Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Sri Lanka Bombing

ভুল ধর্মশিক্ষা পেয়েছিল, মারা যাওয়ায় খুশি, বললেন শ্রীলঙ্কায় নাশকতার মূল চক্রীর বোন

মাধানিয়ার দাবি, গত বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁর দাদা নিজের মতো করে ইসলামের ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করেছিল।

আমপারায় জঙ্গি শিবিরের অন্দরে। ছবি: এপি।

আমপারায় জঙ্গি শিবিরের অন্দরে। ছবি: এপি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলম্বো শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ১৩:৪৮
Share: Save:

ছোট থেকেই ইসলামি ধর্মশিক্ষায় প্রবল উৎসাহ ছিল শ্রীলঙ্কা নাশকতার মূল ষড়যন্ত্রী জাহরান হাসিমের। কোরান পড়ার জন্য স্কুল ছেড়ে দিয়ে আরবি ভাষাশিক্ষাও শুরু করেছিল সে। অন্যান্য ধর্মের প্রতি ছিল তার প্রবল বিদ্বেষ। এমনকি সুফি এবং উদারপন্থী ইসলামকেও শত্রু মনে করত সে। ভাই-এর মৃতদেহ সনাক্ত করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দাদের এমনটাই জানালেন বোন মাধানিয়া। জাহরানের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত না হওয়ায় পরিবারে তাঁকে ‘একঘরে’ করে দেওয়া হয়েছিল বলেও গোয়েন্দাদের বললেন মাধানিয়া।

শুক্রবার জাহরান হাসিমের দলবল ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নিকেশ করার পরই তার ২৬ বছরের বোন মাধানিয়ার বাড়িতে সাদা পোশাকে হাজির হয় শ্রীলঙ্কা পুলিশের এক গোয়েন্দা অফিসার। মাধানিয়া ও তাঁর স্বামী শেরিফ নিয়াসকে তিনি অনুরোধ করেন জাহরান হাসিম এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সনাক্ত করার জন্য। তাঁরা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনাবেচার একটি ছোট ব্যবসা চালান বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। আমপারা শহরের কাছে যে হাসপাতালে হাসিম ও তার বাবা-মা-সন্তান সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মৃতদেহ রাখা ছিল, সেখানে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করার অনুরোধ জানানো হয় তাঁদের।

কিন্তু তখনইবেঁকে বসেন শ্রীলঙ্কা নাশকতার মূল ষড়যন্ত্রী হাসিমের বোন মাধানিয়া। গোয়েন্দাদের সামনেই নিজের স্বামী শেরিফ নিয়াসকে তিনি বলেন, ‘‘ওঁদের ছবি দেখাতে বলো। আমি মৃতদেহের ছবি দেখেই ওদের সনাক্ত করতে পারবো। হাসপাতালে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ এর পরই উপস্থিত গোয়েন্দা অফিসার তাঁকে জানান, ‘‘ওদের দেখার জন্য এটাই শেষ সুযোগ। কারণ ওঁরা সন্ত্রাসবাদী। পরে আর কোনও সুযোগ দেওয়া যাবে না।’’

শ্রীলঙ্কার আমপারায় জাহরানের ঘাঁটিতে সেনা তল্লাশি। ছবি: রয়টার্স।

সংবাদসংস্থাকে মাধানিয়া বলেন, ‘‘আমি ২০১৭ সাল থেকে জাহরানের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ, ওঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় বিষ মেশানো থাকতো। ছোটবেলা থেকেই পাড়ায় রাস্তার মোড়ে ইসলাম নিয়ে ভাল বক্তৃতা করতে পারতো জাহরান। কিন্তু সাম্প্রতিককালেসরকার, দেশের পতাকা, নির্বাচন এবং অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছিল। আমাদের পরিবারে সর্বনাশ ডেকে নিয়ে এল জাহরান।’’

আরও পড়ুন: লস্কর কি ফের জাল ছড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কায়

শুধু জাহরান নয়, সেনা অভিযানে নিকেশ হয়ে গিয়েছে তার প্রায় গোটা পরিবারই। জানা যাচ্ছে, মারা গিয়েছে জাহরানের ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, তাদের দুই শিশুসন্তান, নিখোঁজ এক ভাইয়ের স্ত্রী এবং দুই শিশুসন্তান, এক বোন, বোনের স্বামী এবং তাদের দুই শিশুসন্তান, জাফরানের নিজের দুই সন্তান এবং বাবা-মা। যারা বেঁচে গিয়েছে, তাদের মধ্যে আছে জাহরানের স্ত্রী এবং এক শিশু, এমনটাই জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা পুলিশ।

শ্রীলঙ্কার পূর্ব উপকূলে কাত্তানকুদি শহরেই থাকেন মাধানিয়া। ন্যাশনাল তৌহিত জামাতের যে মসজিদে মূল ষড়যন্ত্রী জাহরান হাসমিকে সন্ত্রাসের দীক্ষিত করা হয়েছিল, সেই মসজিদের পাশেই থাকেন মাধানিয়া আর তাঁর স্বামী শেরিফ নিয়াস। স্থানীয় মানুষদের দাবি, নির্মাণকাজের জন্য এই মসজিদ গত দু’বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছিল। মাধানিয়ার দাবি, গত বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁর দাদা নিজের মতো করে ইসলামের ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করেছিল। মাধানিয়ার কথায়, ‘‘জাহরান সব সময় অন্য ধর্মকে আক্রমণ করে কথা বলতো। নরমপন্থী মুসলিম আর সুফিদেরও ছেড়ে কথা বলতো না। সুফিদের বলতো মাদকাসক্ত। ও বিপজ্জনক দিকে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আমি আর আমার স্বামী ওর থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’’

শ্রীলঙ্কার আমপারায় জঙ্গি ঘাঁটি থেকে উদ্ধার বল বিয়ারিং, যা বাড়িয়ে দেয় বোমার কার্যকারিতা। ছবি: এপি।

জাহরানের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও নিজের বাবা-মায়ের জন্য ওই বাড়িতে খাবার পাঠাতেন মাধানিয়া। পাশের গলিতেই আরেকটি বাড়িতে থাকতেন তাঁরা । এই বাড়িতেই থাকতজাহরানও। মাধানিয়ার দাবি, বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) সবাই হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। প্রতিবেশীরা জানায় শুক্রবারও ওঁরা বাড়িতে ফেরেননি। ফোনও বন্ধ করে রেখেছিল সবাই। তার পরই ঘটে বিস্ফোরণ। আর সেই বিস্ফোরণে জাহরানের কী ভূমিকা ছিল, তাও স্পষ্ট হয় আমাদের কাছে।’’

গোয়েন্দাদের মাধানিয়া বলেছেন, পুরো পরিবারে তাঁকে এবং তাঁর স্বামীকে ‘একঘরে’ করে রাখা হত। কারণ, তাঁরা বরাবরই জাহরানের মতাদর্শের বিরোধিতা করতেন। তাঁর দাবি, ‘‘ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল ছেড়ে দেয় জাহরান। ইসলামি ধর্মশিক্ষায় উৎসাহ ছিল ওর। কোরান পড়ার জন্য আরবি ভাষায় একটি কোর্সও করে। ২০০৬ সালে একটি ইসলামিক স্টাডি সেন্টারও তৈরি করে ফেলে জাহরান। কিন্তু এই সব করতে গিয়ে ও আল্লার কাছ থেকে দূরে সরে যায়, কারণ ও ভুল লোকের কাছ থেকে ধর্মশিক্ষা পাচ্ছিল। ও আসলে মানুষ মারার শিক্ষা পেয়েছিল।’’ একই সঙ্গে মাধানিয়া পুলিশকে বলেছেন, ‘‘জাহরান যে আর নেই, এই খবরে আমি খুব খুশি।’’

আরও পড়ুন: জঙ্গি-দমন অভিযানে নিহত ১৫

তামিলনাড়ুতে জাহরান কোনও জঙ্গি প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তরে মাধানিয়া বলেছেন, ‘‘দশ বছর আগে একবার জাহরান জাপান গিয়েছিল। ওই একবারই ও বিদেশ গিয়েছিল বলে আমি জানি। ওখানকার তামিল মুসলিমদের ও ধর্মশিক্ষা দিত। কিন্তু ২০১৭ সালের পর ও বিদেশ গিয়েছিল বলে আমার মনে হয় না। কারণ ওঁর পাসপোর্ট ততদিনে চলে যায় পুলিশের হেফাজতে।’’

২০১৭ সালে সুফি মুসলিমদের সঙ্গে জাফরান একটি সংঘর্যে জড়িয়ে পড়েছিল বলেও জানিয়েছে বোন মাধানিয়া। তাঁর কথায়, ‘‘নরমপন্থী এবং উদার মুসলিমদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ওর বিরুদ্ধে ক্ষেপে গিয়েছিল অনেকে। অন্যান্যরা রেগে গিয়ে ওকে আক্রমণ করলে ও ছুটে পালায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sri Lanka Bombing Church Attack Terrorism Islam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE