Advertisement
E-Paper

মোদী একাই

মোদী সরকারের পূর্বাভাস দিয়েছিল সব বুথ-ফেরত সমীক্ষাই। কিন্তু এমন বিপুল জনাদেশ আন্দাজ করতে পারেনি প্রায় কেউই। এতটাই বিপুল যে সেই ১৯৮৪ সালের পরে এই প্রথম কোনও একটি দল নিজের জোরেই সরকার গড়ার মতো জায়গায় চলে এল। দীর্ঘ তিন দশকের জোট রাজনীতি থেকে মুক্তি পেল ভারত। জোট সরকারের সহজাত যে সীমাবদ্ধতা, সেই নীতিপঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি পেতে এ বার এক সুরে ভোট দিল গোটা দেশ।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৪ ০৩:০৯

মোদী সরকারের পূর্বাভাস দিয়েছিল সব বুথ-ফেরত সমীক্ষাই। কিন্তু এমন বিপুল জনাদেশ আন্দাজ করতে পারেনি প্রায় কেউই। এতটাই বিপুল যে সেই ১৯৮৪ সালের পরে এই প্রথম কোনও একটি দল নিজের জোরেই সরকার গড়ার মতো জায়গায় চলে এল। দীর্ঘ তিন দশকের জোট রাজনীতি থেকে মুক্তি পেল ভারত। জোট সরকারের সহজাত যে সীমাবদ্ধতা, সেই নীতিপঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি পেতে এ বার এক সুরে ভোট দিল গোটা দেশ। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিল কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোনও দলকে।

নানা শরিকের নানা মত নিয়ে গত দশ বছর সরকার চালিয়েছেন মনমোহন সিংহ। দলের বিরোধিতাও ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। সংস্কারের লক্ষ্যে যখনই পদক্ষেপ করতে গিয়েছেন, তখনই হয় শরিকরা, নয় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে পিছু টেনে ধরেছেন। জোট রাজনীতির স্বার্থে দুর্নীতির প্রশ্নেও আপস করতে হয়েছে তাঁকে। মন্ত্রিসভায় রাখতে হয়েছে শিবু সোরেনের মতো চার্জশিট প্রাপ্ত নেতাকে। জেলবন্দি লালুপ্রসাদের সাংসদ পদ যাতে খোয়া না যায়, সে জন্য অর্ডিন্যান্স পাশ করে নিন্দাও কুড়োতে হয়েছে জোট রাজনীতির প্রয়োজনেই। এ নিয়ে এক সময় প্রকাশ্যে আক্ষেপও করেছেন মনমোহন।

মোদীকে এমন আক্ষেপ করতে হবে না বলেই মনে করছেন দিল্লির রাজনীতিক শিবির। কারণ, একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাওয়ায় কোনও শরিকের উপরে নির্ভর করার প্রয়োজন তাঁর নেই। শরিকদের মন্ত্রিসভায় নিলে সেটা হবে তাঁর দাক্ষিণ্য। কিন্তু দর কষাকষি করার মতো জায়গায় কোনও শরিকই থাকবে না।

তার উপর এই বিপুল জনাদেশের পরে দল এবং সঙ্ঘ পরিবারেও মোদী-বিরোধী স্বর স্তিমিত হয়ে আসবে। আরএসএস তথা স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ যে ভাবে হিন্দুত্বের প্রশ্নে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারকে বিপাকে ফেলেছিল, মোদীর ক্ষেত্রে সেই সুযোগ খুবই কম। শরিক নির্ভরতা না-থাকা তার একটা বড় কারণ। শরিক কাঁটা বিঁধে থাকলে চাপ বাড়ানোর সুযোগ পায় সঙ্ঘ পরিবার। সঙ্ঘ নেতৃত্ব আজ সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেই চলবেন তাঁরা।

সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে মোদীকে এই স্বাধীনতা উপহার দেওয়ার পর দেশের এখন বিরাট প্রত্যাশা তাঁর কাছে। শিল্প মহল থেকে শ্রমিক সংগঠন, নাগরিক সমাজ থেকে যুব সম্প্রদায়, সকলেই আশা করছেন ইউপিএ আমলে থমকে থাকা সংস্কারের চাকা ফের গড়ানোর কাজ শুরু করবেন তিনি। জমি বিল প্রণয়ন থেকে এ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির দরজা খোলা, বহু প্রত্যাশিত এই সব কাজ অবশেষে হবে তাঁর হাত ধরে। এই প্রত্যাশার ডাকে সাড়া দিয়েছেন মোদীও। ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, আর্থিক সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেবেন তিনি। মোদীর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার ছ’মাসের মধ্যেই সংস্কারের এই সব কাজ তিনি সেরে ফেলতে চান। ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথে না গিয়ে গঠনমূলক অর্থনীতির দাওয়াই ঘোষণা করতেই তিনি বেশি আগ্রহী।

কেন্দ্রে আঞ্চলিক দলগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে এত দিন পদে পদে পস্তাতে হয়েছে দেশবাসীকে। শেষ পর্যন্ত তাঁদের জন্য সুদিনের আশা আজ উস্কে দিয়েছেন মোদী। দুপুরে ভোটচিত্র মোটের উপর স্পষ্ট হয়ে উঠতেই তিনি টুইট করেন, “ইন্ডিয়া উইনস। আচ্ছে দিন আনেওয়ালে হ্যায়।” পরে নিজের কেন্দ্র বডোদরায় বক্তৃতা দিতে গিয়েও তিনি বলেন, “সুদিন আসছে।” মোদী জানিয়েছেন, দেশের প্রতিটি মানুষের উন্নয়নই তাঁর মন্ত্র। এবং সেটা কোনও ফাঁকা বুলি নয় বলেই তাঁর দাবি।

গত দু’মাসের তীব্র চাপানউতোরের ভোট পর্ব শেষে আজ বিরোধীদের দিকেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মোদী। বডোদরায় পৌনে এক ঘণ্টার বক্তৃতায় বলেছেন, “গণতন্ত্রে কেউ কারও শত্রু নয়। সকলেই প্রতিদ্বন্দ্বী। আর ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শেষ হয়ে যায়।” মোদীর মতে ভোট শেষ, সুতরাং তিক্ততারও ইতি।

রাজধানীর রাজনীতিকরা অবশ্য বলছেন, স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসকে লোকসভায় তাদের সব চেয়ে খারাপ আসন সংখ্যায় নামিয়ে আনলেও রাজ্যসভা নিয়ে মাথাব্যথা থেকেই যাবে মোদীর। সেখানে বিজেপি এখনও সংখ্যালঘু। ফলে রাজ্যসভায় কোনও বিল পাশ করাতে গেলে বিরোধী এবং শরিকদের সমর্থন হাসিল করতেই হবে বিজেপি-কে। “তা না হলে লোকসভায় এত আসন পেয়েও রাজ্যসভায় মুখ পুড়বে দলের,” মন্তব্য এক শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতার। তাই বিরোধীদের প্রতি শান্তির বাণীর পাশাপাশি আজ জোট-ধর্মের কথা বলেছেন মোদী এবং বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ, দু’জনেই।

তা ছাড়া বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ললিতা বা নবীন পট্টনায়ক নিজেদের রাজ্যে কংগ্রেস বিরোধিতা করেই ক্ষমতায় এসেছেন। এঁরা অতীতে কোনও না কোনও সময়ে এনডিএ-র শরিক ছিলেন। ফলে তাঁদের ফের কাছে টানার চেষ্টা করা যেতেই পারে। ওই দলগুলি যদি সরকারে যোগ দিতে চায়, তা হলে তাদের পূর্ণ সম্মান দিয়ে এনডিএ-র আরও বিস্তার ঘটানোরই পক্ষপাতী বিজেপি নেতৃত্ব।

বিভিন্ন দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টার পিছনে আরও একটি উদ্দেশ্য রয়েছে বলেও জানাচ্ছে বিজেপি সূত্র। তাদের বক্তব্য, উন্নয়নের স্লোগান দিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন মোদী। গুজরাতের বিকাশ মডেল তিনি গোটা দেশে কার্যকর করবেন বলে আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন অগণিত ভারতবাসী। সেই কাজ করতে হলে রাজ্যগুলির সক্রিয় সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। মোদী নিজেই বলেছেন, কোনও রাজ্য শক্তিশালী, কোনও রাজ্য দুর্বল হলে দেশকে শক্তিশালী বলা চলে না। বিজেপি সূত্র বলছে, দেশের সব প্রান্তে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে হলে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে সমন্বয় রেখেই চলতে হবে।

বিরোধী এবং আঞ্চলিক দলগুলির প্রতি মোদীর এই মনোভাব যত দিন বজায় থাকবে, তত দিনই মঙ্গল বলে মনে করছেন বিজেপি নেতাদের একাংশও। কারণ, পৃথিবীর সব প্রান্তেই একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক সময় অহঙ্কার, অসহিষ্ণুতা এবং একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতার জন্ম দেয়। বারাক ওবামা থেকে রাজীব গাঁধী, কংগ্রেস থেকে সিপিএম ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে তৈরি হওয়া অহঙ্কার শাসককে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করেছে আম জনতার থেকে। দ্রুত জনসমর্থন হারিয়েছেন তাঁরা।

ভারতের জনগণেশ অবশ্য এই মুহূর্তে মোদীর উপরে নিরঙ্কুশ আস্থা রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। গত প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘খণ্ডিত জনাদেশ এক ধরনের নৈরাজ্য তৈরি করে। তা সাময়িক ভাবে জনপ্রিয় হতেও পারে। কিন্তু দেশের প্রয়োজন স্থায়িত্ব।’

সেই স্থায়িত্বের খোঁজেই ভারত আজ ‘আমোদীত’।

jayanta ghoshal narendra modi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy