E-Paper

শেষ বার আলো জ্বলাই কি শেষের ইঙ্গিত

সাধারণত বিমানের ইঞ্জিনের মধ্যে থাকা টার্বাইনের সঙ্গে যুক্ত জেনারেটর উড়ানের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে। কোনও কারণে ওই ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, বিমানের বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা সচল রাখতে বিদ্যুৎ আসে ব্যাটারি যুক্ত অকজ়িলিয়ারি পাওয়ার ইউনিট বা এপিইউ থেকে।

ফিরোজ ইসলাম 

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৫ ০৭:৩১
বিমান ভেঙে পড়ার কয়েক সেকেন্ড আগে একটি বাড়ির ছাদ থেকে তোলা দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ছবি।

বিমান ভেঙে পড়ার কয়েক সেকেন্ড আগে একটি বাড়ির ছাদ থেকে তোলা দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ছবি। —ফাইল চিত্র।

দুর্ঘটনাগ্রস্ত এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানের একমাত্র জীবিত যাত্রী বিশ্বাসকুমার রমেশ জানিয়েছিলেন, তিনি বিমান থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে আচমকা বিমানের মধ্যেকার আলো জ্বলে ওঠে। তার পরই বিপুল বিস্ফোরণে আগুন আর ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারপাশ। বিমান ভেঙে পড়ার কয়েক সেকেন্ড আগে একটি বাড়ির ছাদ থেকে তোলা দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ভিডিয়োয় যে শব্দ ধরা পড়েছে, তা ড্রিমলাইনার বিমানের জেট ইঞ্জিনের মতো নয় বলে দাবি করছিলেন বিমান বিশেষজ্ঞদের একাংশ। অনেকেই জানিয়েছিলেন, ওই শব্দ অনেকটা এটিআর প্রজাতির বিমান বা প্রপেলার যুক্ত বিমানের ডানার শব্দের মতো। ওই দুই ঘটনা থেকে আমেরিকান নৌবাহিনীর বিমানচালক এবং বিমান বিশেষজ্ঞ স্টিভ শেনবার মনে করছেন, ওই দিন এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কোনও কারণে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিল। বিমানের দু’টি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ার ঘটনাকেই তার জন্য দায়ী করছেন তিনি।

সাধারণত বিমানের ইঞ্জিনের মধ্যে থাকা টার্বাইনের সঙ্গে যুক্ত জেনারেটর উড়ানের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে। কোনও কারণে ওই ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, বিমানের বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা সচল রাখতে বিদ্যুৎ আসে ব্যাটারি যুক্ত অকজ়িলিয়ারি পাওয়ার ইউনিট বা এপিইউ থেকে। ওই ব্যবস্থাও ঠিক মতো কাজ না করলে, সেই সময় বিমানের ডান দিকে পেটের নীচে দু’টি ব্লেড যুক্ত একটি টার্বাইন আপনা থেকে খুলে যায়। বাইরের বাতাসের চাপে ওই টার্বাইন ঘুরতে শুরু করে। র‌্যাম এয়ার টার্বাইন নামে পরিচিত ওই যন্ত্রের শব্দ অনেকটা প্রপেলার যুক্ত বিমানের মতো। ওই শব্দ থেকে মনে করা হচ্ছে, বিমানের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা কাজ না করায় ল্যান্ডিং গিয়ার-সহ অন্যান্য যন্ত্র কাজ করেনি। ওই অবস্থায় বিদ্যুতের জোগান দেওয়ার জন্য ওই যন্ত্র আপনা থেকেই চালু হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওই টার্বাইন থেকে পাওয়া বিদ্যুতে বিমান আলোকিত হলেও তার মধ্যেই উপরে ওঠার ক্ষমতা হারিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে বিমানটি।

বিমান বিশেষজ্ঞ স্টিভের দাবি, সম্ভবত কোনও কারণে বিমানের দু’টি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে গিয়েছিল। দুর্ঘটনার পিছনে ডানার ফ্ল্যাপ ঠিক জায়গায় না থাকার তত্ত্ব থেকে কিছুটা সরে এসে তিনি ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পাশাপাশি বিমানের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ঠিক মতো কাজ না-করাকেই বিপত্তির মূল কারণ বলে জানাচ্ছেন।

যদিও বিমানচালকদের বড় অংশ জানাচ্ছেন, ড্রিম লাইনারের দু’টি ইঞ্জিন একসঙ্গে বসে যাওয়ার ঘটনা নেহাৎই বিরল। ওই উড়ানের ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা প্রশ্নাতীত, বলছেন তাঁরা। ওই বিমানের ইঞ্জিনের বাতাস টেনে পিছনে পাঠানোর অনুপাত ১০:১ বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। অর্থাৎ, ইঞ্জিনের প্রপেলার বা ফ্যান ব্লেড যতটা বাতাস ভিতরে টেনে আনে, তার মাত্র এক ভাগ ইঞ্জিনে প্রবেশ করে না। ফলে, কর্মক্ষতার নিরিখে জিই এরোস্পেসের জেনএক্স ইঞ্জিন খুবই দক্ষ বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। যাকে প্রায় ‘নো ব্লিড’ ইঞ্জিন বলা হয়।

সংশ্লিষ্টমহলের একাংশের কথায়, দুর্ঘটনার দিন বিমান রানওয়ে থেকে ওড়ার সময় একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। প্রাক্তন এবং বর্তমান বিমানচালকদের কথায়, উড়ানের সময়ে একটি ইঞ্জিনের সাময়িক বিকল হয়ে যাওয়াটা বিরল নয়। কোনও কারণে সমস্যা দেখা দিলে, ওই ইঞ্জিন দ্রুত বন্ধ করে পাশের ইঞ্জিনের উপর ভরসা করাই নিয়ম। এ ক্ষেত্রে মাটি ছেড়ে ওঠার মুহূর্তে একটি ইঞ্জিন আচমকা বিকল হয়ে যাওয়ার পরে চালকরা ওই ইঞ্জিন বন্ধ করার পরিবর্তে ভুল করে বিমানের চালু ইঞ্জিনটি বন্ধ করে ফেলেছিলেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।

বিমানের উচ্চতা কম থাকার পাশাপাশি ওই সময়ের মধ্যে ল্যান্ডিং গিয়ার বন্ধ করতে না পারার ফলে বিমানের নিম্নমুখী টান অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকা স্বত্ত্বেও মোক্ষম সময়ে বিমানচালকদের এমন ভুল প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ালো কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।

টেক অফের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা না হলেও, যখন বিমানের গতি বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, তখন অন্য কোনও যান্ত্রিক সমস্যার মুখে পড়েই কি দ্রুত কর্তব্য স্থির করতে ভুল করেছিলেন তাঁরা? বিমানচালকদের প্রশিক্ষণ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানোর উপযোগী করে দেওয়া হলেও, মানুষের ভুলের সম্ভাবনা এড়ানো যাচ্ছে না, বলছে সংশ্লিষ্টমহল। তাঁদের দাবি, এ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়টা এতটাই কম ছিল যে, চালকদের হাত থেকে কোনও ভুল হয়ে থাকলে, তা সম্ভবত শোধরানোর সুযোগ মেলেনি। বরং যান্ত্রিক সমস্যার সঙ্গে ভুল জুড়ে গিয়ে হয়তো পরিণতি এতটা মর্মান্তিক করে তুলেছে।

বিমান ঠিক মতো কিছুটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারলে আনুষঙ্গিক সমস্যা সামলানোর সময় পাওয়া যায়। টেক অফের ক্ষেত্রে মাটি থেকে ১ হাজার ফুটের মধ্যে যে কোনও উচ্চতাকে বিপজ্জনক বলছেন সংশ্লিষ্ট বিমানচালকেরা। ওই উচ্চতায় কোনও সমস্যা হলে ‘এয়ার বোর্ন’ হয়ে যাওয়া বিমানকে রানওয়েতে ফের ঘুরিয়ে ফেরত আনা খুব কঠিন। তুলনায় উচ্চতা বেশি হলে সমস্যা সামলানোর জন্য সময় পাওয়া যায়। আমদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মাটি থেকে উচ্চতা ছিল সাড়ে চারশো ফুটের কম। তাই বিপত্তি সামলানোর সময় চালকরা পাননি বলে মনে করা হচ্ছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ahmedabad Plane Crash Air India Plane Accident

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy