এক জন পুলিশের শীর্ষ কর্তা, অন্য জন কর্মী। দু’জনের ‘আত্মহত্যা’, দু’টি সুইসাইড নোট উদ্ধার এবং দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য। তার সঙ্গে যুক্ত হল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মধ্যে জাতপাতের রাজনীতির এবং অপরাধজগতের সঙ্গে কিছু পুলিশ আধিকারিকের আঁতাঁঁতের অভিযোগ।
পর পর দুই মঙ্গলবার হরিয়ানা পুলিশের অতিরিক্ত ডিজি (এডিজি) ওয়াই পূরণ কুমার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর সন্দীপ লাথেরের ‘আত্মহত্যা’র আসল কারণ কী, তা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে চর্চা। তবে দুই অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, এটা স্পষ্ট। এর মধ্যে ‘আত্মঘাতী’ সন্দীপের দেহ পুলিশের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করেছে তাঁর পরিবার। এএসআই-র দেহ গ্রামে নিয়ে চলে যাওয়ায় সৃষ্টি হয় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির। সন্দীপের মৃত্যুর নেপথ্যে প্রয়াত আইপিএস অফিসার ওয়াই পূরণের স্ত্রী, আইএএস অফিসার অমনীত পূরণ কুমারের গ্রেফতারির দাবি তুলছে এএসআইয়ের পরিবার।
দুই মঙ্গলবারে মৃত দুই!
গত ৭ অক্টোবর, মঙ্গলবার চণ্ডীগড়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় আইপিএস অফিসার ওয়াই পূরণের দেহ। অভিযোগ, মাথায় সার্ভিস রিভলভার ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দিয়েছিলেন তিনি। ‘আত্মঘাতী’ পুলিশ আধিকারিকের ঘর থেকে উদ্ধার হয় আট পাতার চিঠি। হরিয়ানা পুলিশের দাবি, সেটি সুইসাইড নোট। তাতে মোট ১০ জন প্রাক্তন এবং বর্তমান পুলিশকর্তার নাম রয়েছে। চিঠিতে লেখা, ‘নিচু জাত’ বলে কর্মক্ষেত্রে ক্রমাগত মানসিক ভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন তিনি। নিজের ডিপার্টমেন্টে ‘অচ্ছুত’ করে রাখা হত তাঁকে।
আইপিএস অফিসারের মৃত্যুর তদন্ত চলছিল। ঠিক সাত দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর রহস্যজনক ভাবে মারা গিয়েছেন এএসআই সন্দীপ। তিনি ছিলেন ওয়াই পূরণের মৃত্যু মামলার তদন্তকারী। গত মঙ্গলবার রোহতকের একটি মাঠ থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার করেন সহকর্মীরা। হরিয়ানা পুলিশের দাবি, সন্দীপও সার্ভিস রিভলভার দিয়ে নিজেকে গুলি করেছেন। তিনিও একটি সুইসাইড নোট লিখে গিয়েছেন। তিন পাতার সেই চিঠিতে লেখা ‘আত্মঘাতী’ আইপিএস অফিসার ওয়াই পূরণ দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন।
দুর্নীতি এবং আত্মহত্যা
হরিয়ানা পুলিশ সন্দীপের ‘সুইসাইড নোট’কে সামনে রেখে বলেছে, রোহতকের সাইবার সেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর লিখে গিয়েছেন, রাও ইন্দেরজিতের সঙ্গে ৫০ কোটি টাকার রফা হয়েছিল ওয়াই পূরণের। কে এই ইন্দেরজিৎ?
হরিয়ানায় নানা অপরাধ মামলায় অভিযুক্ত তিনি। তবে শাস্তি এড়াতে বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। ইন্দেরজিৎ সঙ্গীতজগতের সঙ্গে যুক্ত। আরও কিছু ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ জগতেও তাঁর আনাগোনা রয়েছে। ইউটিউবার এলভিস যাদবের বাড়িতে হামলা থেকে র্যাপার-গায়ক রাহুল যাদব ওরফে ফাজ়িলপুরিয়াকে আক্রমণে নাম জড়িয়েছে তাঁর। সেই ইন্দেরজিতকে বাঁচাতেই নাকি আইপিএস অফিসার ওয়াই পূরণ ‘ডিল’ করেছিলেন!
সন্দীপের পরিবারের দাবি
‘আত্মঘাতী’ এএসআইয়ের পরিবারের দাবি, আইপিএস অফিসারের মৃত্যুর তদন্তে নেমে তাঁর দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করে চাপে পড়েছিলেন সন্দীপ। ওই দেহরক্ষীকে ঘুষকাণ্ডে ধরা হয়। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করার পরে কী ভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন, সে কথা নাকি মৃত্যুর দু’দিন আগে পরিবারকে জানিয়েছিলেন এএসআই। সন্দীপের পরিবারের আরও অভিযোগ, ‘আত্মঘাতী’ আইপিএস অফিসারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কত, তার খোঁজ নিক পুলিশ। বোঝা যাবে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন তিনি। মৃত পুলিশকর্মীর ভাইয়ের কথায়, ‘‘কম করে ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে ওয়াই পূরণের।’’
গত ৬ বছর ধরে রোহতকে কর্মরত ছিলেন সন্দীপ। বাবা ছিলেন ইনস্পেক্টর। কিছু দিন আগে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। সন্দীপের মা, স্ত্রী এবং তিন সন্তান রয়েছে।
কী বলছে হরিয়ানা পুলিশ
গত মঙ্গলবার রোহতক-পানিপথের রাস্তার ধারে একটি টিউবওয়েলের ধারে পড়েছিল এএসআই সন্দীপের দেহ। পুলিশের দাবি, তিন পাতার সুইসাইড নোটের পাশাপাশি সন্দীপের একটি ভিডিয়ো মেসেজ পাওয়া গিয়েছে। দুই জায়গাতেই তিনি ওয়াই পূরণকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারী বলেছেন। নিরপেক্ষ তদন্ত করতে গিয়ে শাস্তির কোপে পড়তে হতে পারে তাঁকে বলে শঙ্কাপ্রকাশ করেন এএসআই। ভিডিয়োয় তিনি বলেছেন, ‘‘যে দিন থেকে এই পুলিশ আধিকারিক কাজে যোগ দিয়েছেন, সে দিন থেকেই উনি জাতপাতের রাজনীতি শুরু করেন। বহু কর্মীকে তাড়িয়ে নিজের পছন্দের এবং দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের নিয়োগ করেছেন। এঁরা সকলে বিভিন্ন ভাবে টাকা তুলতেন। এমনকি মহিলা অফিসারদের শ্লীলতাহানিতেও অনেকে অভিযুক্ত।’’ রোহতকের পুলিশ সুপার সুরেন্দ্র সিংহ ভোরিয়া সন্দীপকে পরিশ্রমী এবং সৎ অফিসার বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘মামলার তদন্তের জন্য ফরেন্সিক দল ডাকা হয়েছে। তদন্ত চলছে।’’
আইপিএস অফিসারের স্ত্রীর দাবি
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তাদের বিরুদ্ধে হয়রানি এবং বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের অভিযোগ করেছেন ‘আত্মঘাতী’ আইপিএস অফিসারের স্ত্রী, আইএএস অফিসার অমনীত। এসসি, এসটি (অত্যাচার প্রতিরোধ) আইনের অধীনে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মোট ১৩ জন পুলিশকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি।
অতঃপর
হরিয়ানা পুলিশের দুই আধিকারিক এবং কর্মীর মৃত্যুর নেপথ্যে আসল কারণ ঠিক কী, আদতে কী কী ঘটেছিল তাঁদের সঙ্গে, তা পরিষ্কার হতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানাচ্ছে পুলিশ।