নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগের দিন মতিলাল নেহরু মার্গের বাড়িতে গিয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে মন্ত্রিসভার একটি সম্ভাব্য তালিকা দিয়ে এসেছিলেন। শরদ পওয়ার এবং অর্জুন সিংহের প্রচেষ্টায় জল ঢেলে নরসিংহ রাওকে প্রধানমন্ত্রী করানোর রাজনীতিতে প্রণববাবুর ভূমিকা ছিল যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। প্রণববাবুর সুপারিশের তালিকা থেকে অনেককেই মন্ত্রী করেছিলেন এই তেলুগু ব্রাহ্মণ নেতা। কিন্তু পর দিন রাষ্ট্রপতি ভবনের অশোক হলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাদ পড়ে গিয়েছিলেন খোদ প্রণববাবু।
দিল্লির দরবারে মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রহস্য-অনিশ্চয়তা, ষড়যন্ত্রের কাহিনি সুবিদিত। পরবর্তী কালে অবশ্য যখন নরসিংহ রাওয়ের কর্তৃত্ব অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ল, তখন মন্ত্রিসভায় রদবদলের সময় তিনি প্রণববাবুর সঙ্গে শুধু নয়, জিতেন্দ্র প্রসাদ, জি কে মুপানর, বিজয়ভাস্কর রেড্ডির মতো প্রবীণ নেতাদের সঙ্গেও পরামর্শ করলেন। মন্ত্রিসভা গঠনের আগে সম্ভাব্য মন্ত্রীরা তাঁদের দফতরও অনেক সময় আগাম জেনে যেতেন।
অটলবিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক স্টাইল প্রথম থেকেই ছিল আরও বেশি গণতান্ত্রিক। উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী শুধু নয়, যশোবন্ত সিংহ, মুরলীমনোহর জোশী, যশবন্ত সিন্হা, প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি ব্রজেশ মিশ্র, এমনকী প্রমোদ মহাজনের সঙ্গেও তিনি ঘরোয়া আলোচনা করতেন মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে। সর্বোপরি আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক, রাজ্জু ভাইয়া থেকে সুদর্শন তাঁরাও বিভিন্ন সময় মন্ত্রিসভা গঠনে তাঁদের মতামত বা সুপারিশ জানাতেন বাজপেয়ী-আডবাণীকে। এক বার বসুন্ধরা রাজে ও উমা ভারতীকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করা নিয়ে ব্যাপক নাটক হয়েছিল। উমা রাজি হলেও বসুন্ধরা কিছুতেই রাজ্যে যেতে রাজি ছিলেন না। আডবাণীর কাছে এসে তিনি রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করেন। আডবাণীকে সে যাত্রা বোঝাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল, কেন খাদি গ্রামোদ্যোগ মন্ত্রী হওয়ার থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর প্রয়াত সিকান্দার বখ্তকে যখন বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি তো গোসা করে প্রথম কয়েক দিন সাউথ ব্লকে আসাই বন্ধ রাখেন। তাঁর সেই বয়কট খবরের শিরোনাম হয়েছিল। তার উপর তখন ছিল শরিকি ঝামেলা। নীতীশ কুমার থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক নাটকের সাক্ষী দিল্লি দরবার।
মনমোহন সিংহ তো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে পড়েছিলেন। সনিয়া গাঁধী, আহমেদ পটেল মন্ত্রীর দফতর ঠিক করতেন। অনেক সময় মনমোহনকে জানানো হতো পরে। মুরলী দেওরাকে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী করার বিপক্ষে ছিলেন সর্দারজি। কিন্তু বাধ্য হন রাজি হতে। খুশি ছিলেন না লালুপ্রসাদ ও শিবু সোরেনের মতো চার্জশিট পাওয়া ব্যক্তিকে মন্ত্রী করতে। কিন্তু বাধ্য হয়েছিলেন মনমোহন। যতটা না জোট-সংস্কৃতির দায়, তার থেকে সনিয়ার চাপ ছিল আরও বেশি।
এ বারে নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তাঁর রাজনৈতিক স্টাইলে এক নতুন সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে দিল্লির দরবারে। আগামিকাল রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। যাঁরা নতুন মন্ত্রী হবেন, তাঁরা অনেকেই ফোন পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর। অনেকের প্রবল ইচ্ছা কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাঁরা। এমন অনেককে প্রধানমন্ত্রী ফোন করে বুঝিয়েছেন, কেন তাঁদের মন্ত্রিসভায় নিতে পারছেন না। কিন্তু ঘটনা হল, এখন যাঁরা মন্ত্রী, তাঁদের অনেকেও কিন্তু জানেন না, তাঁদের দফতর বদল হবে কি না। হলেও কোন দফতর তিনি পেতে পারেন। রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া নিজেই বলছেন, “আপনারাও যেমন জল্পনা-কল্পনা করছেন, কানাঘুষো শুনছেন, আমিও তেমন। এটি প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপার।
উনি যা বলবেন, সেই দায়িত্বই পালন করব।”
নরেন্দ্র মোদীর এই একক স্টাইলের সঙ্গে অনেকে ইন্দিরা গাঁধীর স্টাইলের তুলনা করছেন। ইন্দিরা গাঁধী অনেক সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করেছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী করে পাঠিয়েছেন শেষ মুহূর্তে।
অনেক সময় কাউকেই না জানিয়ে। মোরারজি দেশাইকে অর্থমন্ত্রী পদ থেকে সরানোও তো ছিল এক বিরাট নাটক। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের উদ্যোগ, সমাজতন্ত্রী দৃষ্টিভঙ্গির ধুয়ো তুলে দক্ষিণপন্থী মোরারজিকে সরানো হয়। কংগ্রেস নেতারা জানতেন, সেই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল ইন্দিরা বনাম সিন্ডিকেটের লড়াই।
রাজীব গাঁধীও নাটকীয় ভাবে আমলা বা মন্ত্রী রদবদল করেছেন কখনও কখনও। সাংবাদিক বৈঠকে বিদেশসচিব বদল, সংবাদসংস্থায় খবর দিয়ে মমতাকে যুব-কংগ্রেস সভাপতি করা, মন্ত্রিসভা থেকে প্রণববাবুকে বাদ দেওয়া, মাধবরাও সিন্ধিয়াকে রেলমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে বলা এ সবের মধ্যে নাটক থাকলেও রাজীবকে ঘিরেও গড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতাদের একটি বলয়। পরে রাজীবের রাজনৈতিক সঙ্কট যত বেড়েছে, ততই তাঁর স্টাইলের একক ভূমিকা খর্ব হয়েছে।
প্রমোদ মহাজন এক সময়ে বলেছিলেন, “কংগ্রেসের একটা মস্ত বড় সুবিধা হল গাঁধী পরিবার। এক জন গাঁধী সব ঠিক করে দেন। আর গোটা দলের সবাই সেটি মানেন। আমাদের দলে সেই সংস্কৃতি নেই। আমাদের দলে ৪-৫ জন মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।” অন্তত মন্ত্রিসভা গঠনের সময় অগণতান্ত্রিক হওয়াটা প্রধানমন্ত্রীর খুব দরকার। প্রমোদকে বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব করেছিলেন। কিন্তু আডবাণী ও আরএসএসের চাপে তাঁকে সরাতে বাধ্য হন বাজপেয়ী।
অনেক বছর পর আবার এক জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, যিনি মন্ত্রিসভা গঠনের সব তাস নিজের কাছেই রাখছেন। দলের সভাপতি অমিত শাহ, অরুণ জেটলি এবং মোহন ভাগবতের সঙ্গে আলোচনা করছেন বটে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক তিনিই। চাপের কাছে তাঁকে নতিস্বীকার করতে হচ্ছে না। আর দিল্লির দরবারে তাই উদ্বেগ অনেক বেশি সতীর্থ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy