Advertisement
E-Paper

স্রষ্টাই চলে গেলেন, ‘কমন ম্যান’-এর কী হবে

ছোট্ট ক্লাসঘরে তখন পুরোদমে আঁকার ক্লাস চলছে। স্যারের বকুনিতে ছাত্ররা থরহরি কম্পমান। কারও আঁকাই পছন্দ হচ্ছে না তাঁর। হঠাৎই একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল স্যারের। খুদে শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা তুমি এঁকেছো?” সভয়ে উত্তর এল, “হ্যা।”ঁ ক্লাসের সকলকে তখন খাতা দেখিয়ে স্যার বলেছিলেন, “তোমরা দেখো, লক্ষ্মণ কী সুন্দর ছবি এঁকেছে!” ছোটবেলার ঘটনাটি আজীবন ভুলতে পারেননি ‘দ্য কমন ম্যান’ কার্টুনের স্রষ্টা পদ্মবিভূষণজয়ী ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী আর কে লক্ষ্মণ।

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০৪:৩৮

ছোট্ট ক্লাসঘরে তখন পুরোদমে আঁকার ক্লাস চলছে। স্যারের বকুনিতে ছাত্ররা থরহরি কম্পমান। কারও আঁকাই পছন্দ হচ্ছে না তাঁর। হঠাৎই একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল স্যারের। খুদে শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা তুমি এঁকেছো?” সভয়ে উত্তর এল, “হ্যা।”ঁ ক্লাসের সকলকে তখন খাতা দেখিয়ে স্যার বলেছিলেন, “তোমরা দেখো, লক্ষ্মণ কী সুন্দর ছবি এঁকেছে!” ছোটবেলার ঘটনাটি আজীবন ভুলতে পারেননি ‘দ্য কমন ম্যান’ কার্টুনের স্রষ্টা পদ্মবিভূষণজয়ী ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী আর কে লক্ষ্মণ। সে দিনের পর থেকে তাঁর কাছে ‘আঁকা’ আর ‘জীবন’ সমার্থক হয়ে গিয়েছিল যে!

সেই জীবন অবশ্য হার মানল সোমবার। পুণের হাসপাতালে মারা গেলেন ৯৪ বছরের আর কে লক্ষ্মণ। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ১৭ জানুয়ারি মূত্রে সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন লক্ষ্মণ। মঙ্গলবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হয়। শিল্পীকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার সময় হাজির ছিলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস, শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে, মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা প্রধান রাজ ঠাকরে প্রমুখ। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরও শেষ শ্রদ্ধা জানান তাঁকে। শোকপ্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।

অদ্ভুত পরিহাস!

এ সব দেখে অলক্ষে হয়তো এমনই বলছেন লক্ষ্মণ। আসলে তাঁর পাঁচ দশকেরও বেশি কর্মজীবনের বড় অংশ রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের ব্যঙ্গচিত্র আঁকতে কেটে গিয়েছিল। নিছক চটুল হাস্যরস নয়, তাঁদের নিয়ে কঠোর সমালোচনাও থাকত সেই সব ছবিতে। সেই নেতাদের কাছ থেকেই সম্মান? স্বপ্নেও ভাবতেন না শিল্পী। তবে দু’টি ঘটনায় চমকে গিয়েছিলেন লক্ষ্মণ। এর মধ্যে প্রথমটি ঘটেছিল ১৯৬২ সালে। সবেমাত্র চিন-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে ঠুকে লাগাতার ব্যঙ্গচিত্র এঁকে যাচ্ছেন লক্ষ্মণ। হঠাৎই এক দিন ফোন পেলেন নেহরুর। কোনও রাগ, ভর্ৎসনা নয়, বরং নরম সুরে নেহরু লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, “আজ সকালে আপনার আঁকা ব্যঙ্গচিত্রটি দেখে দারুণ লেগেছে। আপনার সই সমেত ওই ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে পেতে পারি কি?”

প্রায় একই ভাবে লক্ষ্মণকে বিস্মিত করেছিলেন নেহরু-কন্যা ইন্দিরা গাঁধী। তখন ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র এঁকে চলেছেন লক্ষ্মণ। তার পরেও মেলে পদ্ম সম্মান। “ভেবেছিলাম এর মধ্যে নিশ্চয়ই অন্য কোনও মানে আছে,” সাক্ষাৎকারে জানান লক্ষ্মণই।

তবে শুধু রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র নয়, কবি-সাহিত্যিকদের ছবিও আঁকতেন লক্ষ্মণ। তাঁর মধ্যে ছিলেন কবি টি এস এলিয়টও। লন্ডনে গিয়েছিলেন এলিয়টের ছবি আঁকতে। এ নিয়ে একটি গল্পও আছে। লক্ষ্মণ জানান, তাঁর ছবির জন্য ‘পোজ’ দিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এলিয়ট। লক্ষ্মণ বলেছিলেন, “ওঁর ঘুম ভাঙাতেই এক কাণ্ড! কী ভাবে ক্ষমা চাইবেন উনি, বুঝে উঠতে পারছেন না।” এমন হরেক কিসিমের গল্প ছিল লক্ষ্মণের ঝুলিতে।

দ্য কমন ম্যান

সবগুলো অবশ্য এত হাসির নয়। বিশেষত মহীশূরে হাইস্কুল পাশ করে যখন তিনি বম্বের জে জে স্কুল অব আর্টের ভর্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেন না, ভেঙে পড়েছিলেন। লক্ষ্মণকে তদানীন্তন ডিন বলেছিলেন, “আমাদের এখানে ভর্তি হতে যতটা প্রতিভা দরকার হয়, তার ছিটেফোঁটা তোমার নেই।” এমন সময়ই তাঁর পাশে দাঁড়ান সাহিত্যিক আর কে নারায়ণ। সম্পর্কে লক্ষ্মণের দাদা। ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত নারায়ণের ‘মালগুড়ি ডেজ’-এর গল্পগুলির সঙ্গে নিয়মিত ছবি আঁকতেন তিনি। পাশাপাশি চলছিল আরও কিছু স্থানীয় পত্রিকায় আঁকাআঁকির কাজ। স্নাতকের পড়াশোনাও ছাড়েননি তিনি। যা শেষ হতেই পুরোদস্তুর ব্যঙ্গচিত্রশিল্পে মন দেন লক্ষ্মণ। এক সময় কাজ করেছেন প্রয়াত শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরের সঙ্গেও। ১৯৪৭ সালে সর্বভারতীয় এক ইংরেজি দৈনিকে পাকাপাকি ভাবে যোগ দেন। আকাশচুম্বী মাইনে ৫০০ টাকা! পাঁচ দশক ধরে সেই সম্পর্ক অটুট ছিল। দিনে প্রায় দশ ঘণ্টা কাজ করতেন লক্ষ্মণ। খুঁটিনাটি খবর নজরে রাখতেন। আর কী ভাবে সেগুলিকে ব্যঙ্গচিত্রে ফুটিয়ে তোলা যায়, সে জন্য টানা কাজ চলত ‘ড্রয়িং বোর্ডে’। এমনকী গত বছর ইসরোর তৈরি মঙ্গলযানের সফল অবতরণ উপলক্ষে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন লক্ষ্মণ। ভারতের পতাকা হাতে কমন ম্যান। সামনে ঘুরন্ত পৃথিবী।

লক্ষ্মণ বলতেন, “এই কমন ম্যান যে কেউ হতে পারে।” হয়তো সে কারণেই এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চরিত্রটি। তাঁর স্রষ্টার প্রয়াণের পর এখন তাই মোক্ষম প্রশ্ন, এ বার আম আদমির কী হবে? ডোরাকাটা শার্টের নীচে সাদা ধুতি পরা সেই পাকা চুলওলা মানুষটির খোঁজ কে রাখবে?

cartoonist the common man r k laxman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy