Advertisement
E-Paper

জল ফেলে রেখে শুয়োর ধরতে দৌড়

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই পানীয় জল ছেড়ে শুয়োর নিয়েই বেশি ব্যস্ত প্রশাসন। পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের পরিকল্পনাকে পিছনে সরিয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে শুয়োর ধরার অভিযান! উত্তরবঙ্গের তিন জেলায় যে রোগটি এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে আক্রান্তদের ৩০ শতাংশের শরীরে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ধরা পড়েছে (রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের হিসেব অনুযায়ী, জুলাইয়ে মৃত ৭১ জনের মধ্যে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস মিলেছে ২১ জনের রক্তে)।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৪ ০৩:৩৯

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই পানীয় জল ছেড়ে শুয়োর নিয়েই বেশি ব্যস্ত প্রশাসন। পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের পরিকল্পনাকে পিছনে সরিয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে শুয়োর ধরার অভিযান!

উত্তরবঙ্গের তিন জেলায় যে রোগটি এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে আক্রান্তদের ৩০ শতাংশের শরীরে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ধরা পড়েছে (রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের হিসেব অনুযায়ী, জুলাইয়ে মৃত ৭১ জনের মধ্যে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস মিলেছে ২১ জনের রক্তে)। বাকি ৭০ ভাগের দেহে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ থাকা রোগ, যার উৎস হিসেবে জলদূষণকেই দায়ী করেছেন নয়াদিল্লি ও পুণে থেকে আসা জীবাণু-বিজ্ঞানীরা। সংক্রমণ ঠেকাতে আক্রান্ত সমস্ত জায়গায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন তাঁরা।

কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস এখনও থাবা বসায়নি ঠিকই। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, উত্তরবঙ্গের কথা মাথায় রেখে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। তাই সেখানেও পরিশ্রুত জল সরবরাহের বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

কিন্তু কোথায় কী! শুয়োর ধরার তাগিদের কাছে কার্যত ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে পরিস্রুত জল জোগানের পরিকল্পনা! কারণ, এনসেফ্যালাইটিস ঠেকাতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং ‘শুয়োর হঠাও’ অভিযানের ডাক দিয়েছেন। তাই জীবাণু-বিজ্ঞানীদের পরামর্শ কার্যকর করার পরিকল্পনা আপাতত শিকেয় তুলে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং থেকে শুরু করে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা প্রশাসন নেমে পড়েছে শুয়োর হটাও অভিযানে! কর্তাদের বক্তব্য: মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ সবার আগে। তাই শুয়োর পাকড়ানোতেই এখন প্রাধান্য দিতে হবে।

কিন্তু শুয়োরই তো জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের অন্যতম বাহক! তাদের শরীরে বাসা বাঁধে ওই ভাইরাস, যা কিনা কিউলেক্স বিশনোই প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। ওই ভাইরাস-যুক্ত বিশনোই মশা কোনও মানুষকে কামড়ালে তার জাপানি এনসেফ্যালাইটিস হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। তা হলে বসতি অঞ্চলের আশপাশ থেকে শুয়োর সরানোটাও একান্ত জরুরি নয় কি?

জীবাণু-বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা: শুয়োর ও বিশনোই মশা জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের বাহক ঠিকই। তবে ওঁরা এ-ও মনে করছেন, উত্তরবঙ্গে আক্রান্তদের (ও মৃতদের) অধিকাংশের দেহে অন্য রোগ-জীবাণু হামলা চালিয়েছে, যার অন্যতম বাহক হল জল। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য: জল থেকে ছড়ানো ওই রোগটির উপসর্গও এনসেফ্যালাইটিসের মতো, এবং তার সংক্রমণের হার দ্রুততর। কারণ, এ ক্ষেত্রে মশার মতো দ্বিতীয় পর্যায়ের কোনও বাহকের দরকার পড়ছে না, পানীয় জলের সঙ্গেই জীবাণু সরাসরি মানুষের দেহে ঢুকে যাচ্ছে। “জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ছড়ানোর শর্ত হিসেবে কিউলেক্স বিশনোই মশা ও শুয়োর থাকা আবশ্যিক। কিন্তু জলবাহিত জীবাণুর আগ্রাসনের জন্য স্রেফ জল থাকলেই হল।” মন্তব্য এক জীবাণু-বিজ্ঞানীর।

অতএব উত্তরবঙ্গের যা পরিস্থিতি, তাতে এই মুহূর্তে শুয়োর ধরার তুলনায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহই বেশি জরুরি বলে মনে করছেন জীবাণু-বিজ্ঞানীরা। একই ভাবে আগামী সতর্কতা হিসেবে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গেও জলের বিষয়টির উপরে সতর্ক নজর রাখা জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবারই নবান্নে দাঁড়িয়ে রাজ্য জুড়ে ‘শুয়োর হঠানোর’ কথা বলার পরে শনিবার থেকেই জেলায় জেলায় শুয়োর ধরা অভিযান শুরু হয়েছে। পরিস্রুত পানীয় জল সর্বত্র পৌঁছচ্ছে কি না, শুয়োর ধরার হিড়িকে সেই ব্যাপারটা আড়ালে চলে গিয়েছে। সময়টা বর্ষাকাল হওয়ায় আশঙ্কাও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বর্ষার সময়ে জলবাহিত জীবাণুর ব্যপ্তি বাড়ে। যে ভাবে রোগ উত্তরবঙ্গে ছড়াচ্ছে, একই ভাবে দক্ষিণবঙ্গেও তা থাবা বসাতে পারে।

এমতাবস্থায় জীবাণু-বিজ্ঞানীদের অনেকের আক্ষেপ, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তখন শুয়োর ধরার পাশাপাশি পরিস্রুত জল সরবরাহের উপরেও তাঁর সমান বা বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। বস্তুত শোধন করা জল না-পেলে মানুষ যাতে জল ফুটিয়ে খান, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজের মুখে সে কথা বললেও অনেক কাজ হতো। এতে শুধু এনসেফ্যালাইটিস নয়, জলবাহিত যে কোনও রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ সহজ হতো।

পুণে-দিল্লির বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মেনে পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়াটা কি সরকারের উচিত ছিল না?

উত্তরবঙ্গ সফররত স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমাদেবী প্রশ্নটি শুনে রবিবার বলেন, “বিষয়টি অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে।” প্রতিমন্ত্রীর অবশ্য দাবি, ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনগুলির দৃষ্টি এ দিকে আকর্ষণ করা হয়েছে। উত্তরকন্যায় বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বৈঠকে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের (পিএইচই) আধিকারিকদের বলা হয়েছে বিভিন্ন এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে। বাসিন্দাদের জল ফুটিয়ে খেতেও বলা হয়েছে। এ নিয়ে সচেতনতা প্রচারের উদ্যোগ চলছে বলে জানান চন্দ্রিমাদেবী। বাস্তব পরিস্থিতি কেমন?

উত্তরবঙ্গের রোগ-আক্রান্ত তিন জেলায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের ছবিটা আদৌ আশাপ্রদ নয়। রোগের রমরমা সবচেয়ে বেশি যে জেলায়, সেই জলপাইগুড়ির বিভিন্ন ব্লকে বাড়ির কুয়ো বা নলকূপগুলির জলপরীক্ষার কোনও তথ্য প্রশাসনের হাতে নেই। সরকারি নলকূপ বা কুয়োর জল পরীক্ষার সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২৫% নমুনাতেই কোনও না কোনও ব্যাক্টেরিয়া মজুত! প্রশাসনিক সূত্রের খবর: জেলায় সরকারির তুলনায় বেসরকারি কুয়ো ও নলকূপের সংখ্যা বেশি। কুয়োর দূষিত জল থেকে এনসেফ্যালাইটিস সদৃশ রোগটি ছড়িয়ে থাকতে পারে বলে রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের কেউ কেউ আশঙ্কাও ব্যক্ত করছেন। অথচ ওখানে কুয়োর জল পরীক্ষার কাজে হাতই পড়েনি!

জল ফুটিয়ে খেতে হবে, প্রশাসনের তরফে তা বলা হয়নি বহু জায়গাতেই। পরিস্রুত জল নিয়ে সচেতনতা-প্রচারের দাবি সম্পর্কে প্রশ্ন তাই থেকেই যাচ্ছে।

encephalytis pig capture hog pure water
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy