Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
জ়িদানের দেশ থেকে

আজ থাক এক হৃদয় প্রেম, এক আকাশ রং

আঁতোয়া গ্রিজম্যানের পদাঘাতে ম্যাচটির প্রবর্তন ঘটা মাত্র ‘অ্যালে!’ চিৎকারে আমার কানে প্রায় তালা লেগে গেল! একটা ব্যাপার আগেই লক্ষ্য করেছিলাম যে, গত ছ’টা নক-আউট ম্যাচে গ্রিজম্যানের সাত গোলের পরে জনতার আলাদা শ্রদ্ধা আছে তাঁকে নিয়ে।

ছবি: রয়টার্স।

ছবি: রয়টার্স।

শ্রেয়স সরকার
প্যারিস শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৮ ০৪:১৩
Share: Save:

ওই ওরা বেরিয়েছে এ বার। এক হৃদয় প্রেম নিয়ে, ঝুপ করে নামা ঘন নীল সন্ধ্যায় উন্মুক্ত আকাশের তলায় দাঁড়াবে বলে। ফুটবল অন্তপ্রাণ ওদের দল খেলছে, যে! মুখ-চেনা, কিন্তু আমার সঙ্গে আলাপ নেই। কাল যে মুহূর্তে, স্যামুয়েল উমতিতির মাথা ছুঁয়ে বলটা বিদ্যুৎ-বেগে ঢুকে গেল নেটের মধ্যে, ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গিয়েছিলাম। তবে আমি ওদেরও দেখছিলাম। আমরা আবাসিকেরা চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলাম যখন, ওরা পরস্পরকে শান্ত ভাবে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সে এটা বেশ। সমকামীদের দিকে কেউ কদর্য দৃষ্টিতে তাকায় না। আমিও চোখ সরিয়ে নিলাম।

কাল আমি ল্যাব থেকে বাড়ি ফিরে আসতেই বাড়ির ম্যানেজারের সজোর হাঁক, ‘‘নীচে বারবিকিউ, তুমি নামছো তো? শুধু পড়াশোনা করলেই চলবে? কিছু শুনছি না।’’

আমি আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই তিনি ‘শুভ সন্ধ্যা’ বলে উধাও!

পরে নেমে দেখি এলাহি ব্যবস্থা। বাইরের চত্বরে মাংস-মাছ ঝলসানো হচ্ছে। ঢোকার মুখেই কে জানি, মুখে নীল-সাদা-লাল রং করে দিল। আমার প্রতিবেশী আমোদ হঠাৎ খপ করে হাতটা ধরে বললেন, ‘‘আজ জিতে যাবে! তোমার কী মনে হয়? বেট?’’ হাত পা নেড়ে বসে পড়লাম। শুরু হয়ে গিয়েছে!

আঁতোয়া গ্রিজম্যানের পদাঘাতে ম্যাচটির প্রবর্তন ঘটা মাত্র ‘অ্যালে!’ চিৎকারে আমার কানে প্রায় তালা লেগে গেল! একটা ব্যাপার আগেই লক্ষ্য করেছিলাম যে, গত ছ’টা নক-আউট ম্যাচে গ্রিজম্যানের সাত গোলের পরে জনতার আলাদা শ্রদ্ধা আছে তাঁকে নিয়ে। তবে ম্যাচ শুরু হওয়ার পর গ্রিজম্যান, জিহুরা প্রায় হিমশিম খাচ্ছিলেন বেলজিয়ামকে নিয়ে। প্রথম দু’মিনিটেই কেভিন দে ব্রুইন যে ভাবে নাসের শাদলিকে পেয়ে বলটা পাস করে দিচ্ছিলেন, তাতে উমতিতি না থাকলে যে কী হত! গোলকিপার হুগোর সেভ-ও অসামান্য।

‘‘ওদের আধিপত্য বেশিক্ষণ টিকবে না! ফরাসিটাই ঠিক করে বলতে পারে না। ওরা কেবল কাচ বানাতে পারে বুঝেছো!’’ বলে ওঠেন আমার পাশে বসা গিগিয়েরমো। তাঁর হাতে উঠে এসেছে বিয়ার। টোবি আল্ডারওয়ের্লড তো তখন বেলজিয়ান ওয়াল। কিছু করেও যখন কিছু হচ্ছে না, বাড়ির ম্যানেজারকে দেখি সিগারেট ধরাতে বাইরে চলে গেলেন।

হাফ-টাইমের সময়ে, আমাদের হাতে চলে এসেছে ঝলসানো মাংস আর ‘গালিয়া’ বিয়ার। কখন দেখি, ম্যানেজারের স্ত্রী, ক্রস হাতে পাশে বসে। আমার মুখ হাঁ দেখে, ম্যানেজার এগিয়ে এসে বললেন স্ত্রী গোঁড়া ক্যাথলিক, কিছু করার নেই। ও খেলার ব্যাপারেও ধার্মিক।

আমি ভাবলাম, কে নয়? মাঠ জুড়ে যাঁরা দাপাদাপি করছেন, তাঁরা? অবশেষে ৫১ মিনিটের মাথায়... ওফ্! গোওওওল!

দাঁতে দাঁত চেপে থাকা আমার প্রতিবেশীরা গান ধরলেন। ‘কন্ঠী’ বোধকরি সকলে!

এর পর যাকে বলে, ‘সাবলাইম ফুটবল’ চলল কিছু ক্ষণ, ফ্রান্সের পক্ষ থেকে। একগাদা রদবদল করেও বেলজিয়ামের কপালে শিকে ছিঁড়ল না। শেষ কয়েক মিনিট এমবাপে এমন সময় নষ্ট শুরু করলেন যে, বেলজিয়ানরা অধৈর্য হয়ে কেবল ‘হলুদ’ পেতে লাগলেন। সর্ষে ফুল তো হলুদই হয়! এঁরা সর্ষে ফুল কী, জানেন কি না জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, ‘‘উই! তুমি বুঝি ভ্যান গখের আঁকা দেখনি? তিনি তো আমাদের সর্ষে খেত ভালবাসতেন খুব!’’

ম্যাচের শেষে, উমতিতির অভাবনীয় নাচ মিলে গেল আমাদের আবাসিকদের চিৎকারে।

শুনলাম ওঁরা শঁজ়ে লিজ়ে যাবেন, বৃহৎ উদ্‌যাপনের অংশীদার হতে। আমার কলকাতা-যাত্রা শুনে আর টানাটানি করলেন না। ‘বঁ ভোয়াজ’ বলে এক আকাশ বর্ণিল শোভার তলায় মিলিয়ে গেলেন ওঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

FIFA World Cup 2018 France Belgium Celebration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE