Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মুম্বই মনতাজ

অন্ধকারে হারিয়ে যাবেন না

অমিতাভ বচ্চন বা মিঠুন চক্রবর্তী সবাই হয় না। বা তারও অনেক আগে দেব আনন্দ। এঁরা প্রচুর লড়ে জায়গা করে নিয়েছেন। ঠিক কথা। কিন্তু মুম্বইয়ে বাকি প্রায় সবাই হারিয়ে যায়। অতল অন্ধকারে। সাধু সাবধান। সতর্ক বার্তা শোনালেন বহুদর্শী মিলন মুখোপাধ্যায়।স্বপ্নের শহর মুম্বই শহর। ভিন্ রাজ্য থেকে দিনেরাতে ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস (বা মুম্বই ভিটি) এবং মুম্বই সেন্ট্রাল স্টেশনে কয়েকশ’ রেলগাড়ি বয়ে আনে সব স্বপ্নবিলাসীদের। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, বঙ্গদেশ দিগ্বিদিক থেকে নানান বয়েসের ভারতবাসী এসে হাজির হয় এখানে। তাদের আবার সিংহভাগই তরুণ-তরুণী। ইস্কুলের উঁচু ধাপের ছাত্রছাত্রী থেকে কলেজের যুবক-যুবতী তথা যৌবনোত্তীর্ণ স্বপ্নবিলাসীরা বেশির ভাগই মোহগ্রস্তের মতন চলে আসে রুপোলি পর্দা বা বোকাবাক্সের টানে।

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

“দ্য বিগেস্ট টেম্পটেশন অফ লাইফ ইজ/টু কনভার্ট ড্রিমস টু রিয়ালিটি.../বাট, দ্য বিগেস্ট ডিফিট অফ লাইফ কামস/হোয়েন উই সারেন্ডার আওয়ার ড্রিমস টু রিয়ালিটি।”

স্বপ্নের শহর মুম্বই শহর। ভিন্ রাজ্য থেকে দিনেরাতে ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস (বা মুম্বই ভিটি) এবং মুম্বই সেন্ট্রাল স্টেশনে কয়েকশ’ রেলগাড়ি বয়ে আনে সব স্বপ্নবিলাসীদের। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, বঙ্গদেশ—দিগ্বিদিক থেকে নানান বয়েসের ভারতবাসী এসে হাজির হয় এখানে। তাদের আবার সিংহভাগই তরুণ-তরুণী। ইস্কুলের উঁচু ধাপের ছাত্রছাত্রী থেকে কলেজের যুবক-যুবতী তথা যৌবনোত্তীর্ণ স্বপ্নবিলাসীরা বেশির ভাগই মোহগ্রস্তের মতন চলে আসে রুপোলি পর্দা বা বোকাবাক্সের টানে। এমনিতেই সাধারণ ‘ফটো’ দেখার একটা আকর্ষণ রয়েছে। নিজের প্রতিচ্ছবি হলে তো কথাই নেই। তার ওপর আবার ‘মুভিং’ বা চলন্ত-জীবন্ত আমিই তো! সোঁদরপানা চেহারা (মাসল বা ঢেউ-সমেত নরম চাঁদমুখ) দেখে নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যাই। তদুপরি যদি ‘ইট্টু অ্যাক্টো’ও করতে পারি, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। লুফে নেবে ‘ফিলিম ইন্ডাস্ট্রি’। মাথায় তুলে নাচবে আমায় সোনায় মোড়া মুম্বই জগত্‌।

অতটা না হলেও অমন নিশির ডাকের হাতছানিতে প্রথম যৌবনে এই কলমচিও যে আংশিক সাড়া দিয়েছে, সেই কথাটি কবুল করা ভাল। ছায়াছবির গ্ল্যামার ছিল চাপা আকর্ষণ। তবে আঁকা ছবির জগত্‌ তথা লেখালেখি ছাড়াও কোনও বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে পছন্দসই একটি চাকরি পাবার আশাও ছিল যথেষ্ট।

যেহেতু স্কুল-কলেজ জীবনে জোছন দস্তিদারের নট্ট কোম্পানি ‘বৈশাখি’, পরে ‘রূপান্তরী’র সঙ্গে কয়েক ডজন নাটকে বড়সড় ভূমিকায় ‘অ্যাক্টো’ করে ‘যশ’ (হাততালিকে যাত্রায় বলা হত যশ) পেয়েছি অনেক, এবং রঙমহল, বিশ্বরূপা, মিনার্ভা মঞ্চ থেকে শুরু করে ‘নিউ এম্পায়ার’ (অর্ধশতক আগে নিউ এম্পায়ারেও নাটক হত), বা ধনঞ্জয় বৈরাগী ওরফে তরুণ রায়ের মিনি ‘থিয়েটার সেন্টার’এর মঞ্চে উঠেও লাফালাফি-দাপাদাপি করেছি। ফলে ধরেই নেওয়া গিয়েছিল যে, সিনেমায় ‘অ্যাক্টো’ করার চান্স পেলে ফাটিয়ে দেব। তা সে এখনও ফাটাচ্ছি। আপন কপাল!

নিজের সাতকাহন গাইলুম যে জন্যে, সেই আসল বিষয়ে আসা যাক। পরে অবসর মতো আবার গাওয়া যাবে।

মুম্বইয়ের নানান কাগজে টুকরো-টাকরা প্রায়ই খবর দেখা যায় : “অমুক এলাকা থেকে অত জন ‘অবৈধ’ ব্যবসায়ের দায়ে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। দেহপসারিণীরা অধিকাংশই মহারাষ্ট্রে বহিরাগত। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তর ও মধ্যপ্রদেশ এবং নেপালের বাসিন্দা। জোর তদন্ত চলছে” ইত্যাদি এবং খবর শেষ। এর আগাপাস্তলা কিছুরই উল্লেখ থাকে না।

মনে পড়ে, গুণিজন ঘোষণা করে গেছেন, “প্রত্যেক মানুষই তার ব্যক্তিগত জীবনের জীবনীতে নিজেই নায়ক বা নায়িকা। এখানে দেহপসারিণী বলে যাদের এক লাইনে জীবনী শুরু ও শেষ করা হয়েছে, আলাদা করে তাদের কথা জানতে পারলে দেখা যাবে, প্রত্যেকেই তার জীবনের পরিমণ্ডলে এক একজন নায়িকা। পরাজিতা, লাঞ্ছিতা। বিয়োগান্ত কাহিনির নায়িকা।

সম্প্রতি মালাডের একটি বাংলোবাড়ি থেকে পাঁচটি মেয়েকে উদ্ধার করেছে মুম্বই পুলিশ। মালাড-মালবানি থানার বড় দারোগা কানাডে সাহেবের সঙ্গে কিঞ্চিত্‌ ‘দোস্তি’ থাকার দৌলতে আলোচ্য পঞ্চকন্যার তাবত্‌ ঘটনাবলির ঘনঘটার কাছাকাছি থাকতে পেরেছি। এদের একজনের জবানবন্দি শোনাচ্ছি, তারই জবানিতে। কানাডে সায়েবের নিষেধ অমান্য করব না বলেই আসল নামটি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। ধরা যাক মেয়েটির নাম সুইটি। জব্বলপুরের সুইটি রাই। আজ থেকে বছর দুয়েক আগে, ওর বয়েস তখন উনিশ, বারো ক্লাস পাশ করে ঘরেই বসেছিল। “আরও পড়াশুনো করে বিদুষী হবার ইচ্ছে ছিল না। বাবা কেরানির চাকরি করেন জব্বলপুরের এক প্রাইভেট কোম্পানিতে। দুটো ছোট ভাই আছে আমার। পড়াশুনো করছে। আমি খুব ভাল করেই জানতাম, বাবা সারা মাসে সাকুল্যে যে মাইনে রোজগার করতেন তাতে ঘর-খরচা চালিয়ে, আমাদের তিন ভাইবোনের লেখাপড়ার বাড়তি খরচ কুলিয়ে উঠতে পারতেন না।”

“এ কথা তুমি ভাবলে কেন?” কানাডের জিজ্ঞাসা।

“ঘরের অবস্থা দেখে দেখে। টানাটানি। সেই নিয়ে মায়ের সঙ্গে নিত্য খটাখটি। এছাড়া বাবা ঘুরিয়ে আমাকে নিত্য খোঁটা দিত পড়াশুনা নিয়ে।”

“বেশ। তারপর?”

“ঘরে বসে বসে সারাদিনই, দুপুর-বিকেল টিভি দেখতাম। খুব ইচ্ছে ছিল ‘সিরিয়াল’এ নেমে অভিনয় করি। সেই ছোটবেলা থেকে। ওই জন্যেই, বলতে গেলে সারাক্ষণই টিভির সামনে বসে থাকতাম। মুম্বই আসার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না। চেনা কেউ তো থাকে না এখানে।”

“তা এখানে এসে পৌঁছলে কী করে? তাড়াতাড়ি সব বলো। আমাদের তো অঢেল সময় নেই। কী করে এলে মুম্বইতে?”

“জব্বলপুরের পরিচিত প্রদীপের সঙ্গে হঠাত্‌ দেখা। ওকে খুলে বললুম, অ্যাক্টিং করার ভীষণ ইচ্ছে আমার। টিভি সিরিয়ালে। প্রদীপ ভরসা দিল। বলল, আমার চেহারা ভাল। হাইটও বেশ ভালই। বড় ব্যানারের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবে।”

“ব্যস! তুমি অমনি তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এলে?” কানাডের কথায় খানিকটা শ্লেষ বা ব্যঙ্গ মেশানো।

সুইটি জবাব দিলে, “তা না হলে তো আমার এখানে আসাই হত না। বাবা-মা, পরিবারের সব্বাইকে বুঝিয়েসুঝিয়ে তবে রওনা হয়েছি ঘর থেকে। প্রদীপ সোজা আমাকে নিয়ে এসে তুলল ভারসোবায় ওর এক ঘরের বাসায়।”

সেখানে স্বভাবতই ওই ধুরন্ধর প্রদীপ তার ভাগের ‘মাংস’ খেতে চাইলে এবং অমন অবস্থায় সুইটি তার ‘দেহ’ ওকে না দিয়ে পারে না। নাচার দশা যে তখন। পরে অবিশ্যি সুইটিকে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়েছে একজন ‘একস্ট্রা’ বা ‘জুনিয়র আর্টিস্ট’দের সাপ্লায়ারের সঙ্গে। তারই দৌলতে দু’চার দিন হঠাত্‌ হঠাত্‌ কাজ পেয়েছে। দুপুরের খাওয়া আর সামান্য দক্ষিণা।

“তাহলে তুমি অ্যাক্টিং করলে?”

“না না। অ্যাক্টিং না ছাই! পাউডার-লিপস্টিক-রুজ মেখে বসে রইলাম শু্যটিঙের সেটে। ডাক আর আসে না। সন্ধে নাগাদ ডাক এল। একশো-দেড়শো জনের ভিড়ের মধ্যে বসে বসে ঘেমেই অস্থির। ক্যামেরা একবার খালি আমাদের উপর দিয়ে ঘুরে গেল দু’এক সেকেন্ডের জন্য। ব্যস, শুটিং শেষ। কাগজে সই করে মজুরি নাও এবং যাও....! তবে ওই ভিড়ের মধ্যেই জব্বলপুরের অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে আমাকে একজন ‘এস্টেট এজেন্টে’র মারফত একটি পেয়িং গেস্টের বন্দোবস্ত করে দিল। পরের মাস দুয়েক টেনেটুনে চলল। একে-তাকে ধরে ধরে সিরিয়ালে একটি রোল পাবার আশায় হন্যে হয়ে চেষ্টা করলুম। জুটল না। উল্টে একস্ট্রার ডাকও আর আসে না। দিন চালাবার কথা ভাবতেও জ্বর আসে। খাবার পয়সাই নেই। বাবা-মার কাছে কিছু চাইতেও পারছি না। কারণ ওদের জানিয়েছি আমি খাসা আছি।”

এর পর আর কী! এ লাইনে যা হয়ে আসছে বরাবর, তাই হল সুইটির ক্ষেত্রেও। মীনা সিংহ বলে একজনের সঙ্গে আলাপ হওয়াতে নেমে পড়ল লাইনে।

“আমার খদ্দেররা বেশির ভাগই বয়স্ক। যথেষ্ট পয়সাওলা। ওরা আমার সঙ্গে রাত কাটাবার দামও দিত ভাল। এক-এক রাতে ৫-৬ হাজার করে। মীনাকে শতকরা ৩০ টাকা হিসেবে দিতে হত বটে, তবে ও নিয়মিত খদ্দেরের জোগানও দিত। ফলে ধীরে ধীরে আমি সত্যিই ‘কল গার্ল’-এ পরিণত হয়ে গেছি, স্যর।” কথা বলতে বলতে কাঁদছিল সুইটি। বড় সায়েব জিগ্যেস করল, “জব্বলপুরে ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না?”

মাথা নিচু করে জবাব দেয় মেয়েটি, “উঁহু সাব। কোন মুখ নিয়ে গিয়ে আমার মা-বাবার সামনে দাঁড়াব? ভাইদেরই বা কী বলব, বলুন! তার ওপরে আমি নিত্য টাকা পাঠিয়ে দিই যাতে ওরা ধরে নেন আমি খুব ভালই আছি। অথবা ওরা যদি জানতে পারেন কী উপায়ে আমি রোজগার করছি, তাহলে...” বলতে বলতে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে কথা থেমে যাচ্ছে। “এই নরক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি সাহাব, কিন্তু কী করে তা জানা নেই...ফলে এই স্রোতেই এখন গা ভাসিয়ে দিয়েছি।”

এমনি করেই হাজার হাজার সুইটি সারা দেশ থেকে এই মুম্বই শহরে এসে উপস্থিত হয়। কৈশোর-যৌবনের স্বপ্নবিলাসীরা শহরের জাঁকজমক, চাকচিক্যময় রুপোলি পর্দা দেখে সোনালি আশায় ভর করে আসে এ রাজ্যে। বড়সড় ‘ব্রেক’ পাবে! দূরদর্শন-বায়োস্কোপে নামবে! হায়! নামে ঠিকই, তবে তা রুপোলি পর্দায় নয়, নরকের সহজ পথে।

তাই ‘নামা’র কথা ভেবে (সুনীল গাঙ্গুলির ভাষায়) ‘আশায় আশায়, আশায় আশায়’ নিশির ডাকে সাড়া দেবেন না দেশের তরুণ-তরুণীরা! অমন ভুল করে আরও একজন ‘সুইটি’ হবেন না প্লিজ!গত এক বছরে ৩০ লক্ষ নারীকে পাচার করা হয়েছে। এই ভারতে, বিভিন্ন প্রান্তে। এদের ৪০ শতাংশ কম বয়েসি! এদের কারও কোনও খোঁজ নেই!

অমিতাভ বচ্চন বা মিঠুন চক্রবর্তী সবাই হয় না। বা তারও অনেক আগে দেব আনন্দ। এঁরা প্রচুর লড়ে জায়গা করে নিয়েছেন। ঠিক কথা। কিন্তু মুম্বইয়ে বাকি প্রায় সবাই হারিয়ে যায়। অতল অন্ধকারে। সাধু সাবধান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mumbai mumbai city milan mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE