Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

শীত, পৌষ সংক্রান্তি, স্বামীজি স্মরণ

শীতসকালে হাঁটতে হাঁটতে এই মুম্বইয়া ঠান্ডাতেও দেখি দু’ একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সেই আদি ও অকৃত্রিম মাংকি ক্যাপ বা পাতি বাংলায় যাকে বলে হনুমান টুপি, মাথায় চড়িয়ে চলেছেন। কে যে নামকরণ করেছিলেন এই বস্তুটির কে জানে—যিনিই করে থাকুন, তিনি রসিক বটে। তবে এর কার্যকারিতা অসাধারণ। মাথা, কান, গলা কোনও ফাঁফোকর দিয়েই ঠান্ডা ঢোকার উপায় নেই। ঠান্ডাকে বেমালুম ধোঁকা দিয়ে বাজিমাত হনুমান টুপির। কপাল ঠুকে বলতেই হয় জয় বজরংবলী। ছোটবেলায় গ্রামে থাকাকালীন শীত পড়ত জব্বর আর মোটামুটি অমন একখানা হনুমান টুপি প্রায় সবারই একটি মজুত থাকত। এখনও দেশ গাঁয়ের তুমুল ঠান্ডায় এই হনুমান টুপিই বাঁচিয়ে রেখেছে আম-আদমিকে।শীতসকালে হাঁটতে হাঁটতে এই মুম্বইয়া ঠান্ডাতেও দেখি দু’ একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সেই আদি ও অকৃত্রিম মাংকি ক্যাপ বা পাতি বাংলায় যাকে বলে হনুমান টুপি, মাথায় চড়িয়ে চলেছেন। কে যে নামকরণ করেছিলেন এই বস্তুটির কে জানে—যিনিই করে থাকুন, তিনি রসিক বটে। তবে এর কার্যকারিতা অসাধারণ। মাথা, কান, গলা কোনও ফাঁফোকর দিয়েই ঠান্ডা ঢোকার উপায় নেই। ঠান্ডাকে বেমালুম ধোঁকা দিয়ে বাজিমাত হনুমান টুপির। কপাল ঠুকে বলতেই হয় জয় বজরংবলী। ছোটবেলায় গ্রামে থাকাকালীন শীত পড়ত জব্বর আর মোটামুটি অমন একখানা হনুমান টুপি প্রায় সবারই একটি মজুত থাকত। এখনও দেশ গাঁয়ের তুমুল ঠান্ডায় এই হনুমান টুপিই বাঁচিয়ে রেখেছে আম-আদমিকে।

পারমিতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

অবশেষে মুম্বইতে শীত পড়ল। তা নেই নেই করে শীত-বুড়ো ডিসেম্বরের শেষে ভালই ভেলকি দেখালেন। নবী মুম্বইয়ের যেখানে থাকি, সেই বেলাপুরে ভোরবেলা জানালার কাচের শার্সি ফাঁক করলেই হিমের স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। পুব আকাশে লাল রং ধরলে যদি এই শীত আবেশ জড়ানো সকালে প্রার্তভ্রমণে বেড়িয়ে পড়া যায়, তাহলে তার চেয়ে কাঙ্ক্ষিত বোধকরি এ জগতে কিছু নেই। নতুন বছরের কুয়াশা জড়ানো নতুন সকালে যখন সূর্য তার মৃদু আলোর রশ্মিগুলোকে ছড়িয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে—পাখপাখালিরা পালক ফুলিয়ে শরীরে টেনে নিচ্ছে উষ্ণতার হোমগাছেদের পাতায় পাতায় কেমন এক শিরশিরানি—ইউক্যালিপটাসের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের গায়ে ঘুমন্ত পাহাড়পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক আড়ম্বরহীন উপাসনালয়—সব মিলিয়ে এই শীত সকাল যেন এক হাতে আঁকা ছবি। কে এই শিল্পী? তিনি সকলের অগোচরেই থেকে যান। ধরা দেন না কিছুতেই। যখন খেয়াল হয় ছবি আঁকেন আবার বেখেয়ালে সে ছবি মুছেও দেন। নিরন্তর ছুটে চলা জীবনে এই টুকরো টুকরো ছবিগুলোই বাঁচিয়ে রাখে মানুষের সংবেদী মনকে। শুরুতেই বড় বেশি দার্শনিক হয়ে পড়লুম তাই না? আসলে কী যে করি, মাঝে মাঝে লিখতে লিখতে মনটা নিজের বসে থাকে না। এই কোলাহলমুখর মনটা কোথায় যে পাড়ি দেয়......কিন্তু না, সুধিজন, এ বার মনটাকে নামিয়ে আনছি মাটির পৃথিবীতে।

শীতসকালে হাঁটতে হাঁটতে এই মুম্বইয়া ঠান্ডাতেও দেখি দু’ একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সেই আদি ও অকৃত্রিম মাংকি ক্যাপ বা পাতি বাংলায় যাকে বলে হনুমান টুপি, মাথায় চড়িয়ে চলেছেন। কে যে নামকরণ করেছিলেন এই বস্তুটির কে জানে—যিনিই করে থাকুন, তিনি রসিক বটে। তবে এর কার্যকারিতা অসাধারণ। মাথা, কান, গলা কোনও ফাঁফোকর দিয়েই ঠান্ডা ঢোকার উপায় নেই। ঠান্ডাকে বেমালুম ধোঁকা দিয়ে বাজিমাত হনুমান টুপির। কপাল ঠুকে বলতেই হয় জয় বজরংবলী। ছোটবেলায় গ্রামে থাকাকালীন শীত পড়ত জব্বর আর মোটামুটি অমন একখানা হনুমান টুপি প্রায় সবারই একটি মজুত থাকত। এখনও দেশ গাঁয়ের তুমুল ঠান্ডায় এই হনুমান টুপিই বাঁচিয়ে রেখেছে আম-আদমিকে।

শীতে হনুমান টুপির কথা উঠল আর পিঠে-পুলির কথা হবে না, তা তো হয় না। পৌষ মাস বলে কথা। নতুন চালের গন্ধ, খেজুড় গুড় পাটালি—এ সব না হলে কি বাঙালির পালা-পার্বণ জমে? তবে এখন হল গিয়ে টাইম (ম্যানেজমেন্ট) মেশিনের যুগ। এখন কি আর শিলনোড়ায় চাল বেটে, ধৈর্য ধরে চাটুতে সরুচাকলি বা পাটিসাপটা তোলার সময় আছে—যার ভেতরে আবার প্রথম দু’দিনটে ভাল উঠবে না? এখন মিক্সিতে ফটাফট চাল গুঁড়িয়ে, নন-স্টিকিং তাওয়ায় চটজলদি পাটিসাপটা। অবিশ্যি নারকেলটা সেই কুরুনিতেই কুড়িয়ে নিতে হবে। নারকেল কুড়োনোর মেশিন বাজারে এসেছে কি না জানা নেই। তা সে যাই হোক, সময় যতই এগিয়ে যাক, যতই পিত্‌জা-বার্গার বাজার দখল করুক, পিঠে-পুলি আছে সেই পিঠে-পুলিতেই—আদি ও অকৃত্রিম। মনে মনে ভাবি, স্বর্গত ঠাকুমাকে প্ল্যানচেট করে নিয়ে আসি এ সময়টায়—ঠাকুমার হাতের বড় চাটুর মাপের সরুচাকলি কিংবা সেদ্ধ পুলি আর ঝোলা গুড় কিংবা দুধ পুলি। সে অনন্য স্বাদ ভুলতে পারি কই? আর মায়ের হাতের পাটিসাপটা নারকেলের পুর দিয়ে—অসাধারণ। সেই যে ছোটবেলায় সবাই মিলে গোল হয়ে বসে পিঠের স্বাদ নেওয়া—কেউ হয়তো হেঁকে বললেন, ‘ওরে আর দুটো দেব রে?’ পিঠে-পুলি মানেই আদরের, স্নেহের আর ভালবাসার স্পর্শ। খাওয়ার সঙ্গে এই মধুর পরশটুকু জুড়ে থাকত বলেই যেন তা হয়ে উঠত তুলনাহীন।

এখন অবশ্য ব্লাডসুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরলের চক্করে পড়ে খাওয়া মাথায় উঠেছে। ডাক্তার বলছেন, ‘চিনি কম’। হাঁটাই একমাত্র দাওয়াই—সর্বরোগহর। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা দিনকে দিন কুঁড়ে হয়ে পড়ছি গ্যাজেটের চক্করে। আমাদের মডিউলার কিচেন (পায়রার খোপের মতো ফ্ল্যাটবাড়িতে এ ছাড়া উপায় কী?)—সেখানে হাত বাড়ালেই ‘বন্ধু’ মানে চাল, ডাল, তেল, নুন, হলুদ, ধনে, জিরে বা আরও যত রান্নার সামগ্রী হাতের কাছেই মজুত। নিচু হয়ে, উবু হয়ে গুঁড়ি মেরে কিচ্ছুটি খুঁজতে হবে না। আর ওই সব অঙ্গভঙ্গি করা দুষ্করও বটে (হাঁটুতে ব্যথা যে)। শিলে টিলে বাটা বা বঁটিতে তরকারি কোটা—সেও উঠে গেছে কোন কালে। পেটে চাপ টাপও পড়ে না যে সেখানে একটু মেদ হ্রাস হবে। অফিসে গেলেও সেখানে কম্পিউটারের সামনে দিনরাত ঘাড় গুঁজে বসে থাকা। কোমর থেকে পায়ের পাতা স্থির নিশ্চল—কোনও ক্রিয়া নেই তাদের। যাঁরা স্কুলে পড়ান বিশেষ করে মন্তেসরি স্কুলে তাদের কথা অবশ্য আলাদা। আমরা দুটো একটার পেছনে লেগে থেকেই অস্থির। তাঁদের ত্রিশ চল্লিশটা বাচ্চাকে (আজকাল বেশির ভাগই যেখানে হাইপার অ্যাক্টিভ) সামলোনা ‘নট এ ম্যাটার অব জোক’। তা সে যাই হোক, নিজেদের দোষেই মুটিয়ে যাচ্ছি (ইংরেজি গালভরা নাম যার ওবেসিটি), তা এগারো নম্বর মানে হাঁটা ছাড়া আর উপায় কি। পেট ঠনঠন হলেও হাঁটা বন্ধ করা চলবে না। অতএব ‘পিঠে’ খেলেও রয়েসয়ে, যাতে পেটে সয়।

সে দিক থেকে মনে হয় মরাঠিরাই ভাল আছেন, পৌষ সংক্রান্তির দিন অত সব পিঠে-পুলি বানানোর হ্যাপা নেই, স্রেফ তিল-গুল। তিল-গুল আর কিছুই ন, তিলের নাড়ু। তিল আর গুড় দিয়ে তৈরি। দাঁতের জোর থাকে তো কটর কটর চিবোও, চোয়ালের ব্যায়াম হবে। মরাঠা দেশের পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির কথা যখন উঠলই তখন হলদি কুমকুম আর ‘পতঙ্গ’ এর উল্লেখ না করে উপায় নেই। এই মুম্বই এসে অবধি মকর সংক্রান্তির সময় কত যে হলদি কুমকুমের নেমন্তন্ন পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। হলদি কুমকুম মূলত মেয়েদেরই পার্বণ এবং তাও আবার সধবা এয়ো স্ত্রীদের। যিনি নেমন্তন্ন করবেন, তিনি সধবাদের কপালে হলুদ আর কুমকুমের ফোঁটা দেবেন এবং তাঁদের প্রণাম করবেন আর সবশেষে আঁচলে দেবেন কিছু না কিছু উপহার, তা সে নিজের সঙ্গতি অনুযায়ী যেমনই হোক না কেন। তিল-লাড্ডু, হলদি কুমকুমের পর বাকি থাকে পতঙ্গ। এই পতঙ্গকে আবার পোকা টোকা বলে ভুল করবেন না যেন। এ সে রকম কিছু নয় সুধিজন, এ হল গিয়ে ঘুড়ি। হ্যাঁ হ্যাঁ আকাশে ওড়ানোর ঘুড়ি। আমাদের বাঙালিদের যেমন বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানো, তেমনই মহারাষ্ট্রে, গুজরাতে মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম পড়ে যায়। যত্র দেশে যদাচার। তা এই মরাঠা দেশে এসে মকর সংক্রান্তিতে যদি বঙ্গ সন্তানের হাতে ঘুড়ি লাটাই দেখেন তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।

তবে মকর সংক্রান্তিতে পুণ্যস্নানের কথা যদি বলতে হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে গঙ্গাসাগরই প্রথম। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগরদ্বীপে প্রতি বছরই মকর সংক্রান্তিতে স্নানে হাজার হাজার পুণ্যার্থীর সমাবেশ হয়। পুণ্যার্থী আকষর্ণে কুম্ভের পরই গঙ্গাসাগরের স্থান। গঙ্গাসাগরে স্নান করে কপিল মুনির মন্দিরে পুজো দিয়ে তবেই পুণ্যের ষোলো আনা সঞ্চয়। যদিও পুণ্যের জমাখরচের হিসেব উপরওয়ালার হাতে। আমরা তো সাধারণ মানুষ! মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরের স্নানের মাহাত্ম্যের পশ্চাতে একটি কাহিনি আছে। এখানে সেটি বলার লোভ সামলাতে পারছি না। কপিল মুনি ছিলেন শ্রীবিষ্ণুর অবতার এবং মহান সাধক। একদা সগর রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ করাকালীন সেই যজ্ঞের ঘোড়া ইন্দ্র লুুকিয়ে রাখেন কপিল মুনির আশ্রমের পিছনে। সগর রাজা তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে পাঠান ঘোড়ার সন্ধানে। অনেক সন্ধানের পর কপিল মুনির আশ্রমে যখন তারা ঘোড়াটিকে আবিষ্কার করল তখন কপিল মুনির উপরই চৌর্যবৃত্তি আরোপ করল। এই অপমান কপিল মুনি মেনে নিতে পারলেন না। মিথ্যে এই অপবাদের ফলস্বরূপ কপিল মুনির ক্রোধে ভস্মীভূত হল সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে। অবশেষে সগর রাজার পৌত্র ভগীরথের প্রার্থনায় শান্ত হন কপিল মুনি। তিনি ভগীরথকে উপদেশ দেন গঙ্গাকে মর্তে আহ্বান করার জন্য। একমাত্র গঙ্গার পুণ্য সলিলেই পাপমুক্ত হবে ভগীরথের পূর্বপুরুষেরা। কঠোর তপস্যায় বসেন ভগীরথ। ভগীরথের একাগ্রতায় ও ঐকান্তিক ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে গঙ্গা শিবের জটামুক্ত হয়ে অবতরণ করেন মর্তে। মোক্ষলাভ ঘটে রাজা সগরের ষাট হাজার পুত্রের। সেই থেকে গঙ্গা মর্তে প্রবাহিতসেই পুণ্যতিথিই ছিল এই মকর সংক্রান্তি।

মকর সংক্রান্তিতেই শুরু হয় সূর্যের উত্তরায়ণ এবং এই দিন সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে। বছরের এই সময়টি আমাদের দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত শুভ, কারণ এই সময়েই ওঠে নতুন শস্য এবং শীতের প্রাবল্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তা এই নতুন বছরে পনেরো জানুয়ারি এ বার পৌষ পার্বণ বা মকর সক্রান্তি। সুুধিজন, আমরা মুম্বইয়া বাঙালিরা তো আধা মুম্বইকর হয়েই গেছি। অতএব, পিঠে-পুলির সঙ্গে তিল-গুল বা ঘুড়ি ওড়ানোই বা বাদ থাকে কেন? লেখা শেষ করার সময় হয়ে এসেছে। তবে শেষ করার আগে নতুন বছরের শুরুতে আমাদের সকলের প্রিয় স্বামী বিবেকানন্দের কথা স্মরণ করতে চাই। আগামী বারোই জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন। তাঁর কথা না বললে এ লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। স্বামীজির পরিব্রাজক জীবনের একটি কাহিনি বলে শেষ করব, যা তাঁর জীবনে গভীর অর্থবহ। পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দরজায় দরজায় মাধুকরী অবলম্বন করে জীবন ধারণ করতেন। কিন্তু ভিতরে ছিল তাঁর জ্বলন্ত অগ্নি। গভীর ঈশ্বর উপলব্ধিই ছিল জীবনের একমাত্র ব্রত। তাই সেই লক্ষ্যে পূর্ণতা না আসায় বাস্তবিক তিনি নিজের উপর হতাশায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। সে সময় এক গুরুভ্রাতাকে তিনি লিখছেন, কী হবে এমন কাকের মতো দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষান্ন গ্রহণে? কেন গরিবের কষ্টার্জিত অন্ন ধ্বংস করব, যে অন্ন শিশুর মুখের গ্রাস জোগাবে? দরকার নেই এই ব্যর্থ জীবন ধারণে যে জীবনে ঈশ্বরলাভ হল না। তিনি স্থির করলেন অরণ্যে গিয়ে অনাহারে প্রাণ ত্যাগ কবেন। প্রবেশ করলেন তিনি এক গভীর অরণ্যে। সমস্ত দিন হেঁটে শ্রান্ত, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত স্বামীজি একটি গাছের তলায় উপবিষ্ট হলেন। মনকে শান্ত তদ্গত করলেন ভগবত্‌ চিন্তায়। কিছুক্ষণ পর তিনি দেখলেন একটি বাঘ তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। স্বামীজি ভাবলেন, আহ, এই তো ভালই হল। আমরা দু’জনেই ক্ষুধার্ত। এই দেহ এখনও পর্যন্ত সেই অনন্ত উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অতএব এর দ্বারা জগতের কোনও কল্যাণ সাধন হওয়া সম্ভব নয়। এই ভাল যে এই দেহ ওই ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ক্ষুধা নিবৃত্তি করুক। তিনি শান্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন বাঘটি ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর ওপরছিন্নভিন্ন করে দেবে এই নশ্বর দেহ। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে বাঘটি সেখান থেকে চলে গেল। স্বামীজি ভাবলেন পশুটি আবার ফিরে আসবে। কিন্তু বাঘ আর ফিরে এল না। স্বামীজি সেই রাত কাটালেন ওই অরণ্যেধ্যানে নিজের আত্মার মাধ্যমে সংযোগ হল পরমাত্মার সঙ্গে। যখন পূব আকাশে লাল রং ধরল এক অমিত শক্তি ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ করে তুলল তাঁকে। তিনি আবার পথ চললেন—চরৈবেতি। ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তত্‌ কবয়ো বদন্তি।’ হে মনুষ্যকুল, ওঠো জাগো। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গলাভ করো এবং তাঁদের কাছ থেকে আত্মজ্ঞান শিক্ষা করো। পণ্ডিতেরা বলেন, আত্মজ্ঞানের পথ ক্ষুরের তীক্ষ্নধার দিয়ে চলার মতোই কঠিন।

‘Once more awake!

For sleep it was, not death, to bring thee life

A new, and rest to lotus-eyes, for visions

Daring yet. The world in need awaits,

O Truth!

No death for thee!’

কবিতার নাম ‘To The Awakened India’ এবং কে লিখেছেন এ কবিতা, কার উদাত্ত আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে এই পংক্তিগুলির মধ্য দিয়ে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে নাতিনি বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ।

স্বামী প্রজ্ঞানন্দ কৃত অনুবাদটিও লিখে দিলাম এই সঙ্গে—

‘জাগো আরো একবার!

মৃত্যু নহে, এ যে নিদ্রা তব,

জাগরণে পুনঃ সঞ্চারিতে

নবীন জীবন, আরো উচ্চ

লক্ষ্য ধ্যান তরে প্রদানিতে

বিরাম পংকজ-আঁখি-যুগে।

হে সত্য! তোমার তরে হের

প্রতীক্ষায় আছে বিশ্বজন,

—তব মৃত্যু নাহি কদাচন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE