Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

তাঁর ভোট নিতে বুথ বসে জঙ্গল-গভীরে

এ যেন পর্বতের মহম্মদের কাছে যাওয়া। কাল দেশে সপ্তম দফা ভোটের সকালে স্রেফ এক জন নাগরিককে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে সূর্য উঠতে না-উঠতেই ৩৫ কিলোমিটার দূরের এক বুথের উদ্দেশে পাড়ি দেবেন ৬ জন ভোটকর্মী ও ৩ জন বনকর্মী। দক্ষিণ-পশ্চিম গুজরাতে ১৪১২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ভারতের একমাত্র সিংহ অভয়ারণ্য গির।

নিজের আশ্রমে ভরতদাস।  ছবি: অনমিত্র সেনগুপ্ত

নিজের আশ্রমে ভরতদাস। ছবি: অনমিত্র সেনগুপ্ত

অনমিত্র সেনগুপ্ত ও সুজিষ্ণু মাহাতো
গির ও কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৪
Share: Save:

এ যেন পর্বতের মহম্মদের কাছে যাওয়া।

কাল দেশে সপ্তম দফা ভোটের সকালে স্রেফ এক জন নাগরিককে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে সূর্য উঠতে না-উঠতেই ৩৫ কিলোমিটার দূরের এক বুথের উদ্দেশে পাড়ি দেবেন ৬ জন ভোটকর্মী ও ৩ জন বনকর্মী।

দক্ষিণ-পশ্চিম গুজরাতে ১৪১২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ভারতের একমাত্র সিংহ অভয়ারণ্য গির। সেই অরণ্যের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে আশ্রম সরস্বতী দাস বাপুর। জনশ্রুতি, পাণ্ডবেরা বনবাসে এসে এখানে বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, স্থানীয়দের কাছে যা বাণেজ তীর্থক্ষেত্র হিসাবেই পরিচিত। বর্তমানে উদাসীন আখড়ার একমাত্র আশ্রমিক এই ভরতদাস মহারাজ দর্শনদাস। জুনাগড় লোকসভা কেন্দ্র শুধু নয়, গোটা দেশের তিনিই একমাত্র নাগরিক, যাঁর ভোটের ব্যবস্থা করে দিতে থাকছে গোটা একটি বুথ। অরণ্যচারী ওই ভোটার যাতে নিজের ভোটটি স্বচ্ছন্দে দিতে পারেন, তার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন।

মৎস্য রফতানি কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ভেরাবল থেকে গাড়িতে ঘণ্টা খানেক যাওয়ার পরে শুরু গির অরণ্য। বন দফতরের পারমিট ছাড়া ভেতরে ঢোকা যায় না। অসমান কাঁচা রাস্তা। একাধিক শুকনো নদীখাতের পাশাপাশি রয়েছে কিছু সজীব নদীখাতও। বর্ষায় সেগুলি ভরে গিয়ে কার্যত অগম্য হয়ে পড়ে গোটা গির। এখন প্রথম গ্রীষ্মের ঝাঁ ঝাঁ ৪৪ ডিগ্রিতে সব নদীর জল উবে গিয়েছে। দাবানলের চিহ্ন পথের দু’ধারের শাল-সেগুনের গুঁড়িতে। আঁকা-বাঁকা ৩০ কিলোমিটার পাথুরে রাস্তা ঘণ্টা আড়াইয়ে পার হয়ে যখন আশ্রমে পৌঁছলাম, পশু-পাখিদের খাওয়ানোর তোড়জোড় করেছেন ভরতদাসজি। আমাদের জন্য চা দিয়ে মহারাজ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ময়ূর, সম্বর আর পায়রাদের নিজে হাতে খাওয়াতে। মন্দির ঘেঁষেই বইছে ডাফরি নদী। ভরা গ্রীষ্মেও নাকি তিরতির করে ঠান্ডা জল বয় এই নদীতে। তাই আখড়া চত্বরে সন্ধ্যার আঁধার একটু গাঢ় হলেই নিয়ম করে হাজির হয় পশুরাজের দলবল। যদিও মন্দির চত্বর তো বটেই, অরণ্যের ওই গোটা অংশে দর্শনার্থীদের রাত্রিবাসে রয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা।

এই ভরতদাসজির ভোটের বন্দোবস্ত করতেই ফি ভোটে কয়েক জন বনকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে উনা থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার উজিয়ে আসেন ছয় ভোট কর্মী। শেষ পাঁচ কিলোমিটার হেঁটেই আসতে হয় তাঁদের। আশ্রম চত্বরে বানানো হয় ভোট কেন্দ্র। সকাল সকালই নিজের ভোটটি দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলেন ভরতদাস। সে পর্ব মেটার পরে প্রসাদ-টসাদ খেয়ে ফের উনার পথে পা বাড়ান কর্মীরা। ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই ব্যবস্থা। ২০০৯-র লোকসভা ভোট ও ২০০৭ ও ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটেও এ ভাবেই ভোট দিয়েছেন ভরতদাসজি।

এক জনের ভোটারের জন্য কেন এত আয়োজন?

জেলা প্রশাসনের এক কর্তার জবাব নির্বাচনী আইন বলছে, কোনও ভোটারের বাড়ি থেকে তাঁর নিকটতম বুথের সর্বাধিক দূরত্ব হতে পারে দু’কিলোমিটার। কিন্তু ভরতদাসজির আশ্রম থেকে সব চেয়ে কাছের বুথটি প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। জঙ্গলের ঠিক বাইরে সেটি। তাই কমিশনই তাঁর কাছে পৌঁছনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জুনাগড়ের জেলাশাসক অলোককুমার পাণ্ডের কথায়, তিনি কেবল কমিশনের নিয়ম পালন করছেন মাত্র। আর যাঁর মূল্যবান ভোটটির জন্য এত আয়োজন, সেই ভরতদাসজি বলেন, “এই ঘন জঙ্গলে ভোটের অধিকারটুকু ছাড়া আমার আর কী-ই বা আছে? ভাল লাগে যে, শুধু আমার জন্যই এখানে আস্ত একটা বুথ তৈরি হয়। এটাই আমার গুপ্তধন।”

কিন্তু পাঁচ বছর আগে তিনি যে প্রত্যাশা নিয়ে ভোট দিয়েছিলেন, তা কি মিটেছে? স্মিত হাসেন ভরতদাস, “আমার কোনও প্রত্যাশা নেই। আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি। নেতাদের কাজ কথা দেওয়া। তা রাখা বা না-রাখা তাঁদের দায়িত্ব। সে সব দেখার জন্য ঈশ্বর রয়েছেন। আমার দায়িত্ব শুধু ভোটটুকু দেওয়া।”

এখন তো মোবাইলেও প্রচার হয়। কোনও ফোন কল বা এসএমএস কি আপনাকে পাঠিয়েছে কোনও দল?

প্রৌঢ় ভরতদাস বলেন, “আমি লেখাপড়া শিখিনি, তাই এসএমএস পড়তে পারি না। কেবল ফোন ধরতে আর কাটতে জানি। ফোনেও কেউ তাদের প্রার্থীকে ভোট দিতে বলেনি। তবে আমি আমার পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দেব।”

ভোট দিতে জনগণকে সচেতন করতে ঢালাও প্রচার চালাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সেই প্রচারের নির্যাস হল, ‘প্রতিটি ভোটই গুরুত্বপূর্ণ।’ কিন্তু গিরে তাদের এই ব্যবস্থা সম্ভবত কমিশনের সব চেয়ে বড় প্রচার। আর ভরতদাসও বিলক্ষণ সেটা বোঝেন। সংসারে আসক্ত না-হলেও তাই নিজের ভোটটা ঠিকই দিয়ে দেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE