Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ব্যপম অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে লাশ মিলল ঝিলের জলে

বিরোধীদের প্রবল সমালোচনা এবং দলের অন্দরে বিরোধের মধ্যেই সোমবার শিবরাজ সিংহ চৌহানের পাশে দাঁড়ালেন রাজনাথ সিংহ। ব্যপম কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি সরাসরি খারিজ করে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু এতেও দুঃখ যাচ্ছে না বিজেপির।

শিবরাজের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অরুণ যাদবের। ভোপালে। ছবি: পিটিআই।

শিবরাজের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অরুণ যাদবের। ভোপালে। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪৪
Share: Save:

বিরোধীদের প্রবল সমালোচনা এবং দলের অন্দরে বিরোধের মধ্যেই সোমবার শিবরাজ সিংহ চৌহানের পাশে দাঁড়ালেন রাজনাথ সিংহ। ব্যপম কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি সরাসরি খারিজ করে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু এতেও দুঃখ যাচ্ছে না বিজেপির। সোমবারই এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে গেল আরও এক রহস্য মৃত্যু, গত ৪৮ ঘণ্টায় তৃতীয়। আর এই মৃত্যু-মিছিলেন মধ্যেই কংগ্রেস দশ প্রশ্ন রাখল মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সামনে। যার শেষ কথা, তদন্তের আওতা থেকে শিবরাজকে বাদ রাখা হবে কেন?

ব্যপম-দুর্নীতির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে শনিবার রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছিল টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক অক্ষয় সিংহের। পরের দিন, অর্থাৎ রবিবার দিল্লির এক হোটেল থেকে মেলে ব্যপম-কাণ্ডে ভুয়ো-পরীক্ষার্থীদের নিয়ে তদন্তে নামা জবলপুর মেডিক্যাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মার দেহ। তার পরে আজ, সোমবার কাকভোরে ফের মিলল লাশ! পুলিশের শিক্ষানবিশ সাব-ইন্সপেক্টর অনামিকা সিকারওয়ার দেহ পাওয়া গেল মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলার একটি ঝিল থেকে। অনামিকা এই কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত নন ঠিকই। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে তিনি চাকরিটি পেয়েছিলেন ব্যপমের পরীক্ষার মাধ্যমে!

ব্যপমে মৃত্যু মিছিল চলছিলই। কখনও অভিযুক্ত, কখনও সাক্ষী, কখনও বা রাজসাক্ষী। এক, দুই করে সংখ্যাটা গত চার বছরে সরকারি হিসেবেই পৌঁছে গিয়েছিল ২৪-এ। বেসরকারি হিসেবে ৪৬! পরপর তিন দিনে তিন মৃত্যুর ধাক্কায় জব্বর চাপে পড়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। বিপাকে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। ক’দিন আগেই নিজের সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, তাঁর সরকার দুর্নীতি-মুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন কায়েম করতে পেরেছে। কিন্তু তার পর থেকে গত এক মাসে প্রথমে ললিত মোদী-কাণ্ডে সুষমা স্বরাজ-বসুন্ধরা রাজে, স্মৃতি ইরানির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক, ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের বিরুদ্ধে ছত্রিশ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এবং সর্বোপরি মধ্যপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারি সেই দাবির ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে বলে মানছেন বিজেপিরই একটা অংশ।

এই সংক্রান্ত আরও খবর...

স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে শিবরাজের ইস্তফা চেয়ে আজ আরও সুর চড়িয়েছে কংগ্রেস। সেই সঙ্গে তাদের দাবি, শিবরাজের তত্ত্বাবধানেই তিন বছর ছিল মধ্যপ্রদেশের চিকিৎসা-শিক্ষা দফতর। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধেই বা তদন্ত হবে না কেন? বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব, তাঁর স্ত্রী সাধনা সিংহ-সহ একাধিক ঘনিষ্ঠের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্তও দাবি করেছে কংগ্রেস।

বিজেপি অবশ্য তাদের নিজস্ব কায়দাতেই চলছে। অর্থাৎ বসুন্ধরা বা সুষমার প্রতিরক্ষায় তারা গোড়া থেকে যে কৌশল নিয়েছিল, শিবরাজের জন্যও সেই পথ। বিরোধীদের মুখের উপরেই বন্ধ করে দিয়েছে সিবিআই তদন্তের দাবির দরজা। সঙ্ঘ ও বিজেপি নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত, এ ব্যাপারে বিরোধীদের দাবির সামনে মাথা নোয়ানো হবে না। তার মধ্যেই আজ সাংবাদিক অক্ষয় সিংহের দেহের ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে বিজেপিকে। অক্ষয়ের দেহ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিজেপি-শাসিত গুজরাতে। সোমবার রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, ময়না-তদন্তে অক্ষয়ের দেহের ভিতরে বা বাইরে কোনও আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তবে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে চিকিৎসকেরা মুখ খোলেননি। এই পরিস্থিতিতে আজ মহিলা সাব-ইন্সপেক্টরের মৃত্যুর ঘটনাটিকে ঢাল করেন শিবরাজ। বলেন, ‘‘সব মৃত্যুই ব্যপমের সঙ্গে মেলানো ছেলেমানুষি হচ্ছে। ওই মহিলা পারিবারিক বিবাদের জেরে আত্মহত্যা করেছেন।’’ আবার আজই দলের এক সাংসদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে ভোপাল গিয়েছিলেন রাজনাথ। সেই সাক্ষাতের পরে তিনি বলেন, ‘‘হাইকোর্টই সিবিআই তদন্তের দাবি খারিজ করে দিয়েছে। এখন কী ভাবে সরকার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়! এটুকু বলতে পারি, আদালত নির্দেশ দিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে একটুও দেরি করব না।’’

প্রশ্ন হল, আদালত সেই নির্দেশ দেবে কি? ব্যপম কাণ্ডে আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্ত চেয়ে এর মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে কড়া নেড়েছেন অনেকে। কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ পাঁচ দিন আগে এই দাবিতে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন। তা ছাড়া আপ নেতা কুমার বিশ্বাসও আজ আদালতে গিয়েছেন। আজই সুপ্রিম কোর্ট মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল তথা ব্যাপম কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত রাম নরেশ যাদবের বিরুদ্ধে একটি মামলা শুনতে রাজি হয়েছে। এই অবস্থায় সকলেই তাকিয়ে আদালতের দিকে।

কংগ্রেস এখন সমান গুরুত্ব দিচ্ছে রাজনৈতিক আন্দোলনকেও। ব্যপম-কাণ্ডে দুর্নীতির বহরটা বেশ বড়। বিশেষ করে কোনও দুর্নীতির ঘটনায় ৪৬ জনের রহস্য-মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিক নয়। কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, স্রেফ এই পরিসংখ্যানটা তুলে ধরেই বিজেপির বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা যেতে পারে। আবার আইনি দিকটিরও গুরুত্ব রয়েছে। কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ আজ বলেন, ‘‘এক সময় এই বোর্ডের মাধ্যমে কেবল চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রবেশিকা পরীক্ষা হতো। পরে পুরোদস্তুর রাজ্য সরকারি চাকরি পরীক্ষা বোর্ডে রূপান্তরিত করেন শিবরাজ। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ব্যপমের মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাকরণ ছুঁড়ে ফেলা হয়!’’ দিগ্বিজয়ের অভিযোগ, কখনও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, কখনও আগাম টাকা নিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে, কখনও বা প্রার্থীর পরিবর্তে ভিন রাজ্য থেকে ছেলে মেয়ে এনে নাম ভাঁড়িয়ে পরীক্ষা দেওয়ানো হয়েছে। কংগ্রেসের অভিযোগ, এই বিপুল অনিয়মে শুধু মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরাই নন, আমলাদের একাংশ, রাজ্যপাল, তাঁর ছেলে, বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের অনেকে জড়িত। হিসেব মতো, গোটা ঘটনায় ৩৮০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে আটশো জন ফেরার। কংগ্রেস প্রশ্ন, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা যখন অভিযুক্ত, তখন রাজ্যের সংস্থা দিয়ে কি নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে? তবে কংগ্রেসের নিজেরও যে আশঙ্কা নেই, তা নয়। তাদেরও রাজ্যস্তরের দু’-এক জন নেতার নাম বেরোতে পারে কেলেঙ্কারিতে। জবাবে দিগ্বিজয় বলেন, ‘‘তা হলে সেই কংগ্রেস নেতাকেও জেলে পাঠানো হোক।’’

বিজেপি নেতারা মনে করছেন, এই অবস্থায় চুপ করে থাকাটাই বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে। ঠিক যে ভাবে বসুন্ধরা বা সুষমার ঘটনাটি এতো দিনে অনেকটা লঘু হয়ে গেছে, সে ভাবেই শিবরাজকে সরানোর দাবিও থেমে যাবে। তা ছাড়া কৌশলে বিজেপি এখন এটাও প্রমাণ করতে চাইছে, সাংবাদিক বা জবলপুর মেডিকেল কলেজের ডিনের মৃত্যুর সঙ্গে ব্যপমের সম্পর্ক নেই। দলের মুখপাত্র সম্বিত পাত্র আজ বলেন, ‘‘সরকারি হিসেবে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। সেটাই বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে!’’ একই সঙ্গে দিগ্বিজয়ের বিরুদ্ধেও সুর চড়াচ্ছে বিজেপি। একটা কথা ছড়ানোর চেষ্টা চলছে, দিগ্বিজয় যাঁদের সঙ্গে দেখা করছেন, যাঁদের সতর্ক করছেন, তাঁদেরই মৃত্যু হচ্ছে! তা তিনি মহারাষ্ট্রের পুলিশ কর্তা হেমন্ত কারকারে হোন বা সাংবাদিক অক্ষয় সিংহ? দিগ্বিজয় অবশ্য আজ বলেছেন, ‘‘ব্যপমে যাঁর যাঁর নাম উঠে আসছে, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে হবে। আমার নাম এলে আমাকেও জেলে পুরে জেরা করা হোক। কিন্তু ২৬ জনের মৃত্যু কম কথা!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE