Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

শুধু মুম্বইকে নিয়ে মহারাষ্ট্র নয়

কখনও অচেনা ভাল লাগা গন্ধ, আনকোরা এসে বুকে ধাক্কা মারে। আরব সাগরের ঢেউ ছলকানো লোনা বাতাস মাখা মুম্বই মহানগর। যার একটা মায়াবী নাম আছে, ‘স্বপ্ননগরী’। আলোকিত বৈভব ও অন্ধকারের চাঁদোয়া ঢাকা মুম্বই।মুম্বই ও মরাঠা সম্প্রদায় নিয়ে কত কিছু জানতে ইচ্ছে করে। এই জানার আগ্রহের কিছুটা হল, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখার সুবাদে পশ্চিমমুলুকের এই রাজ্যটার ইতিহাস ভূগোল কৃষ্টি সংস্কৃতি খুঁটিয়ে জানার। ইদানীং তো, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা প্রায়শই ফরমায়েসি লেখার বরাত দিচ্ছেন— ‘আপনার ওই দিকটা সম্বন্ধে কোনও একটা বিষয় ধরে বিশেষ নিবন্ধ লিখে পাঠান আমাদের আগামী সংখ্যার বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য।’

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০১
Share: Save:

মুম্বই ও মরাঠা সম্প্রদায় নিয়ে কত কিছু জানতে ইচ্ছে করে। এই জানার আগ্রহের কিছুটা হল, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখার সুবাদে পশ্চিমমুলুকের এই রাজ্যটার ইতিহাস ভূগোল কৃষ্টি সংস্কৃতি খুঁটিয়ে জানার। ইদানীং তো, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা প্রায়শই ফরমায়েসি লেখার বরাত দিচ্ছেন— ‘আপনার ওই দিকটা সম্বন্ধে কোনও একটা বিষয় ধরে বিশেষ নিবন্ধ লিখে পাঠান আমাদের আগামী সংখ্যার বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য।’

আপাত পরবাস যাপনের খাতিরেই রাজ্যটাকে জানার আগ্রহ বেশিটাই। ওই যে, শুরুতেই বলছিলাম, একটা অচেনা আনকোরা গন্ধ, ভাল লাগা গন্ধটা। সেই গন্ধের কাছে কী আমার ঋণ ছিল কিছু? মুম্বইয়ে স্থায়ী আস্তানা খুঁজে যাই। যেখানে সৃষ্টিও থাকবে না, সম্ভাবনাও নেই কোনও বিপর্যয়ের। মগজ ভুলিয়ে দেবে ‘আমার কলকাতা’ গর্বে কাটানো যাবতীয় অতীতকে। ‘আমচি মুম্বই’। হ্যাঁ ওদের মতো সরবে না বলতে পারলেও, কানে কানে ফিসফিস। এর মাঝে কী এমন ঋণ থাকতে পারে।

পশ্চিমঘাট ও সহ্যাদ্রী পাহাড় কোলে মহারাষ্ট্র রাজ্যের লৌকিক জীবনগাথায় সংস্কৃতি ঐতিহ্য কৃষ্টি ধর্ম লোকাচার শিল্প সাহিত্য সংগীতের সুন্দর এক বনেদিয়ানার মিশেল। মহারাষ্ট্র হল একটি দ্রবকরণ পাত্র যেখানে ভিন্ন কিছু অসংগতি থাকলেও একত্র আদর্শগত ধারা ও ঐতিহ্যের মিশ্রণ। মহারাষ্ট্রের লোকসংস্কৃতি সমগ্র মরাঠা জাতির চরিত্রগঠন ও সংস্কৃতির মেরুদণ্ড একার্থে বলা যেতে পারে। এই লোকজীবন কেবলমাত্র গ্রামীণ ভাবধারা ও সংস্কৃতির মূলধন নয়, ক্রমশ আধুনিকীকরণ ও শহুরে জনজীবনকেও প্রভাবিত করে নেয়।

প্রথমেই বলতে হয় ঐতিহাসিক মরাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তথা পালক ছত্রপতি শিবাজী রাজে ভোঁসলে— যিনি সমগ্র মহারাষ্ট্রে দেবতা জ্ঞানে পূজিত হন। মরাঠা সাম্রাজ্যের স্থপতি হিসাবে তিনি ‘হিন্দাভি স্বরাজা’ অর্থাত্‌ ‘স্বাধীন হিন্দু রাজ্য’—এর মর্যাদা দেন মরাঠা রাজ্যকে। মহারাষ্ট্রের জনমানসে শিবাজী মহারাজে পূজিত হন, বন্দিত হন—

“হর হর মহাদেব

জয় ভবানী

জয়তু শিবাজী”

চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথি মরাঠি জাতির নববর্ষ। মরাঠি নববর্ষের বিশেষ উত্‌সবের নাম ‘গুঢ়ি পড়ওয়া’। নতুন বছরের শুভ সূচনায় একটি বাঁশের লাঠির ডগায় নতুন কাপড় বেঁধে তার উপর তামা বা রুপোর ঘট উপুর করে রাখা হয়। সেই ঘটে জড়ানো থাকে ফুলের মালা, আম্র পল্লব, নতুন কাপড়, নিম পাতা ও মিষ্টান্ন। সমস্ত উপাচার সমেত দণ্ডটিকে বলা হয় ‘গুঢ়ি’। ‘পরওয়া’ মানে হল পরব বা উত্‌সব। উপাচার সমেত এই সজ্জিত গুঢ়িকে মূল দরজার প্রবেশ পথে অথবা বাড়ির জানলায় স্থাপন করা হয়।

ঐতিহাসিক মতে শিবাজী মহারাজের বিজয় পতাকার প্রতীক হল এই গুঢ়ি। পৌরাণিক আখ্যানে মহাপ্রলয় শেষে এই পুণ্য দিনেই ব্রহ্মা জগত্‌ সৃষ্টিকর্মে মেতেছিলেন। তাই থেকে ‘ব্রহ্মধ্বজ’ বলা হয়। রামায়ণে বারণবধ ও চোদ্দো বছর বনবাস শেষে রামচন্দ্র এই শুভ দিনে অযোধ্যায় ফেরেন। আবার প্রকৃতিগত দিক থেকে এই উত্‌সবটির তাত্‌পর্য হল এই সময়কালেই রবিশস্য ঘরে তোলা শুরু হয়ে যায়।

সমস্ত মহারাষ্ট্র রাজ্য মোট পাঁচটি ভূখণ্ডে বিভক্ত। কোঙ্কণ, বিদর্ভ, পশ্চিম মহারাষ্ট্র, খানদেশ অর্থাত্‌ উত্তর মহারাষ্ট্র ও মরাঠাওয়ারা। ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ভাষাগত প্রবেধ থাকলেও মূলত একই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। নানান উত্‌সব লোকাচার ছাড়াও মহারাষ্ট্রের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতিও রয়েছে। কিছু লোকগান গ্রাম-মরাঠায় যথেষ্ট জনপ্রিয়।

বিশ্বায়নের যুগেও প্রাচীন কিছু সংস্কৃতি আজও মরাঠাবাসীর খুব প্রিয়। এর মধ্যে পোওয়ারা, লাবণী, গোন্ধল, ভারুড, কোলিগীত, ভজন, প্রবচন, কীর্তন, তামাশা ঝিম-ফুগরি এমন কিছু সঙ্গীত মরাঠা গ্রামীণ অঞ্চলে আজও জনমোহনকারী। সাধারণত হারমোনিয়াম, ঢোলকি, টুনটুনি বা একতারা, খঞ্জনি, হালগি অর্থাত্‌ ছোট খঞ্জনি, কাড়া, জেম ইত্যাদি বিকট শব্দের বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গানগুলি নৃত্যের মাধ্যমে গীত হয়।

মহারাষ্ট্রের অনান্য লোকগান যেমন গোন্ধল, মুরকি, সাহিরি। যেগুলি অতীতে একসময় মরাঠা জাতির জ্যত্যভিমান ছিল। ‘গোন্ধল’ হল দেবী জাগরণের গান। যেমন, ইংরাজিতে একটা চালু প্রবচন আছে ‘ম্যারেজ আর মেড ইন হেভেন।’ কিন্তু সেই বিবাহ সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ সেই মরাঠি বিবাহমণ্ডপে পেশাদার গোন্ধলরা এসে গোন্ধল পরিবেশন করবেন। এখনও মরাঠা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে, যেখানে গ্রামের অর্ধেক মানুষ ‘কীর্তন’ শুনতে ভালবাসেন তো অর্ধেক ‘তামাশা’ উপভোগ করতে। কিছু লোকগান ঈশ্বরীয় দৃষ্টিতে গীত হয়।

‘ওয়ি’ হল মরাঠি লোকগান, গ্রাম-মরাঠার মহিলারা সান্ধ্য-সংগীত হিসাবে এই গান গেয়ে থাকেন। এই গানের মাধ্যমে বিবাহিতা মহিলারা তাদের বাপের বাড়ি ও স্বামীর বাড়ির বিবরণাদি পেশ করে থাকেন।

‘সুভাষিণী’ নামে এক ধরনের বিবাহ গান মরাঠি বিবাহ উত্‌সবে প্রচলিত। বিবাহ উত্‌সবে ‘হলদি’ ও ‘গহনা’ নামক বিশেষ প্রথা চলাকালীন মহিলারা সমবেত কণ্ঠে এই সুভাষিণী গেয়ে থাকেন।

‘পালানে’ নামক এক সনাতন গান গেরস্থ মহিলাদের মধ্যে সমধিক প্রচলিত। দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকে কোলে-পিঠে নিয়ে চাপড়িয়ে ঘুমপাড়ানোর সময় ‘পালানে’ গুনগুন করে গাওয়া হয়।

‘ভালরি’ লোকগানটি একান্তই কৃষিকাজে নিযুক্ত চাষিদের শষ্য রোপণ ও ফসল তোলার সময় সমবেত স্বরে গাওয়ার রীতি। এই ভালরি বা চাষিগান পুরুষরাই গেয়ে থাকেন।

‘লাবণী’ গীত ও নৃত্য শুধুমাত্র মরাঠি মহিলারাই মঞ্চে করে থাকেন। মহারাষ্ট্রের ‘লোকসংগীত ও লোকনৃত্যের সেরা রত্ন’ হল এই লাবণী। ‘লাবণ্য’ শব্দটির মরাঠা তর্জমা করলে লাবণি। মরাঠি মহিলারা নয় গজ শাড়ি মরাঠি শৈলিতে পরিধান করে সমবেত বাদ্য যন্ত্রের মূর্ছনায় নৃত্যগীতের মাধ্যমে পরিবেশন করেন। আঠোরোশো-উনিশ শতকে রাজ্যে মরাঠা বীর সেনানীদের ক্লান্তি দূর করতে ও উজ্জীবিত করতে প্রমোদমূলক এই লোকাচার নিয়ে সমৃদ্ধ লাবণী।

মরাঠি নিজস্ব সঙ্গীত ধ্রুপদ, গোনধল, ললিতা, তুম্বরি, অভঙ্গগম, কীর্তন, ভজন ইত্যাদিও ব্যবহার হয়।

মহারাষ্ট্রের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে উপকূল অঞ্চল। এই উপকূল অঞ্চলের মত্‌স্যজীবীদের বলা হয় ‘কোলি’ সম্প্রদায়। যেহেতু কোলি সম্প্রদায় সাগর ও জেলেজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, সেহেতু মত্‌স্যজীবীদের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে কোলি নাচ। মহিলা ও পুরুষরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কখনও বা জোড়ায় কোলি নৃত্য পরিবেশন করেন। মহিলারা সাধারণত সবুজ রঙা শাড়ি ও পুরুষরা তিনকোণা বিশিষ্ট খাটো লুঙ্গি পরিধান করেন। পুরুষদের হাতে ধরা থাকে দাঁড় ও মহিলাদের ঝুড়ি। কোলি নাচে ক) নৌকা বাওয়া, খ) সাগরের ঢেউ ভাঙা, গ) জাল দিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি ভঙ্গিমাগুলি নাচের মাধ্যমে সুচারু ভাবে দেখানো হয়।

‘ডিন্ডি’ নামক এক ধরনের ধর্মীয় নৃত্য মূলত কৃষ্ণলীলা। মরাঠি গদ্য কবিতার সংমিশ্রণ ডিন্ডির মূলধন। কার্তিক মাসের একাদশী তিথিতে এই ডিন্ডি নাচ পরিবেশিত হয়। ‘ডিন্ডি’ হল ছোট ড্রামের মতো দেখতে এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র। যেটির সঙ্গে মৃদঙ্গম, বাঁশি ইত্যাদি সহকারে এই নাচ ও গান পরিবেশন করা হয়। মরাঠার ‘ভারকরি’ জনগোষ্ঠীর কাছে এই ডিন্ডি নাচ খুব জনপ্রিয়। ‘কালা’ নৃত্যও কৃষ্ণলীলার মতোই এবং ডিন্ডির সঙ্গে সামান্য পার্থক্য আছে।

‘ধানগঢ়ি গজা’ নৃত্যটি মহারাষ্ট্রের কোলাহপুর জেলার ধানগঢ় গঞ্জের লোকনাচ। গোচারণভূমিকে শ্যামলা প্রকৃতির আদর্শ পশুপালন ও গবাদি পশুদের উপযুক্ত চারণভূমি জ্ঞান করে কাব্যধর্মী একধরনের ‘অভি’ লিখিত গান নাচ করা হয়। পরমা প্রকৃতির বর্ণনা থাকে ‘অভি’ কাব্যে।

পায়ে ঘুঙুর বেঁধে, ড্রামে কাঠির বোল তুলে যখন ‘তামাশা’ শিল্পী গান ধরেন—“ইয়া বসা, মঞ্চ কী রায়া” অর্থাত্‌ এসো, বসো এবং উপভোগ করো, এটাই যেন মহারাষ্ট্রবাসীদের কাছে ‘তামাশা’ গানের এক টুকরো টুকে রাখার মতো দৃশ্য সৌকর্য। ঐতিহ্যবাহী মরাঠা লোকনৃত্যে ‘তামাশা’ হল যাত্রা অঙ্গের শৈলি। পার্সি সম্প্রদায়ের একটি নিজস্ব হাস্যরস সমৃদ্ধ নৃত্যনাট্য ছিল যা আদপে সংস্কৃত ‘প্রহশন’এর প্রভাবযুক্ত। ‘তামাশা’ শৈলিটিও মনে করা হয় সেই প্রভাব থেকেই মরাঠায় এসেছে। রামায়ণ মহাভারতের চরিত্র বা পৌরাণিক কথামালা থেকে আবৃত্তি সহকারে পেশ করা হয় তামাশা।

ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের নানান রাগ বিশেষত ইমন, পিলু, ভৈরবী প্রভৃতি তামাশায় ব্যবহৃত হয়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাম জোশীকে (১৭৬২-১৮১২) ‘তামাশা’ যাত্রাপালার পথিকৃত্‌ বলা হয়ে থাকে। পরবর্তী কালে, আরেক মরাঠি সাহিত্যিক মোরপন্থ তামাশাকে পরিমার্জন ও অশ্লীলতামুক্ত করে সমসাময়িক অন্য এক ধারায় উন্নীত করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে ‘লাবণী’ গীতবাদ্যও তামাশা থেকেই উত্‌পন্ন। এ ছাড়াও হানজি বালা, প্রভঙ্কর এঁরাও ‘লাবণী’কে নতুন উচ্চতা দিয়েছেন।

‘ঝিম্মা-ফুগরি’ নামেও এক ধরনের ঘরোয়া নৃত্যকলা মরাঠি মহিলাদের মধ্যে বেশ প্রচলিত। গণেশ জয়ন্তীর ‘মঙ্গলা-গৌরী’ ব্রত পালনের দিন মহিলারা সারা রাত ‘ঝিম্মা’ আর ‘ফুগরি’ নামে হাস্যব্যঞ্জক নৃত্যগীত করেন। ‘ঝিম্মা’ গানের সঙ্গে হাতে তালি দিয়ে মহিলারা এর ওর পেছনে লাগেন। ‘ফুগারি’ নাচে সবুজ শাড়ি চুড়িতে সালাঙ্কারা বিবাহিতা মহিলারা পরস্পরের হাত ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচেন।

‘পভাদস’ নামেও এক ধরনের নৃত্যকলা আছে যেখানে দৃশ্যত শিবাজী মহারাজের জীবনীভিত্তিক পালাগান এক নিজস্ব শৈলিতে পরিবেশিত হয়। প্রাচীন সংস্কৃতি ও মরাঠি ঐতিহ্যের বনেদিয়ানা মিশেলে ‘পভাদস’ লোকনৃত্য যথেষ্ট জনপ্রিয় মরাঠা সমাজে। আসলে সূক্ষ্ম সুনির্মল নয় এমন গ্রামীণ মরাঠা সাধারণ সম্প্রদায় নিজেদের দৈনন্দিন কঠোর পরিশ্রমী জীবনে এই সব নৃত্যগীতে সদা প্রফুল্ল থাকে।

আরও একটি লোকগাঁথা হল ‘পাওয়ারা’। এটি হল সাধারণ জীবন থেকে আহূত চিরকালীন মরাঠা কবিতা। এই কবিতাগুলির জন্ম হয় সতেরোশো শতকের শেষ দিকে। কোনও অভূতপূর্ব ঘটনা বা ঐতিহাসিক কোনও প্রতিষ্ঠিত ঘটনাবলিকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে দর্শক-শ্রোতার কাছে অপরূপ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। যা উপস্থিত সবার শরীরে মনে শিহরন তুলতে সক্ষম। পাওয়ারায় একাধারে সুরস্রষ্টা ও গায়ক, যিনি গীতিকাব্যটি পরিবেশন করেন, তাঁকে বলা হয় ‘সাহির’।

‘পওয়ারা’ নিজ চোখে দেখা বা বহুল শ্রুত কোনও বিশ্বাসজনক ঘটনা বা চরিত্রকে উপস্থাপিত করা হয়। যেমন, অতীতের একটি স্মরণীয় ‘পওয়ারা’ অগ্নিদাস বিরোচিত ‘আফজল খানচা বধ’। আরও একটি বহুল প্রচারিত ‘পওয়ারা’ তুলসীদাস লিখিত ‘চানাজি মালুসারে’। তেমনই ইয়ামাজি ভাস্কর বিরচিত অন্যতম অপর একটি পওয়ারা হল, ‘বাজি পাসলকর’। বাবা পুরন্দরকে অন্যতম ‘সাহির’ বলা হয়ে থাকে। পেশোয়া রাজত্ব কালে অনেক খ্যাতিমান ‘সাহির’ ছিলেন যেমন রাম জোশী, অনন্ত ফানদি, হোনজি বালা প্রভাকর যাঁরা প্রচুর ‘পওয়ারা’ রচনা করেছিলেন। ১৮৯১ সালে ‘ইতিহাস প্রসিদ্ধ পুরুষানচে ভা স্ত্রীয়ানচে পওয়ারে’ নামের এক সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যেখানে ষাটাধিক পওয়ারা গীতকাব্য সংকলিত হয়ে আছে। মরাঠি ফিল্মের একটি অতি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘মে শিবাজীরাজে ভোঁসলে বোলতে’— যেখানে ‘আফজল খানচা বধ’ গীতটির সুচারু ব্যবহার হয়েছে।

ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপ-ইন্সটাগ্রামের যুগেও ‘লাবণী’ বা ‘তামাশা’ ট্রুপের কোনও অনুষ্ঠান পরিবেশিত হলে আজও মরাঠিরা কিন্তু স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। সাত্ত্বিক ভাবধারার মরাঠিদের জীবনে একটা বড় অংশ আজও এই লোককথাকে মনে গেঁথে রেখেছেন।

সত্য ও শ্রেষ্ঠতার নিদর্শনই মরাঠা গৌরবকে গৌরবান্বিত করেছে। বর্তমান বৈদ্যুতিন যুগে, আন্তজাল জগত্‌, মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত যুগেও, ওই যে বললাম, মরাঠার সংস্কৃতির সৃজনশীল প্রাচীন সনাতন ঐতিহ্য আজও অম্লান রেখেছে। মরাঠা সমাজের দার্শনিক কবি দ্যাণ্বেশ্বর মহারাজ, নিজস্ব প্রজ্ঞার আলোকে তাঁর গ্রন্থে কবেই লিখে গেছিলেন—

“মাঝা মরাঠাচি বল কৌতুকে

পারি অম্রু তাতেছি পাইজা জিনকে

আইসি অক্ষরে রসিকে”

দ্যাণ্বেশ্বর মহারাজের এই মরাঠি পংক্তিটির বাংলা তর্জমা করলে এই ভাবে লেখা যায়—“আমার মরাঠা ভাষাকে শ্রদ্ধা কর/অমৃতসমধুর যেন মে/কী তীক্ষ্ম তার অক্ষরাবলী।”

জয় মহারাষ্ট্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madhuchanda mitra ghosh dream city mumbai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE