প্রস্তুতি তুঙ্গে। সেজে উঠছে মহাত্মা মন্দিরের প্রবেশদ্বার।—নিজস্ব চিত্র।
পুরনো সচিবালয়ে তথ্য অধিকর্তার দফতরে শনিবার বিকেলে চূড়ান্ত ব্যস্ততা। কর্মী-অফিসার সকলেই সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র বিলিতে মগ্ন। অনেকেই আসছেন, কার্ড নিচ্ছেন, চলে যাচ্ছেন। ঝকঝকে অফিসে কোনও আওয়াজ নেই। হাসিমুখে যেন একদল যন্ত্র কাজ করছে।
পাশাপাশি দেখুন ৫ জানুয়ারির নবান্ন। বঙ্গ সচিবালয়ের কর্মী-অফিসারেরা সে দিন এই কাজই করছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে গাঁধীনগরের এই চূড়ান্ত মসৃণ, গোছালো চেহারা কোথায়? আমেরিকার একটি প্রথম সারির বাণিজ্যিক দৈনিকের সাংবাদিক সে দিন কলকাতায় ছিলেন। রাজ্য সরকারের ‘বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন’ নয়, তিনি এসেছিলেন এক জাপানি পর্যটকের ধর্ষণের খবর করতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ফাটাফাটি’ আসরের খবর তিনি আদৌ পাননি।
মাথায় সেটাই ঘুরছিল। প্রশ্নটা করেই ফেলা গেল যুগ্ম তথ্য অধিকর্তা অরবিন্দ পটেলকে। বিদেশি সাংবাদিক কেউ আসছেন না? ফাইল থেকে চট করে মুখটা তুললেন। তার পর একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। বললেন, “এখানে বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য আলাদা প্রেস বক্স করা হয়েছে। মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরির সঙ্গে ১২ জন সাংবাদিকের একটি দল এসেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গেও বড় দল আসছে। আর এমনিতে, প্রত্যেকটা সহযোগী দেশ থেকেই সাংবাদিকেরা এসেছেন। তাঁদের আতিথেয়তায় যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, সেই দায়িত্ব আমাদের।”
এমন পরিস্থিতিতে ঘাড় নেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। কিন্তু প্রস্তুতির নিরিখে এই একটা তথ্যই বলে দিচ্ছে, ধারে-ভারে ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’ এবং ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর তফাত ততটাই, যতটা ময়নার সঙ্গে ময়ূরের। শনিবার আমদাবাদ বিমানবন্দরে নামামাত্র বোঝা যাচ্ছিল, শহরে কিছু একটা হচ্ছে। অ্যারাইভাল লাউঞ্জে সুবেশাদের ভিড়। প্রত্যেকের হাতে গোলাপ। আমন্ত্রিতদের জন্য সেখানে রয়েছে বিশেষ পরিষেবা কেন্দ্র। স্রেফ চোখাচোখি হওয়ার অপেক্ষা। আপনা থেকেই এগিয়ে আসবেন তাঁরা কোনও সাহায্য চাই স্যার? ঘুম নেই বিমানবন্দর ম্যানেজার, সিআইএসএফ কম্যান্ডান্টের। একটা বিমান নামা মানে কয়েক জন ভিভিআইপি। ফলে পাইলট, এসকর্ট, টেল-কার আর কার্বাইনধারীদের ভিড়ে ভিড়াক্কার বিমানবন্দর চত্বর।
একে-৪৭, এসএলআর-ধারীরা শুধু যে বিমানবন্দর চত্বরের দখল নিয়েছেন তা নয়, গাঁধীনগর শহরটা কার্যত দুর্গের চেহারা নিয়েছে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ। প্রত্যেকের গলায় ডিউটি কার্ড। সুসংহত ট্রাফিক। গাড়িচালক প্রেম সিংহ জানালেন, দুপুরে ‘মোদীজি’ চলে এসেছেন। তার পর থেকে শহরে পুলিশের ‘পিএম-ডিউটি’ শুরু হয়ে গিয়েছে। কানাডা-ব্রিটেন থেকে ১৭০ জন প্রতিনিধি এসেছেন। প্রেম জানেন না, মার্কিন বিদেশসচিবও এসে গিয়েছেন আজ। তিনি ওয়াশিংটন ছাড়ার সময়ে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি জানিয়ে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী আগামী ১০ বছরের মধ্যে ভারত-আমেরিকার বাণিজ্য ১০ হাজার কোটি ডলার থেকে ৫০ হাজার কোটিতে নিয়ে যেতে চান। কেরি সেই প্রয়াসকেই এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাঁর সঙ্গে এসেছে ১৫০ জনের একটি দল।
আজ ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ এর সূচনা পর্বে মোদীর সঙ্গে বক্তৃতা দেবেন কেরিও। সোমবার তিনি এবং মোদী বৈঠকে বসবেন বিভিন্ন দেশের গ্লোবাল সিইও-দের সঙ্গে। সানন্দ-এ ফোর্ডের মোটরগাড়ি কারখানাও দেখতে যাবেন কেরি। সেই সানন্দ, যেখানে সিঙ্গুর থেকে বিতাড়িত হয়ে টাটা-রা ন্যানো কারখানা সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ২০০৮-এ। সেখানে ন্যানো কারখানার পাশেই গড়ে উঠেছে ফোর্ডের কারখানা। আর সিঙ্গুরে পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দিতে আগাছার বৃদ্ধি হচ্ছে তরতরিয়ে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবের চার দিনের ভারত সফরও শুরু হচ্ছে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ দিয়ে। মোদীর রাজ্য দেখতে মুন-এর সঙ্গী স্ত্রী ইউ-সুন-তায়েক। শিল্প সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে সস্ত্রীক মুন যাবেন সাবরমতী আশ্রমে। বডোদরায় সৌর বিদ্যুতের একটি প্রকল্পও দেখতে যাওয়ার কথা তাঁর।
শনিবার গাঁধীনগর পৌঁছেই অভ্যাগতদের সঙ্গে এক প্রস্ত আড্ডা-বৈঠক করেছেন মোদী। আজ ভারতীয় শিল্পমহলের শীর্ষ বাছাইদের মঞ্চে আবির্ভূত হওয়ার কথা। এ বার মূলত দু’টি বিষয়কে সামনে রেখেই এই সম্মেলন বসছে। গুজরাতের ধোলেরা এবং পাটন-এ ‘স্পেশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন’-এর সাফল্যের পর এ বার গুজরাতকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির নতুন ঠিকানা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি নিয়েই দীর্ঘ আলোচনা হবে প্রথম দিনে। আর দ্বিতীয় দিনটা কার্যত অরুণ জেটলির। সোমবার ‘ইনভেস্ট ইন ইন্ডিয়া’ থিমের উপর দিনভর চর্চায় অংশ নেবে আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। থাকবেন অনেক দেশের রাষ্ট্রদূতেরাও।
সব চেয়ে যেটা আশ্চর্য লাগছিল, তা হল ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর এই সপ্তম সংস্করণ ঘিরে গাঁধীনগরের ‘মুখবদল’। গুজরাত থাকবে, আর তাতে মোদী থাকবেন না তা তো হতে পারে না। কিন্তু শিল্প সম্মেলনের যাবতীয় বিজ্ঞাপন-ফেস্টুনে মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন পটেলের মুখ। তিনিই যে এই কর্মকাণ্ডের মূল হোতা তা বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়াস সর্বত্র। শহরে চোখ বুলিয়েও খুঁজে পাওয়া গেল না ‘বিজেপি’ দলটাকে। সম্মেলনের আগে-পিছনে শুধু ‘গুজরাত সরকার’। কেউ বুঝতেই পারবে না, গত প্রায় ২০ বছর ধরে এ শহরটার দখল রয়েছে গেরুয়া শিবিরের হাতে।
এখানেও বাংলার সঙ্গে তফাত। মমতা জমানার গোড়া থেকেই বরাবর সরকারি সভা আর তৃণমূলের সভা সমার্থক। মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের রং, তাই স্থানীয় নেতাদের উৎসাহে কলকাতার বহু অলিগলি পর্যন্ত বেখাপ্পা নীল-সাদায় সেজে ওঠে। গাঁধীনগরেও গাছের গুঁড়িতে গেরুয়া-সাদার প্রলেপ। কিন্তু কিছুই বেমানান লাগছে না। বিমানবন্দর থেকে অনুষ্ঠানস্থল মহাত্মা মন্দির পর্যন্ত গোটা পথটা সাজানো। বিশাল তোরণ, শহর মুড়ে দেওয়া হয়েছে রঙবেরঙের এলইডি আলোয়। কোথাও বিজেপির ‘কণ্ঠস্বর’ নেই।
বিজেপি কি তবে ‘ধর্ম’ হারাল গুজরাতে? উত্তর হল একেবারেই না। বহু শিল্পপতির মতোই এ দিন দুপুরে গাঁধীনগরে এসেছেন হরিয়ানার ডেরা সচ্চা সৌদা-র প্রধান ‘বাবা রাম রহিম’। হরিয়ানা ভোটে তিনি নাকি অমিত শাহের দিকে একটু হেলেছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর গুজরাত আগমনে যে বিপুল সংবর্ধনা দেখা গেল বিমানবন্দরে, তা অবাক করার মতো। শুধু গোলাপ আর গোলাপ। বাবা মার্সিডিজে চেপে চলে গেলেন।
বোঝা সহজ, লক্ষ্মীলাভ হোক বা মোক্ষলাভ উভয় ক্ষেত্রেই অতি উত্তম অবস্থানে নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy