গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আগে বাবুঘাট বা ময়দানে তাঁবু খাটিয়ে যা হত, এখন সেটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলঘরে হয়। কখনও কখনও টিকিট বিক্রি করেও। উত্তর ভারতে যেমন ‘সৎসঙ্গ’ হয়, ততটা বড় মাপের না হলেও পশ্চিমবঙ্গেও তার রেওয়াজ রয়েছে। তবে ব্যবস্থাপনা, যোগদানকারীর সংখ্যা এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি না থাকায় বড় বিপদ এড়ানো যায়।
হাথরসের দুর্ঘটনায় মৃতেরা সুখে বাঁচতে চেয়েই এসেছিলেন ভোলে বাবার ‘সৎসঙ্গ’ অনুষ্ঠানে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাঁর ডাকে লাখ লাখ মানুষের ছুটে আসা এক দিনে তৈরি হয়নি। ভক্তির বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে কেউ কেউ ‘বাবাজি’ থেকে ‘মহারাজ’ হয়ে গিয়েছেন অর্থ আর অনুগামীর প্রাচুর্যে। হাথরসের ঘটনায় ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক ছিল না বলেই মনে করেন নিয়মিত বিভিন্ন ‘সৎসঙ্গ’ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া বিজেপি নেত্রী শশী অগ্নিহোত্রী। বিজেপির মহিলা মোর্চার রাজ্য স্তরের নেত্রী শশী বলেন, ‘‘মানুষ কতটা সচেতন, তার উপরেই সবটা নির্ভর করে। মানুষ সাধু-সন্ন্যাসীদের উপরে ভরসা করেন। কেউ উপকার পেলে অন্যকেও নিয়ে যেতে চান। মনে হয়, আয়োজকেরা ভাবতে পারেননি এত ভিড় হবে। সেই মতো ব্যবস্থা না থাকাতেই দুর্ঘটনা।’’
এ দেশে অনুকুলচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ‘সৎসঙ্গ’ নামে একটি সংগঠনই রয়েছে। মূল কেন্দ্র ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে হলেও পশ্চিমবঙ্গেই বেশি জনপ্রিয় এই ধর্মীয় সংগঠন। প্রতিদিন ‘ইষ্টভৃতি’ নামে ভক্তদের থেকে দৈনিক অর্থ জমিয়ে সংগঠনকে দেওয়াই নিয়ম ওই সৎসঙ্গের। বিভিন্ন জায়গায় ‘অধিবেশন কেন্দ্র’ রয়েছে। সেখানে নিয়মিত ‘সৎসঙ্গ’ বসে। সেখানে মূলত গান, বক্তৃতা এবং ধর্মকথা হয়। শেষে ভোজনের ব্যবস্থা থাকলে তাকে ‘আনন্দবাজার’ বলা হয়। তবে সেই ‘সৎসঙ্গ’ আর হাথরসের ‘সৎসঙ্গ’ আলাদা। অনুকুলচন্দ্রের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সম্রাট পালের কথায়, ‘‘আমাদের এমন অনিয়ন্ত্রিত ভিড় হয় না। আমরা গুরুভাইরা মূলত মিলিত হই। ব্যবস্থাপনায় কোনও ত্রুটি কখনওই থাকে না।’’
কলকাতা শহরে অনেকেই অন্য রাজ্য থেকে ধর্মকথা শোনাতে আসেন। সেই সব আসরে মূলত ভিড় হয় হিন্দিভাষীদের। তাঁদের মধ্যে আবার রাজস্থানিদের সংখ্যাই বেশি। শশী জানাচ্ছেন, সেখানে মূলত প্রবচন হয়। প্রধান সাধু ছাড়াও অনেকে বক্তৃতা করেন। মানুষকে সুপথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সেই সঙ্গে ভজন হয়। তবে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা বা নিয়ম থাকে বলে শশীর জানা নেই। তবে কেউ কিছু নিয়ে যেতেই পারেন। অনেক সময়ে কারও কারও প্রশ্নের উত্তর দেন সাধুরা।
বিজেপির সাধ্বী ঋতাম্ভরা ব্রিগেডে ‘সৎসঙ্গ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। এখন গোটা দেশেই প্রবচন একটা ‘ব্যবসা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন ধর্মীয় ইতিহাসের গবেষক নবকুমার ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘একটা সময় অনেক বাড়িতে আলাদা করে ‘ভাগবত গৃহ’ থাকত। সেখানে ভাগবতের ব্যাখ্যা শুনতে অনেক মানুষ জড়ো হতেন। বাংলার প্রাচীন সব ঠাকুরদালানেও প্রবচনের আয়োজন হত। কিন্তু এখন বিষয়টার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। এখন ভক্তির চেয়ে আড়ম্বর বেশি।’’
ইদানীং সমাজমাধ্যমে অনেকেই ‘গুরু’ হিসাবে বাণী দেন। প্রায় সকলেরই নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। তাঁদের সে সব কাজ করার জন্য যে পেশাদারদের নিয়োগ করা হয়, তাঁরাও ‘শর্টস’ বা ‘রিল্স’ বানাতে পারেন। এই গুরুরা সকলেই ভাল বাগ্মী। ফলে তাঁদের কথা মানুষ শোনেন। নবকুমারের কথায়, ‘‘এঁরা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো। কথার জাদুতে মানুষকে টানেন। ইউটিউবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা শোনেন মানুষ। ভিড় হয় তাঁদের ‘সৎসঙ্গ’-এর নাম শুনলেই। যেমন হয়েছে হাথরসে।’’ বস্তুত, ভিড় টানতে অনেকে নানা জাদু দেখান, লোভ দেখান, সুখের গ্যারান্টি দেন। নবকুমারের কথায়, ‘‘এটা ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। ধর্মের সঙ্গে ভণ্ডামি মিশে যাওয়াতেই সমস্যা।’’
একই ধারণা ভারতীয় সৎসঙ্গ নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করা সৌমিক রাহার। ‘সনাতন ঐক্য মঞ্চ’ নামে সংগঠনের প্রধান সৌমিক বলেন, ‘‘আগে এত সহজে এতটা প্রচার করা যেত না যেটা এখন করা যায়। ফলে লাখ লাখ মানুষের ভিড়ও হয়।’’ সৌমিক জানান, সম্প্রতি কলকাতার বিশ্ব বাংলা প্রেক্ষাগৃহে এক খ্যাতনামা ধর্মীয় প্রবক্তা এসেছিলেন। দেরিতে পৌঁছানোয় তিনি বসার জায়গা পাননি। সৌমিক বলেন, ‘‘যে সংগঠন ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, তাদের নানা সেবামূলক কাজও রয়েছে। তার জন্য অর্থসংগ্রহের লক্ষ্যে সামনের কয়েকটা সারির জন্য এক লাখ টাকা দামের টিকিট ছিল।’’
দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এই ধরনের ‘সৎসঙ্গ’ দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে সৌমিকের। তাঁর কথায়, ‘‘শিল্পীর মতোই আধ্যাত্মিক গুরুদেরও বাজার তৈরি হয়েছে। এটা মানতে হবে যে, একটা বড় অংশের মানুষ হতাশায় ভুগছেন। শান্তির খোঁজে তাঁরা যান বিভিন্ন স্বঘোষিত গুরুর কাছে।’’ এই ধরনের গুরুদের সঙ্গে খ্যাতিমান ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’দের মিল পান নবকুমার। তিনি বলেন, ‘‘এঁরা কেউ যোগব্যায়াম, কেউ প্রাণায়াম শেখান। প্রত্যেকেই ‘শিক্ষক’ হয়ে জীবনকে সুন্দর করার উপায় বাতলান। মানুষ তাতে বিশ্বাসও করেন।’’
তবে হাথরসে ভোলে বাবার প্রবচনের আয়োজনের চেয়ে অনেক আলাদা সদ্গুরু বা আর্ট অফ লিভিংয়ের ‘সৎসঙ্গ’। যোগদানকারীদের সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা এবং রুচি আলাদা। যদিও সংখ্যায় ‘ভোলে বাবা’দের ভক্তেরাই এগিয়ে। তাঁদের ‘ভগবান’ মনে করার লোকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সৌমিকের বক্তব্য, ‘‘ভগবান সাজার ইচ্ছা সকলের মধ্যেই থাকে। নানা রকমের ভগবান। যে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই সেটা সত্যি। যাঁরা দীর্ঘ ক্ষণ রেশন দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁদের কাছে ওই দোকানের মালিকও ঈশ্বর। সকলেই তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে পৌঁছতে চান।’’
তবে নবকুমার এবং সৌমিক দু’জনেই মনে করেন, রামকৃষ্ণ মিশন বা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কোনও সন্ন্যাসী কথা বললে সেখানে লাখ লাখ শ্রোতা হবে না। কারণ, সেখানে বার বার ত্যাগের কথা আসবে। আর বেশির ভাগ মানুষ ছোটেন সেখানেই, যেখানে সুখ আর ভোগের উপায় বলা হয়। সেখানে শুধু দুর্ঘটনা নয়, আরও অনেক ‘সামাজিক ভয়’ থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy