Advertisement
E-Paper

প্রকৃতির রোষ? না কি দায়ী মানুষই? উন্নয়নের বুলডোজ়ারের নীচে হিমালয়-ঘেঁষা তিন রাজ্য, কেন বার বার বিপর্যয়

উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নজির নতুন নয়। ২০১৩ সালে কেদারনাথের ঘটনার রেশ এখনও অনেকের স্মৃতিতে তাজা। তবে এত ঘন ঘন মেঘভাঙা বৃষ্টি কিংবা হড়পা বানের মতো ঘটনা অতীতে দেখা যায়নি। হিমালয়ের কোলের রাজ্যগুলিতেই কেন এমন ঘটছে বার বার?

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৫ ১০:৩৪
মেঘভাঙা বৃষ্টি ও হড়পা বানে বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ডের ছবি।

মেঘভাঙা বৃষ্টি ও হড়পা বানে বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ডের ছবি। ছবি: পিটিআই।

তিন রাজ্য। তিনটিই উত্তর ভারতে। জনপ্রিয় পর্যটনস্থল হিসাবে খ্যাতি রয়েছে তিন রাজ্যেরই। অথচ গত এক মাসে বার বার এক সুতোয় জুড়ে গিয়েছে তাদের নাম। কিন্তু আর পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে নয়, বরং তিন রাজ্যের নাম শুনলেই আতঙ্কে শিউরে উঠছেন সাধারণ মানুষ। প্রাণ হাতে নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার স্থানীয়েরাও। কারণ, মাত্র এক মাসের মধ্যে তিন রাজ্যের একাধিক জায়গায় সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মতো নেমে এসেছে বিপর্যয়! ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে একের পর এক ছবির মতো গ্রাম।

৫ অগস্ট, ২০২৫: ধরালী, উত্তরকাশী

উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে আচমকা ক্ষীরগঙ্গা নদীতে হড়পা বান নামে। জলের তোড়ে সুক্কি, ধরালী-সহ একাধিক গ্রাম ধুয়েমুছে যায়। একের পর এক ঘরবাড়ি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। সরকারি হিসাবে মৃত পাঁচ। অনেকের খোঁজ মেলেনি।

৬ অগস্ট, ২০২৫: কিন্নৌর, হিমাচল প্রদেশ

আচমকা মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে হড়পা বান! জলের তোড়ে ভেসে যায় টাংলিং নালার উপরের অস্থায়ী সেতু। পথে আটকে পড়েন অনেকে। জ়িপলাইনের সাহায্যে কোনও মতে উদ্ধার করা হয় চারশো পুণ্যার্থীকে।

১৪ অগস্ট, ২০২৫: কিশ্তওয়াড়, জম্মু-কাশ্মীর

জম্মু-কাশ্মীরের কিশ্তওয়াড়ে মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে ভয়াবহ হড়পা বান নেমে আসে। এর পর থেকে একে একে জম্মুর ডোডা, রেইসি, কাঠুয়াতেও একই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে।

৩০ অগস্ট, ২০২৫: রামবন, জম্মু

গভীর রাতে জম্মুর রামবন জেলার রাজবাগে হড়পা বান নামে। জলোচ্ছ্বাসে তছনছ হয়ে যায় বেশ কিছু ঘরবাড়ি। ধসে পড়ে এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও। এখনও পর্যন্ত মৃত তিন। অনেকে নিখোঁজ।

উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নজির নতুন নয়। ২০১৩ সালে কেদারনাথের ঘটনার রেশ এখনও অনেকের স্মৃতিতে তাজা। তবে এত ঘন ঘন মেঘভাঙা বৃষ্টি কিংবা হড়পা বানের মতো ঘটনা অতীতে দেখা যায়নি। দিন কয়েকের ব্যবধানে পর পর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রাতের ঘুম উড়েছে স্থানীয়দের। সরকারি হিসাব বলছে, ১৪ অগস্ট থেকে ২৮ অগস্টের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরে প্রাকৃতিক কারণজনিত দুর্ঘটনায় মোট ১৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর হিমাচলে গত দু’মাসে মৃত্যু হয়েছে ১৯৪ জনের!

ছবি: পিটিআই।

হিমালয়ের কোলের রাজ্যগুলিতেই কেন এমন ঘটছে বার বার?

এর একটি কারণ অনিবার্য এবং সহজেই অনুমেয়— জলবায়ু পরিবর্তন। আর এর জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হিমালয়-লাগোয়া অঞ্চল এবং উপকূল এলাকা। চলতি বছরে বর্ষার মরসুমে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে বৃষ্টির পরিমাণ অনেকাংশে বেড়েছে। আবহবিদেরা বলছেন, গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় এখনও পর্যন্ত ১১ শতাংশ বেশি বর্ষণ হয়েছে হিমাচলে। একই চিত্র জম্মু ও কাশ্মীরেও। গত এক সপ্তাহে সেখানে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৬০ শতাংশেরও বেশি! পুলওয়ামা, রামবন-সহ কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের পাঁচ গুণ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ হেন অতিবৃষ্টির জেরেই বিপত্তি! কারণ, ভারী বৃষ্টির জেরে ভূগর্ভস্থ জলস্তর বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে ধসের প্রবণতাও। নদীগুলিতেও জলের পরিমাণ বাড়ছে। বহনক্ষমতা পেরিয়ে গেলে সেই জলই প্রবল তোড়ে নেমে আসছে লোকালয়ে। এ সবের সঙ্গে আবার বিশ্বউষ্ণায়ণ তো রয়েছেই! হিমালয় অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেও এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বাড়ছে। গরম হাওয়া পাহাড়ি ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে মিশে হঠাৎ এবং ভারী বৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত, হিমালয়-লাগোয়া রাজ্যগুলিতে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতখানি দায়ী, তার থেকেও বেশি দায়ী মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থায় কর্মরত আবহাওয়াবিদ নীরজ রাণের কথায়, ‘‘উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে গত কয়েক বছরের প্রবণতা হল, গ্রীষ্মে চূড়ান্ত গরম এবং শীতে চূড়ান্ত ঠাণ্ডা পড়ছে। আবার বর্ষাও হচ্ছে তেমনই চরম। এর প্রাথমিক কারণ উষ্ণায়ন। তবে এর বাইরেও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, মাটির গুণমান বিচার না করেই যথেচ্ছ নির্মাণকাজ। সেই সঙ্গে যত্রতত্র গাছকাটা। একেও বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে।’’ কিরণের বক্তব্য, পর্যটনের উন্নয়নের নামে অনিয়ন্ত্রিত এবং বেআইনি ভাবে পাহাড়ের কোলে যথেচ্ছ নির্মাণকাজ চলছে। সঙ্গে চলছে ইচ্ছামতো গাছ কাটা। এ সবের জেরে পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঘন ঘন নেমে আসছে ধস। কোথাও কোথাও আবার নদীর ধার ঘেঁষে গড়ে উঠছে হোটেল, রাস্তা, জনপদ। পাহাড়ি নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে ব্যাহত করে তাকে আরও সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলা হচ্ছে। ফলে ভারী বৃষ্টি হলেই জল বেড়ে গিয়ে ভেসে যাচ্ছে নদীর দু’কূল।

পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলছেন, ‘‘এমনিতেই এ বছর কুমায়ুন-গাড়োয়ালে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা স্বাভাবিক নয়। জম্মুতে এক জায়গায় ১২ ঘণ্টায় ৫০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে ঘটনা পর পর সাজালে দেখা যাবে শুধু অতিবৃষ্টি কারণ নয়। ২০১৭ থেকে সরকার এক অতিউচ্চাশী প্রকল্প হাতে নেয়— চারধাম রেল এবং সড়কপথে যুক্ত করার। সাড়ে ৫ মিটার চওড়া এই রাস্তা বানানোর জন্য পাহাড়ের ঢাল কেটে পথ তৈরি করতে প্রায় ৫০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। আবার কোথাও রেলের সুড়ঙ্গ তৈরি করতে পাহাড়ে ‘ব্লাস্টিং’ করা হচ্ছে। সঙ্গে গাড়োয়াল-কুমায়ুনে অন্তত ৮০টি হাইড্রোলিক প্রকল্প চলছে। আরও ৩২০টি প্রকল্প জরিপের পর্যায়ে রয়েছে। এই সব ক্ষেত্রেই ব্লাস্টিং করে সুড়ঙ্গ তৈরি, গাছ কাটা ইত্যাদি জড়িয়ে। কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা হিমালয়কে।’’

ছবি: পিটিআই।

কল্যাণের কথায়, নবীণ ভঙ্গিল পর্বত হওয়ায় হিমালয় ‘টেকটনিক্যালি আনস্টেবল’। হিমালয়-লাগোয়া এলাকার ভূপৃষ্ঠে এমনিতেই অনেক ‘ফল্ট’ বা ফাটল রয়েছে। ব্লাস্টিংয়ের সময় আরও ছোট ছোট ফাটল তৈরি হয়। অতিবৃষ্টি হলে সেই জল ফাটলে ঢুকে মাটিকে আরও ধসপ্রবণ করে তোলে। এ ছাড়াও রয়েছে হিমবাহ-সৃষ্ট হ্রদের কারণে হড়পা বান। হিমালয় অঞ্চলে কয়েক হাজার হিমবাহ-সৃষ্ট হ্রদ রয়েছে। গত কয়েক দশকে এ ধরনের হ্রদের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। উষ্ণায়নের কারণে হিমবাহগুলি দ্রুত গলতে থাকায় হ্রদগুলিতে জলস্তর বাড়ছে। বাড়ছে হড়পা বানের আশঙ্কাও। এক সময় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসছে জল-কাদার স্রোত।

কল্যাণের আক্ষেপ, জাতীয় পরিবেশ আদালতের এক নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, নদীর প্লাবনভূমির মধ্যে কোনও নির্মাণকাজ করা যাবে না। কিন্তু তা মানা হচ্ছে কই? উত্তরাখণ্ড কিংবা হিমাচলে দেদার চলছে নির্মাণকাজ, কোনও রকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই। কেদারনাথের বিপর্যয়ের পর সুপ্রিম কোর্ট গড়েছিল বিনোদ কারে কমিটি। সেই কমিটির পরামর্শ ছিল, ভূপ্রকৃতিগত কারণে ওই এলাকায় হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্প গড়ে তোলা বিপজ্জনক। সে কথাতেও কান দেয়নি কেউ। এক সময় হিমালয়কে বাঁচাতে অনশনে বসেছিলেন আইআইটি-র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জিডি আগরওয়াল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, কথা রাখবেন। কিন্তু বছর ঘুরেছে, ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে— কেউ কথা রাখেনি! একের পর এক বিপর্যয় থেকে শিক্ষা না নিয়ে বরং উন্নয়নের বুলডোজ়ারের নীচে পিষে ফেলা হয়েছে পাহাড়কে। এত দিনে সর্বংসহা পাহাড়েরও সহ্যসীমা পেরিয়েছে। উন্নয়ন আর প্রকৃতি— এর মাঝে কোথায় থামতে হবে, এ বার সেই লক্ষ্মণরেখা টানতে হবে মানুষকেই।

cloudburst Flashflood
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy