Advertisement
১৯ মে ২০২৪

নাই বা বসন্ত জাগ্রত হলো দ্বারে

রূপক চক্রবর্তীশীতকাল। ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?’ কিন্তু তার আগেই তো বসন্ত এসে গেল। এই শহরে, সুপর্ণা, তুমি দেখতে পাচ্ছ না, রেড রোডের সমস্ত গাছে গাছে আস্তে আস্তে জ্বলে উঠছে আগুন। ওদের নাম কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া। ওদের নাম অশোক-পলাশ। আমাদের কবি নাম দিয়েছেন। না, ভুল বললাম, গান লিখেছেন, ওরে পলাশ ওরে পলাশ, রাঙা রঙের শিখায় শিখায় দিকে দিকে আগুন জ্বলাস।

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:২৯
Share: Save:

শীতকাল। ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?’ কিন্তু তার আগেই তো বসন্ত এসে গেল। এই শহরে, সুপর্ণা, তুমি দেখতে পাচ্ছ না, রেড রোডের সমস্ত গাছে গাছে আস্তে আস্তে জ্বলে উঠছে আগুন। ওদের নাম কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া। ওদের নাম অশোক-পলাশ। আমাদের কবি নাম দিয়েছেন। না, ভুল বললাম, গান লিখেছেন, ওরে পলাশ ওরে পলাশ, রাঙা রঙের শিখায় শিখায় দিকে দিকে আগুন জ্বলাস।

কোথা থেকে, কী ভাবে যে, কোন রক্ষণভাগকে স্বন্ত্রস্ত করে বসন্ত ঢোকে, কে জানে? ও কি এল এম টেন নাকি সি আর সেভেন? না ও শুধুমাত্র আমাদের বসন্ত। এই বসন্ত নিয়ে, প্রায় এই অকাল বসন্ত নিয়ে কবে কবি লিখেছেন, ‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী, দাঁড়িয়ে আমার চোখের আগে/ রাঙালে মন সূক্ষ্ম রাগে’—উনি মান্না দে, যিনি জানেন ঋতুর গলা কোথায় লাগাতে হবে। কিন্তু শীতেই যে বসন্তের আগমন। তা কি আলেকজান্ডারের ভারত আগমন নয়? তা কি হিউ-য়েন-সাঙ বা ফা-হিউ-য়েন-এর ভারত প্রবেশ নয়! সেই কবে ওঁরা এসেছিলেন! এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।

হে পাঠক যে আপনি আরব সাগরের নোনা হাওয়া খেতে খেতে এ রচনা পড়ছেন। আর আপনার চোখ কিংবা চশমা ভিজে যাচ্ছে গুঁড়ো সমুদ্র জল-কণায়। আপনার কাছে অনুরোধ, মনে রাখবেন নিজের কাছে কিংবা নিজেকে ভুল বোঝাবেন না যে এখনও শীত নামক একটা বস্তু অথবা একটা ঋতু এ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে। আর যাবে নাই বা কেন! তার তো চলে যাওয়ারই কথা। কেন সে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকবে অপমানের! কবে আমাদের প্রিয়তম গায়ক মান্না দে গেয়ে আমাদের জানিয়েছিলেন—‘না না যেও না, ও শেষ পাতা গো, শাখায় তুমি থাকো। ছিলে তুমি, ছিলেম আমি, চিহ্নটি তার রাখো/ও না না যেও না।’

সত্যিই তো শেষ পাতাকে কেই বা যেতে দিতে চায়! কেউ চায় না। কিন্তু ও বসন্ত, অকাল বসন্ত, তুমি কোথা থেকে নিয়ে এসেছ আবীর! কোথা থেকে নিয়ে এসেছো ওই ঝাঁক ঝাঁক সুন্দরী কিশোরীকে! ওই যে বাতাসে উড়ছে আবীর, ওই তো সুন্দর কণা, ওই তো অভ্র কণা। পাঠক, আপনি যদি দয়া করে একটু বাস্তববাদী হন দেখতে পাবেন— বাজার ভরে গিয়েছে গোটা বসন্তয়। হায় রে আমাদের সেই রবিঠাকুর খ্যাত কৃষ্ণকান্তর বসন্ত নয়। যেখানে কৃষ্ণকান্তর প্রভু শেষে এসে আফসোস করছেন— বসন্তে বিদায় নিল কৃষ্ণকান্ত। এ অকাল বসন্তে লেক মার্কেট (পাঠক, আপনি নিশ্চয়ই জানেন কোথাকার কোন মার্কেট, কেন না আপনার ডান হাতের গোড়ায় একটা ইঁদুর বলে বস্তু আছে, যে আপনাকে জানিয়ে দেবে ‘গুগল’ নামক এক মহাজ্ঞানী আছেন, যে আপনাকে স-অ-ব জানিয়ে দেবে) মানিকতলা মার্কেট থেকে সর্বত্র— অকালের ফলফুলুরি— সব হাজির করে দেবে। আর বসন্তের কী কাজ? বসন্তের কাজ— বসন্ত তার গান/তার প্রাণ লিখে যায়/ধুলির পরে কী আদরে।

পাঠক, হে পাঠক, সে যখন আসে, তখন এই মাঘ মাসে বসেও বলতে হয়—‘ভালবাসা এসেছিল একদিন নিঃশব্দ চরণে।’ তাই তো, বসন্তও ‘এসেছিল একদিন নিঃশব্দ চরণে’। সত্যিই তো, যে স্বপ্ন, মনে হল তারে তুমি, যে তুমি বিজ্ঞান পড়ো, যে তুমি বিজ্ঞান পড়েছো— সে তো বলবেই— হ্যাঁ হ্যাঁ একেই তো বলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। কিন্তু, ও ভাই বিজ্ঞানী, ও ভাই পরিবেশবিদ, তোমার বাড়িতে কোনও আচমকা অতিথি আসে না! সে তো এসে পড়তেই পারে। সেই তো তোমার বসন্ত, সে ‘কালে’ কিংবা ‘অকালে’ আসছে। তাকে তুমি আহ্বান করো, আহ্বান করে বলো— ‘ও শ্যাম যখন তখন/খেলো না খেলা এমন/ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না’।

দিকে দিকে মাধুরী উড়ছে, মাধুরী মানে ওই সৌন্দর্য বা লাবণ্য, কোথাও না কোথাও যেন বাতাসে বাজছে বিসমিল্লার সানাই, সে সানাইয়ে বাজছে চৈতী আর তা থেকে হিন্দি সিনেমায় গান হয়ে উঠবে, পাঠক আপনি জানেন— ‘ঘুংঘটকি আর পে দিলওয়ারকা।’ ওই যে বালুরেখার ধার। মরুভূমি ধরে চলে যাওয়ার ধার ঘিরে ওই গান, ওই তো বসন্ত। আমাদের জীবনে কখনও কখনও কি আসেনি বসন্ত! কখনও কখনও সে বসন্ত এত কঠিন, এত কঠিনতর হয়ে দেখা দিয়েছে যে আর বলার নয়।

২৩ মার্চ ১৯৯৫। বসন্ত, ও বসন্ত তুমি নিয়ে গিয়েছিলে কাকে? শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামে সংসারে এক সন্ন্যাসীকে। না যদিও সে অকাল বসন্ত নয়। তা হলে অকাল বসন্ত কে! ওই রক্তকরবীর বিশু সর্দার, সে যে গেয়ে উঠেছিল ‘ফাগুনের নবীন আনন্দে—গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে ছন্দে/দিল তারে বনবীথি কোকিলের কলগীতি’, ওই কি অকাল বসন্তের গান! নাকি ‘ধন্যি মেয়ে’র হেমন্তবাবুর বিখ্যাত গান—‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা/ বোঝে কি আনজনে/সজনী আমি বুঝি মরেছি মনে মনে/ একে তো ফাগুন মাস দারুণ এ সময়/ লেগেছে বিষম চোট কী জানি কী হয়।’

পাঠক, চোট তো বিষম লেগেছেই। কিন্তু এ ফাগুন মাস তো নয়। ভরা মাঘ। এ তো মাঘোৎসবের দিন, এ তো মাঘোৎসবের সময়। কিন্তু সেই সময়েই অকাল বসন্ত। অকাল বসন্ত বললেই যেন মনে হয়— প্রেমের মধ্যে কারও-না-কারও উপস্থিতি। যেমন সমরেশ মজুমদার ছোটগল্প লিখেছেন—‘পুলিশের নাম বসন্ত’। ভাবা যায়! পুলিশ! যার সম্পর্কে তুষার রায়, বিখ্যাত তুষার রায় বলেছিলেন— ‘কবিকে দেখে টুপিটা খুলিস’। সেই পুলিশের নাম বসন্ত!! হতেই পারে। কিন্তু এত কিছু লিখে ফেলার পরও বলতে হবে— আমাদের এই বঙ্গে, এই বাংলায়, এই রাঢ়বঙ্গে, আমাদের এই বরেন্দ্রভূমে এসে পড়েছে অকাল বসন্ত।

পাঠক, ভোর ছ’টা, ছটা বেরিয়েছে সূর্যদেবের। আপনি আমার সঙ্গে বেরিয়ে চলুন, ওই যে প্রাচীন গিরগিটির মতো ট্রাম চলেছে শ্যামলে শ্যামল সবুজ, নীলিমায় নীল ময়দানের ওপর দিয়ে। ওই যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মাথার মতো সাদা সাদা মেঘ আকাশে। এখনও কৃষ্ণচূড়ার পাতায় ছোঁয়া লাগেনি। এখনও রাধাচূড়ার পাতায় ছোঁয়া লাগেনি। এখন বিশ্বভারতী বা শান্তিনিকেতনের বা আশ্রমবালিকার কাছে পৌঁছয়নি সেই অকালের গান, অকাল বসন্তের গান। কিন্তু এ শহরের প্রতিটা গাছ প্রতিটা বাড়ি প্রতিটা গলি প্রতিটা রাজপথে প্রতিটা মুহূর্তে পৌঁছেছে— অকাল বসন্তের খবর।

‘যেন কেশবতী কন্যা এসেছে আকাশে/তার চুল আমার চোখের পরে মুখের পরে ভাসে’। এ রকম ভাবেই তো জীবনানন্দীয় ঢঙে উত্তর দেওয়া যায়, ‘অকাল বসন্ত’ নিয়ে। কিন্ত পাঠক আপনার কাছে যদি একটা ছোট প্রশ্ন রাখি, তার উত্তর কি দেবেন আপনি?

আচ্ছা এ সব দোলাচল, হেঁয়ালি থাক। বরং সোজা কথা সোজা ভাবে বলা যাক— বসন্তের কি অকাল হয়!

সেই কবে ভাস্কর চক্রবর্তী নামে এক কবি প্রশ্ন করেছিলেন--‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা।’ দেখা যাচ্ছে সেই শীতের চেয়েও বেশি প্রশ্ন উঠছে — শীত তো প্রায় গেল গেলই। ‘বসন্ত তো প্রায় এসে গেলই সুপর্ণা’।

হে পাঠক, অকাল বসন্ত নিয়ে আমাদের এই বাংলাভাষার এক কবি লিখেছেন— আপনি যদি দয়া করে পড়েন— বাংলা মে লালে লা উড়েলা আভীর বাবু উড়েলা আভীর/এই গান চূর্ণ কলি কানে আসে/কে যে গায় কোন শতাব্দীর/কিছুই টের পাই না, শুধু বেলা হেলে/.......সারা দিন ঝরেছে, শুধু সারাদিন ঝরেছে আবীর’। সত্যিই তো বসন্ত যখন আসে, সে কেবল ঝরাতেই আসে। তার আর কোনও কাজ নেই। আর সত্যি কথা বলতে কি তার কোনও অকালও নেই। সে বসন্ত। এটাই তার সবচেয়ে বড় এবং প্রধান পরিচয়। সে এসেছে, যেন রবি ঠাকুরের ভাষায়— ‘এসেছো প্রেম, এসেছো আজ/কী মহাসমারোহে’। বসন্ত এসেছে ব্যস, সে অকাল-কাল না কাল তা নিয়ে তর্ক কীসের! কী পাঠক, ঠিক বলিনি!

আপনি আমার সঙ্গে এক মত তো! হতেই হবে। নাই বা হলো বসন্ত জাগ্রত দ্বারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rupak chakraborty mumbai anandabazar spring
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE