসকুমার রমেশ।

হাসপাতালে হুইলচেয়ারে বিশ্বাসকুমার রমেশ। ছবি: নীলোৎপল বিশ্বাস।

বাঁ দিকেই আঘাতের চিহ্ন বেশি। বাঁ চোখের উপরের অংশ এখনও ফুলে রয়েছে। তার নীচেই গালে গভীর ক্ষত। বাঁ হাতে মোটা করে ব্যান্ডেজ। ক্ষত রয়েছে ডান হাতের কব্জিতেও। আপাত ভাবে এর বাইরে তেমন কোনও সমস্যা নজরে আসছে না। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত খুঁড়িয়ে চললেও, শুক্রবার সকাল থেকে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটাচলা করতে পারছেন। চিকেন স্টু চেয়ে খেয়েছেন। গান শুনতে চান বলেও ডাক্তারদের জানিয়েছেন। বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে ফেরা এক মাত্র যাত্রী বিশ্বাসকুমার রমেশ এ দিন বললেন, ‘‘বিমানটা আমার আসন বরাবর দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। উড়ান শুরু করতেই সিটবেল্ট খুলে দিয়েছিলাম। তাতেই কী ভাবে যেন হড়কে বাইরে গিয়ে পড়লাম। এর পরেই বিস্ফোরণ!’’

দীর্ঘ অপেক্ষার পরে এ দিন সকালে খানিকটা ঘুরপথে, এক ফাঁকে ঢুকে পড়া গিয়েছিল সিভিল হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার ইউনিটে, বিশ্বাসের শয্যার কাছে। বেগুনি রঙা বালিশে গা এলিয়ে বসে রয়েছেন তিনি, ভেঙে পড়া এআই ১৭১ বিমানের ১১-এ আসনের যাত্রী। পরিচয় দিতেই উঠে বসে বললেন, “সবাই জানতে চাইছে, কী ভাবে বেঁচে গিয়েছি! কিন্তু এর উত্তর আমার কাছেও নেই। যত দিন বেঁচে থাকব, হয়তো এই উত্তরটাই দিয়ে যেতে হবে।” এর পর তিনি বলেন, “বিমানে ওঠার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সিট বেল্ট খুলে ফেলেছিলাম বসতে সমস্যা হচ্ছে বলে। আপৎকালীন দরজার কাছে ছিল আমার আসন। এর পর কী হল বুঝলাম না, উপরে ওঠার বদলে বিমানটা নীচের দিকে নামতে শুরু করল। জানলা দিয়ে দেখি, বাড়িগুলো যেন কাছে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ জোর ঝাঁকুনি খেতে খেতে একটা বিরাট ধাক্কা। দেখলাম, আমার পায়ের কাছ থেকে ফাটল ধরার মতো করে দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে বিমানটা। আর কিছু বুঝে উঠতে পারিনি, কী ভাবে যেন হড়কে একটা চাতালের মতো জায়গায় গিয়ে পড়লাম। এর পরেই জোর বিস্ফোরণ!”

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। চোখ বুজে রইলেন বিশ্বাস। তার পরে ধীরে ধীরে বললেন, “এখন মনে পড়ছে, কানে তালা লাগা অবস্থায় হতভম্বের মতো বসেছিলাম কিছু ক্ষণ। কয়েক জন এসে আমায় টেনে নিয়ে গেল। কখন যে হেঁটে রাস্তায় গিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠেছি, বুঝিনি।”

আমদাবাদের সরকারি সিভিল হাসপাতালে আনা হয়েছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক বিশ্বাসকে। গোটা হাসপাতাল জুড়ে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসছেন বলে কার্যত দুর্গে পরিণত করা হয়েছে গোটা জায়গাটা। ট্রমা কেয়ার বিভাগের চারতলায় সি-সেভেন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ড্রিমলাইনার বিমানের একমাত্র জীবিত যাত্রী। কিন্তু সেই পর্যন্ত ওঠার সমস্ত রাস্তা ছিল বন্ধ। কড়া পুলিশি প্রহরার পাশাপাশি কলাপসিবল গেট বরাবর সবুজ কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে দৃষ্টিপথও। প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে যেতে কোনওমতে, ঘুরপথে ঢুকে চারতলায় পৌঁছে দেখা গেল, সেখানেও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সি-সেভেনের পাশাপাশি সেখানকার সি-এইট এবং জি-এইট ওয়ার্ডেও রয়েছেন জখমরা। বিমান ভেঙে পড়ার সময়ে তাঁরা সেই এলাকার আশপাশে ছিলেন। তবে সি-সেভেন ওয়ার্ডের মতো কড়া পাহারা নেই সেখানে। উর্দিধারীদের পাশাপাশি টি-শার্ট পরে পাহারা দিচ্ছেন গুজরাত পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মীরাও।

বিশ্বাসের সঙ্গে কয়েক মিনিটের কথা শেষ হওয়ার মধ্যেই ঢুকে এসেছেন চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীদের দল। পরীক্ষা করাতে নিয়ে যেতে হবে বিশ্বাসকে। তাই এসেছে হুইলচেয়ারও। হেঁটেই যেতে চাইলেন তিনি। কিন্তু মাথায় ক্যাপ, মাস্ক পরিয়ে তাঁকে বসানো হলো হুইলচেয়ারে। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বিশ্বাস বললেন, “আট মাস এ দেশে কাটিয়ে দাদার সঙ্গে ব্রিটেনে ফিরছিলাম।” এর মধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে বিশ্বাসের দাদা অজয়কুমার রমেশের নাম। কিন্তু এ দিনও তাঁকে চিহ্নিত করা যায়নি বলে খবর। ঘর ছেড়ে বেরোনোর আগে বিশ্বাস টেনে ধরলেন অপরিচিত এই সাংবাদিকের হাত, “দাদাকে ছাড়া ফিরতে পারব না, দাদা কি আর...!”

কথা শেষ হয় না। হুইলচেয়ার ঠেলে তাঁকে নিয়ে ডাক্তাররা বেরিয়ে যান। বেঁচে ফেরার আনন্দ নয়, ঘর জুড়ে ছড়িয়ে থাকে অপার বিষণ্ণতা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ahmedabad Plane Crash plane accident

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy