Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কর এখনই নয়, তবু স্বস্তি কই!

বিক্ষোভ-প্রতিবাদের নামে গত শনিবার প্যারিসের কিছু রাস্তায় যা হল, এমন অনর্থক ধ্বংসের ছবি আগে কখনও দেখিনি। এই ঘৃণা শুধু পুলিশ-প্রশাসনের প্রতিই নয়, ছড়িয়ে পড়ল ‘আর্ক দ্য ত্রম্ফ’-এও। দেব-দেবীর মূর্তিতেও কোপ!

প্যারিসের রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড। ছবি: এপি

প্যারিসের রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড। ছবি: এপি

শ্রেয়স সরকার 
প্যারিস শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০৮
Share: Save:

সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম, এই সপ্তাহান্তে ফের হামলার ডাক দিয়েছে ‘ইয়েলো ভেস্ট’। তা হলে কি আরও একটা ‘ব্ল্যাক স্যাটারডে’? প্রথমে শোনা যাচ্ছিল, জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতে পারে। সেটা আপাতত হচ্ছে না। নতুন বছরে নতুন জ্বালানি-কর বসানোর কথা ভেবেছিল প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁর সরকার। আজ ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, অন্তত ছ’মাস তা স্থগিত রাখা হচ্ছে। দাম বাড়ছে না বিদ্যুৎ-গ্যাসেরও।

তবু স্বস্তি কই! প্যারিসের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধ্বংসযজ্ঞের ছবি। আজও বহু জায়গায় তেলের ডিপোয় ধর্নায় বসতে দেখা গিয়েছে মানুষকে। এ কোন ফ্রান্স! ১৯৬৮-র মে মাসে শিক্ষার্থী ও কর্মী বিদ্রোহের পরে প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে এমন হিংসা দেখা যায়নি। সে বার আগ্রাসনটা ছিল পুলিশের। এ বার উল্টোটা দেখলাম।

ফ্রান্স বরাবরই বিক্ষোভ-আন্দোলনের প্রতি সহিষ্ণু। দু’বছর এখানে আছি। চোখের সামনে বহু প্রতিবাদ দেখেছি। শ্রমিকদের বিক্ষোভ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের, আইনজীবী থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের এমনকি পুলিশি বিক্ষোভও দেখেছি। কিন্তু বিক্ষোভ-প্রতিবাদের নামে গত শনিবার প্যারিসের কিছু রাস্তায় যা হল, এমন অনর্থক ধ্বংসের ছবি আগে কখনও দেখিনি। এই ঘৃণা শুধু পুলিশ-প্রশাসনের প্রতিই নয়, ছড়িয়ে পড়ল ‘আর্ক দ্য ত্রম্ফ’-এও। দেব-দেবীর মূর্তিতেও কোপ!

তবে দেশের রাজনৈতিক মহলেরই একাংশ প্রশ্ন তুলছেন মাকরঁর উদ্দেশ্য নিয়ে। তিনিই কি সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন? না হলে, দিন পনেরোর মধ্যেই বিক্ষোভ এতখানি মারমুখী হয়ে উঠল কী করে? জ্বালানির লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনের ডাকটা এসেছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাতেই সাড়া দিয়ে মূলত ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সি কিছু মানুষ, উত্তর ও পশ্চিম ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে এসে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিলেন। ২০০৫-তেও দেশের প্রায় সব বড় শহরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দাঙ্গা। সবজেটে-হলুদ জ্যাকেট পরা প্রতিবাদীরা তাকেও ছাপিয়ে গেলেন। গোড়ায় ‘মাকরঁ দূর হটো’ ব্যানার চোখে পড়েছিল। কিন্তু ক্রমে ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি একটা অংশ যে ভাবে নেতিবাচক আচরণ করতে শুরু করলেন, সেটাই ভাবাচ্ছে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সাফল্য-চিহ্ন এবং সম্পদের প্রতীকগুলির প্রতি বিক্ষোভকারীদের একটা ঘৃণা, চূড়ান্ত ধ্বংসাত্মক মনোভাব কাজ করেছে। পর-পর তিনটে শনিবার ফ্রান্স যাঁদের রাস্তায় নামতে দেখল, তাঁদের একটা বড় অংশ সীমান্তবর্তী এবং মধ্য ফ্রান্সের দুর্বল অর্থনীতি এবং সামাজিক দুর্দশার প্রতিনিধিত্ব করে। যে কোনও কারণেই হোক, তাঁরা দেশের সমৃদ্ধ শহরগুলির দ্বারা শোষিত।

ধ্বংসচিহ্ন পাশে রেখে রবিবার সবোর্নের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার ফরাসি বান্ধবী আঙুল তুলে দেখাল, এক অদ্ভুত শৈল্পিক দেওয়াললিখন। ‘দ্য লাস্ট সাপার’-কে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। যিশু হয়েছেন দু’জন— মাকরঁ ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অতি দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেন। ফরাসি এমপি-রাও রয়েছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাঁরা ভক্ষণ করছেন গোটা একটা সভ্যতা। নীচে লেখা— ‘সম্পদ কী, তা জগৎ বিস্মৃত হলেও ফ্রান্স মনে রাখবে। প্রকৃত ধনীদের কাছে কিছুই থাকে না, কারণ তাঁরা নিজেরাই একেকটি সম্পদ।’ ভাবাল আমায়। তবে কি আমরা গণতন্ত্র কী, সেটাই বুঝিনি? প্রকৃত সম্পদকে আগলে রাখতে শিখিনি? জানি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Paris Protest Tax
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE