Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সাইবেরিয়ায় হাওয়া-বদলে ভারতেও উলটপুরাণ

ফাল্গুন ফুরিয়ে চৈত্র আসতে চলল। তবু শীতঘুম ভাঙল না উত্তর ভারতের! উল্টে ভরা বসন্তে বরফের সাদা চাদরে নতুন করে ঢাকল কাশ্মীর থেকে হিমাচল। আবহাওয়ার দেশজোড়া খামখেয়ালিপনার প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে কৃষিক্ষেত্রেও। শৈত্যপ্রবাহের বাড়াবাড়িতে এ বার শীতে উত্তর ভারতের মানুষ এমনিতেই যথেষ্ট নাকাল হয়েছেন।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:৩৩
Share: Save:

ফাল্গুন ফুরিয়ে চৈত্র আসতে চলল। তবু শীতঘুম ভাঙল না উত্তর ভারতের! উল্টে ভরা বসন্তে বরফের সাদা চাদরে নতুন করে ঢাকল কাশ্মীর থেকে হিমাচল। আবহাওয়ার দেশজোড়া খামখেয়ালিপনার প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে কৃষিক্ষেত্রেও।

শৈত্যপ্রবাহের বাড়াবাড়িতে এ বার শীতে উত্তর ভারতের মানুষ এমনিতেই যথেষ্ট নাকাল হয়েছেন। ভাবা গিয়েছিল, ফেব্রুয়ারির গোড়ায় শীত বিদায় নিলে ওঁদের দুর্ভোগ কাটবে। কিন্তু কোথায় কী! এই মধ্য মার্চেও বৃষ্টি হলে উত্তরপ্রদেশের কোথাও কোথাও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কোথাও বা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রিতে ঘোরাফেরা করছে! আবার বৃষ্টি কমলেও সর্বনিম্ন স্বাভাবিকের ২-৩ ডিগ্রি নীচে থাকছে।

ফলে শীতের পোশাক তুলে রাখা যাচ্ছে না। হিমাচল, উত্তরাখণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীর তো ঠান্ডায় জবুথবু। বৃহস্পতিবার তুষারপাতের পরে কাশ্মীরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্যের দু’ডিগ্রি নীচে নেমে গিয়েছে। যা কিনা স্বাভাবিকের পাঁচ ডিগ্রি কম! যার ছোঁয়ায় মার্চেও উত্তরপ্রদেশে শেষ জানুয়ারির কাঁপুনি! অকাল শীতের কামড় আলগা হবে কবে?

আবহবিদেরা বলছেন, সাইবেরিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট পশ্চিমী ঝঞ্ঝা যত দিন ইরান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে কাশ্মীরে আছড়ে পড়তে থাকবে, তত দিন উত্তর ভারতে বৃষ্টি-বরফের দাপটও থাকবে। কিন্তু পশ্চিমী ঝঞ্ঝার আগ্রাসন কবে বন্ধ হবে, হাওয়া অফিস তা আঁচ করতে পারছে না।

অর্থাৎ, আপাতত সাইবেরীয় ও ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতির উপরেই নির্ভর করছে ভারতের সামগ্রিক জলবায়ু-চিত্র। কেননা, উত্তরের কনকনে বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে পূর্ব ও পশ্চিমেও। পরিণামে মধ্য মার্চের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যা হওয়া উচিত, তা হতে পারছে না। প্রভাব পড়ছে চাষবাসে। কী রকম?

মৌসম ভবনের কৃষি-আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, রাজস্থান-হরিয়ানায় অসময়ের বৃষ্টি ও তার জেরে তাপমাত্রায় ছন্দপতনের দরুণ যথেষ্ট জমিতে সর্ষে চাষ করা যায়নি। পঞ্জাব-হরিয়ানায় আলুর ফলন মার খেয়েছে। উত্তরপ্রদেশে অনিয়মের বৃষ্টি আখের ক্ষতি করেছে। আবার মহারাষ্ট্রে শীতকালীন বৃষ্টিটা না-হওয়ায় জলাভাবে আখ-ছোলার চাষ ধাক্কা খেয়েছে। অন্য দিকে দখিনা বাতাসে টান এবং পারদের সময়োচিত ঊর্ধ্বগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব ভারতে আমগাছ থেকে মুকুল ঝরিয়ে দিচ্ছে।

আবহাওয়ার এ হেন অস্বাভাবিকতা মে মাস পর্যন্ত বজায় থাকলে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়াবে বলে আশঙ্কায় রয়েছে মৌসম ভবন। বস্তুত গত ছ’মাসে ভারতীয় আবহাওয়ার চরিত্রে বিবিধ অস্বাভাবিকতা দেখা গিয়েছে। যেমন, ভরা বর্ষাকালটায় (অগস্ট পর্যন্ত) বৃষ্টি তেমন হয়নি। তার পরে তেড়েফুঁড়ে বৃষ্টি নেমে নভেম্বরের গোড়া পর্যন্ত ভুগিয়েছে। উত্তর ভারতে বয়েছে মাত্রাতিরিক্ত শৈত্যপ্রবাহ। মাঝ ফেব্রুয়ারিতেও কাশ্মীর-হিমাচল-উত্তরাখণ্ডে চুটিয়ে বরফ পড়েছে, তাদের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশ এমনকী মধ্যপ্রদেশও ভেসেছে প্রবল বৃষ্টিতে। প্রকৃতির অস্বাভাবিকতাকে আরও প্রকট করেছে শেষ ফাল্গুনে কাশ্মীর-হিমাচলে নতুন করে তুষারপাত। তামাম উত্তরে কাঁপুনি ধরিয়ে উত্তুরে বাতাস এখনও পূর্বে এসে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে। তাতে সামুদ্রিক দখিনা বাতাস এখানকার পরিমণ্ডলে ঢুকতে পারছে না। উপরন্তু মধ্য ভারত থেকে জোলো বাতাস এসে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের আকাশ মেঘলা করে রাখছে। দুইয়ের জেরে দিনের তাপমাত্রা বাড়তে পারছে না। তাই কালবৈশাখীর অনকূল অবস্থা তৈরি হচ্ছে না।

এ সবের পিছনে কি সেই ‘দুষ্টু ছেলে’র হাত? দুষ্টু ছেলে, মানে ‘এল নিনো।’ প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জেরে বায়ুপ্রবাহের পরিবর্তন। এটি স্পেনীয় শব্দ, যার অর্থ দুষ্টু বালক। এল নিনোর প্রভাব পড়ে বিশ্ব-জলবায়ুতে। অস্ট্রেলিয়ার ব্যুরো অব মেটেরিওলজি-র বিজ্ঞানীরা বুধবার জানিয়েছেন, এল নিনো দানা বাঁধার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে। ওঁদের পূর্বাভাস, প্রশান্ত মহাসাগরের জলস্তরের তাপমাত্রা যে ভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী ক’মাসের মধ্যে এল নিনো জন্ম নিতে পারে। এবং এল নিনো সৃষ্টির অনুকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতির সুবাদেই বিশ্ব জুড়ে আবহাওয়ায় সার্বিক পরিবর্তন হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ওঁরা।

কাশ্মীরে ঘন ঘন ঝঞ্ঝা-হানায় এল নিনো-র যোগসাজস মানতে অবশ্য মৌসম ভবন নারাজ। এল নিনোয় ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষা ব্যাহত হওয়ার যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, এ দেশের আবহ-বিজ্ঞানীদের অনেকে তাতেও আমল দিচ্ছেন না। আলিপুর আবহাওয়া অফিসের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ যেমন বলেন, “এল নিনোর সঙ্গে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার সম্পর্ক নেই। বর্ষার সঙ্গেও তার সরাসরি যোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি।” গোকুলবাবুর পরিসংখ্যান, “গত ১৪টি এল নিনো-র বছরে (যে যে বছরে এল নিনো হয়েছে) আট বার বর্ষা হয়েছে স্বাভাবিকের কম। ছ’বছর এল নিনো সত্ত্বেও এ দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, এল নিনোই বর্ষা বিঘ্নিত করে এ তত্ত্ব প্রমাণসাপেক্ষ।”

সব মিলিয়ে আবহাওয়ার মতিগতি পরিবর্তনের আসল কারণটা কী, তা নিয়ে হাওয়া অফিস আঁধারেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

west bengal weather debdut ghosthakur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE