আগে বিয়ে। পরে পড়াশোনা!
১৮-য় পড়তে না পড়তেই আমার মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। তার পরে উচ্চ মাধ্যমিক। দু'বছরের মধ্যেই আমার জন্ম। মেয়েদের জীবনে কোনটা আগে, কোনটা পরে, তা এক সময়ে ঠিক করে দিত সমাজ। আজও কত পরিবারে এই এক ঘটনা দেখা যায়। ১৮-য় বিয়ে হয়ে যাওয়া সেই যুবতী তো তার পর সুখেই থেকেছেন স্বামী-সংসার-সন্তানদের নিয়ে। চাইলে তিনিও তো তাঁর মেয়েকে এ ভাবেই বিয়ে দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু এখানেই ছোট্ট ছোট্ট বদলের সূত্রপাত। মা আমাকে শিখিয়েছিলেন, নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে, নিজে রোজগার না করে যেন বিয়ে না করি। মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতা প্রয়োজন। খুব ছোটবেলাতেই মায়ের এই শিক্ষা আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। সেখান থেকেই নিজের লিঙ্গের হকের জন্য লড়াই। এ ভাবেই ছোট ছোট জায়গায় শুরু হয় নারীর অধিকারের সংগ্রাম। সেই মায়ের মেয়ে কিন্তু বিয়ে করেছে অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করার পরে, কর্মক্ষেত্রে নিজের জমি শক্ত করে। আর সেই মা-ই চেয়েছিলেন, তাঁর মেয়ে অভিনয় করুক।

মা আমাকে শিখিয়েছিলেন, নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে, নিজে রোজগার না করে যেন বিয়ে না করি। ছবি: সংগৃহীত।
আজ এত ঘটা করে নারী দিবস পালন করা হয়। পাড়ায় পাড়ায় মঞ্চ বেঁধে বক্তৃতা দেওয়া হয়। বিভিন্ন সংস্থা নতুন নতুন বিজ্ঞাপন তৈরি করে। কত পণ্য আসে বাজারে। কিন্তু এই ৮ মার্চের ইতিহাসও কি আমরা জানি?
উদ্যাপন খারাপ জিনিস নয়। কিন্তু সেই উদ্যাপনের খোলস ছাড়িয়ে অণু-পরমাণু ঘেঁটে দেখলে সবটা কেমন অন্ধকার লাগে। একটি বিশেষ দিনে মেয়েদের সম্মান দেওয়ার বন্যা বয়ে যায়। এ দিকে, বাকি ৩৬৪ দিন যে অসম্মানটা পেতে হয় এত এত মহিলাকে! কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নেই, ঘরে সুরক্ষা নেই, রাস্তা বিপন্মুক্ত নয়। সারা বিশ্বের এত আন্দোলনের পরেও মানুষের মধ্যে বিবেকবোধ জেগেছে কি? কুৎসিত ঘটনার খবর আসে প্রায় রোজ। আর সে কারণেই বোধ হয় এই একটি দিন নিয়ে মাতামাতি করতে দেখলে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। যদি এতই সমান অধিকারের কথা ওঠে, তা হলে পুরুষ দিবস নিয়ে মাতামাতি হয় না কেন? তার মানে কি পুরুষেরা আগে থেকেই সম্মানিত? আলাদা করে সম্মান দেখানোর দরকার নেই? আর নারীরা সম্মানিত নয় বলেই প্রতি বছর একটি দিনে মনে করিয়ে দেওয়া? একটু দয়া দেখানো? তা-ও বলব, উদ্যাপন তো ভাল জিনিস। মেয়েরা, তোমাদের উপলক্ষেই এই উদ্যাপন, হোক না একটি দিন, তা-ও, ভাল করে আনন্দ করে নাও।
আমার গোটা জীবন খুঁটিয়ে দেখলে যদিও লিঙ্গবৈষম্যের উদাহরণ পাওয়া কঠিন। বাড়িতে ভাই ও আমার মধ্যে বৈষম্য করা হয়নি কোনও দিন। এমনকি ‘ছত্রাক’ মুক্তি পাওয়ার পর চারদিকে যখন আমার শরীর নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছিল, তখনও আমার পরিবার বিচলিত হয়নি। কারণ তারা জানত, একজন শিল্পী তাঁর মন, শরীর, আত্মা, সবই শিল্পের কাছে উৎসর্গ করেন। আসলে ছবির একটি দৃশ্যে নারীদের যৌন চাহিদাপূরণকে উদ্যাপন করা হয়েছিল বলেই এত বিতর্ক। আমার প্রশ্ন, কোনও পুরুষের বিবস্ত্র দৃশ্য অথবা সঙ্গমের চাহিদা নিয়ে কথা হলে সেটি কি ‘অস্বাভাবিক’ বলে ধরা হত সমাজে?

‘ছত্রাক’ মুক্তি পাওয়ার পর চারদিকে যখন আমার শরীর নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছিল, তখনও আমার পরিবার বিচলিত হয়নি। ছবি: সংগৃহীত।
কর্মক্ষেত্রেও আমাকে তেমন খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি। শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত, যে যে পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি (সিংহভাগই পুরুষ), তাঁরা কেউ কোনও দিন মানসিক বা শারীরিক ভাবে হেনস্থা করেননি। কিন্তু তার মানে এমন নয় যে, সবাই ভাগ্যবান। সম্প্রতি আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এক পরিচালকের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন এক অভিনেত্রী। সেই পিটিশনে সই করে লিখেছি, আমার সঙ্গে ঘটছে না মানে, আর কারও সঙ্গে ঘটছে না, তা নয়। অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, “আমার সঙ্গে তো হয়নি, তাই আমি এ সবের মধ্যে নেই।” সে ক্ষেত্রে কিন্তু অভিযোগকারিণীকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আর সেখান থেকেই মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রচেষ্টাকে অসম্মান করা হচ্ছে। ঠিক সেই সময়গুলিতেই প্রশ্ন জাগে, ‘মেয়েরা মেয়েদের শত্রু’ বাক্যটি কি পুরোটাই মিথ্যে? মেয়ে হয়ে মেয়েদের পাশে না দাঁড়ানো, ক্ষমতা পেয়ে অন্য একটি মেয়ের পথের কাঁটা হয়ে ওঠা, আর একটি মেয়ের চরিত্র হননে অংশ নেওয়া, নিজে যেমন অত্যাচারিত হয়েছে সে রকমই অন্য মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়া— এই ঘটনাগুলি তো কানে আসেই। সবই পিতৃতন্ত্রের ফসল ঠিকই, কিন্তু এই হিংসা থেকে বেরিয়ে তো আসতে হবে। নিজেরা যদি ওই বাক্যটিকে ভুল প্রমাণ না করতে পারি, তা হলে কে করবে?

যদি এতই সমান অধিকারের কথা ওঠে, তা হলে পুরুষ দিবস নিয়ে মাতামাতি হয় না কেন? ছবি: সংগৃহীত।
আবারও একটি খারাপ ঘটনা ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে সকলকে এক জায়গায় আসতে হবে। আমার পরামর্শ, একটি ফোরাম তৈরি হোক, যা মহিলাদের নিয়ে, মহিলাদের জন্য, মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত। যেখানে নির্দ্বিধায় অভিযোগ জানাতে পারবেন কলাকুশলীরা। মেয়েদের সুরক্ষা মেয়েরাই দেবে। কিন্তু যে সব কাস্টিং কাউচ দু’পক্ষের সমর্থনে হয়, সেই ঘটনাগুলিতে সকলের হাত-পা বাঁধা। কিন্তু যাঁরা ক্ষমতার কাছে হার মেনে যাচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশে আমার বলা, এক জন মহিলাও যদি ঘনিষ্ঠতার বিনিময়ে কাজের শর্ত মেনে নেয়, তা হলে সেই পুরুষ কিন্তু আরও পাঁচ জন মেয়েকে একই কুপ্রস্তাব দেবে। তাই ভয় কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে।

মেয়েরা, তোমাদের উপলক্ষেই এই উদ্যাপন, হোক না একটি দিন, তা-ও, ভাল করে আনন্দ করে নাও। ছবি: সংগৃহীত।
দুশ্চিন্তা হয়, আমরা এগোনোর বদলে পিছিয়ে যাচ্ছি না তো? ইন্ডাস্ট্রিতে পুরুষদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যদি মুখ খুলতে ভয় পায় নতুন প্রজন্মের মেয়েরা, তা হলে তো এই পেশার দিকে পা বাড়াতেই হাজার বার ভাববে তারা। এ ভাবে তো মহিলা অভিনেতা থেকে শুরু করে মহিলা কলাকুশলীদের সংখ্যা আরও কমতে থাকবে। আবারও কি আমরা সেই যুগে ফিরে যাব, যখন মেয়ে সেজে অভিনয় করতেন পুরুষেরাই? ক্যালেন্ডারের পাতা যেন উল্টোচ্ছে বিপরীত দিকে।