E-Paper

রক্তাল্পতা বিভিন্ন রোগের উপসর্গ হতে পারে

শুধু আয়রনের অভাবেই অ্যানিমিয়া হয় না। রক্তাল্পতার পিছনে কী কী রোগ থাকতে পারে, জেনে নিন।

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৫ ০৬:৫০

ছবি: সংগৃহীত।

রক্তাল্পতা হলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা আয়রনের অভাবজনিত কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শুধু আয়রন ডেফিসিয়েন্সি থেকেই অ্যানিমিয়া হয়, এমন নয়। রক্তাল্পতা একটি উপসর্গ মাত্র। নানা রোগের কারণে অ্যানিমিয়া দেখা দিতে পারে। তাই রক্তাল্পতা ধরা পড়লে কী কী পরীক্ষা করাবেন, কোন কোন বিষয়ে সতর্ক হবেন, রইল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ।

কী কী কারণে অ্যানিমিয়াহতে পারে?

জেনারেল মেডিসিনের চিকিৎসক সুবীর মণ্ডল বলছেন, “অনেক কারণ আছে অ্যানিমিয়ার পিছনে। জেনেটিক দিক থেকে, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মধ্যে হিমোগ্লোবিনে পরিবর্তন হয়। সে ক্ষেত্রে রক্তাল্পতা দেখা দেয়।”

  • থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ রক্তাল্পতা: একই মত হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তীর। তিনি বললেন, “আমাদের দেশে আয়রন ডেফিসিয়েন্সি এখনও সিগনিফিক্যান্ট। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। সাধারণত ছোটবেলায় এই রোগনির্ণয় হয়ে যায়। এদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার যা যা উপসর্গ, সেগুলো থাকে। আর এদের পরীক্ষা করার সময়ে পেটে হাত দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে লিভার আর স্প্লিন বড় হয়। আয়রন ট্যাবলেট খেলেও এদের অবস্থার উন্নতি হয় না। তাই মানুষকে সচেতন হতে হলে একটা কমপ্লিট হিমোগ্রাম বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট করানো দরকার।” আর একটা বিষয়ও মনে রাখতে হবে যে, অনেকে থ্যালাসেমিয়ার বাহকও হতে পারে। মা ও বাবা দু’জনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তা হলে সন্তানের ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার। সেইজন্য বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর রক্তপরীক্ষা করা আবশ্যিক।
  • অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া: এ ছাড়াও অনেক কারণে অ্যানিমিয়া হতে পারে। অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ায় যেমন পুরো বোন ম্যারো ফেলিয়োর হয় অর্থাৎ শুধু লোহিত রক্তকণিকা নয়, শ্বেত রক্তকণিকা ও প্লেটলেটসও তৈরি হয় না। বড়দের এ ধরনের অ্যানিমিয়া হলে তাকে বলে অ্যাকোয়ার্ড অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া। তবে ছোট বয়সেও এই অ্যানিমিয়া হতে পারে। ডা. প্রান্তর চক্রবর্তী বললেন, “ছোটদের হলে আমরা সন্দেহ করি এটা বংশগত। তখন এটাকে আমরা বলি ইনহেরিটেড বোন ম্যারো ফেলিয়োর সিনড্রোম। এরাও মা-বাবার কাছ থেকে ওই ডিফেক্টিভ জিন পেয়েছে। এদের ক্ষেত্রে পুরো স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া আর তেমন কোনও চিকিৎসা নেই। এ রকম আরও নাম আছে, ফ্যানকোনি অ্যানিমিয়া, ডায়মন্ড ব্ল্যাকফ্যান... এগুলো বিরল রোগের মধ্যে ধরা হয়।” এই রোগ ছোটবেলাতেও ধরা পড়তে পারে, আবার পরে গিয়ে ৪০ বছর বয়সেও হতে পারে। তবে সিভিয়র কেস বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছোটবেলাতেই শনাক্ত হয়ে যায়।
  • হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া: ডা. সুবীর মণ্ডল বলছেন, “এ ক্ষেত্রে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হলেও তা বাইরে এসে ভেঙে যায়। অনেক সময়ে ভাইরাল ডিজ়িজ়ের পরে এ রকম দেখা যায়। এ ছাড়া লিম্ফোমা, লিম্ফোপলিফ্যারেটিভ ডিসঅর্ডারের মতো শরীরের ইমিউন সিস্টেমে যদি কোনও সমস্যা হয়, সে ক্ষেত্রে এই ধরনের অ্যানিমিয়া দেখা যেতে পারে।” এই অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে চিকিৎসা করা হয়। এদের কিন্তু আয়রন খেলে কোনও লাভ হবে না।
  • এ ছাড়া আর্থ্রাইটিস, অটোইমিউন ডিজ়িজ়ের মতো রোগ থাকলে তাঁদের মধ্যেও অ্যানিমিয়া দেখা যায়। একে বলা হয় অ্যানিমিয়া অব ইনফ্লামেশন। শরীরে যখন কোনও যুদ্ধ চলে, তখন শরীর ইনফেকশনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে রক্ত ঠিক ভাবে তৈরি করতে পারে না। তখন প্রাথমিক রোগের চিকিৎসা জরুরি। “এ রকমও দেখেছি যে, একজন রোগী এলেন রক্তাল্পতার সমস্যা নিয়ে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখলাম তাঁর ক্রিয়েটিনিন বেড়ে গিয়েছে, আসল সমস্যা কিডনিতে। সুতরাং অ্যানিমিয়া হল একটা উপসর্গ। তার পিছনে কোন রোগ দায়ী, সেটা দেখতে হবে। একই ভাবে আয়রন ডেফিসিয়েন্সি হলে, সেটা কেন হচ্ছে, সেটাও খুঁজে দেখতে হবে। কোলন ক্যানসার বা স্টমাক ক্যানসারেও অ্যানিমিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে,” বলে জানালেন ডা. প্রান্তর চক্রবর্তী।
  • আর একটি দিক উল্লেখ করলেন ডা. মণ্ডল, “মেয়েদের ঋতুস্রাব যদি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়, অর্থাৎ মেনোরেজিয়া হলে সতর্ক হতে হবে। তখন বলি, পিরিয়ডস শুরু হওয়ার আগে একটা ও পরে একটা রক্তপরীক্ষা করাতে হবে। এতে বোঝা যাবে কতটা মেনস্ট্রুয়াল ব্লাড লস হচ্ছে। খাদ্যনালি থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এমন সন্দেহ হলে শুরুতেই শুধু স্টুল পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানা যায়। প্রয়োজন হলে চিকিৎসকরা এন্ডোস্কোপির সাহায্য নেন।”

ছবি: সংগৃহীত।

অ্যানিমিয়া হলেই আয়রন ট্যাবলেট নয়

অ্যানিমিয়ার উপসর্গ দেখা দিলেই কারণ না বুঝে আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া যাবে না। “থ্যালাসেমিয়া রোগীদের যেহেতু রক্ত দিতে হয়, সেই রক্ত দিয়ে যে লোহা যায়, সেই লোহা বার করার জন্য ওষুধ দিতে হয়। লোহা শরীরে জমলে কিন্তু ক্ষতি হয়। সেখানে অতিরিক্ত আয়রন ট্যাবলেট খেলে আরও ক্ষতি,” সতর্ক করলেন ডা. চক্রবর্তী।

শুধুই যে আয়রনের অভাবে অ্যানিমিয়া হয়, এমন নয়। ডা. সুবীর মণ্ডল বললেন, “ফলিক অ্যাসিড বা ফোলেট ও ভিটামিন বি১২-এর অভাবজনিত কারণে রক্তাল্পতা হলে তাকে নিউট্রিশনাল অ্যানিমিয়া বলে। অনেক সময়ে এই উপাদানগুলো হয়তো শরীরে ঢুকছে, কিন্তু শরীরে ঠিকমতো তার শোষণ হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রেও এই সমস্যা দেখা যায়।”

ছবি: সংগৃহীত।

কী কী পরীক্ষা করাবেন

  • প্রয়োজনভিত্তিক বা রুটিন চেকআপে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট করা উচিত। রেড সেলের সাইজ় কেমন, সংখ্যায় কত ইত্যাদি এই টেস্টে বেরিয়ে আসবে। এতে রোগ শনাক্ত করতে সুবিধে হয়।
  • হিমোগ্লোবিন টেস্টেরও বিভিন্ন মাপকাঠি আছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিন ১৩ (জি/ডিএল) ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ১১-১২ স্বাভাবিক ধরা হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, গর্ভাবস্থায় মেয়েদের হিমোগ্লোবিন কাউন্ট যেন ১০-এর নীচে না নামে। আর একটা মাপও মনে রাখতে হবে, ৯-১২ হলে মাইল্ড অ্যানিমিয়া, ৬ থেকে ৯ হলে মডারেট অ্যানিমিয়া, আর ৬-এর কম হলে সিভিয়র অ্যানিমিয়া।
  • “হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করালে বোঝা যায়, অ্যানিমিয়া জেনেটিক কারণে হচ্ছে কি না। দরকারে বোন ম্যারো এগজ়্যামিনেশন বা বোন ম্যারো বায়পসি করার পরামর্শও দেওয়া হয়। তবে সিভিয়র অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে আগে ব্লাড ট্রান্সফিউশন করতে হয়। তার দিন ১৫ পরে পরীক্ষা বা বায়পসি করা হয়। কারণ ব্লাড ট্রান্সফিউশনে অন্যের রক্ত শরীরে ঢুকে যাওয়ায় ফলস রিডিং আসতে পারে,” বললেন ডা. সুবীর মণ্ডল। আবার ব্লাড ট্রান্সফিউশন করতে হলে তার আগে পর্যাপ্ত ব্লাড স্যাম্পল রেখে দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে সেই ব্লাড স্যাম্পল পরীক্ষা করলে অন্যান্য কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
  • অন্য দিকে, অতিরিক্ত হিমোগ্লোবিনও ভাল নয়। হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তাকে পলিসাইথেমিয়া বলে। যদি হিমোগ্লোবিন কাউন্ট বেড়ে ১৭-১৮ হয়ে যায়, তখন ব্লাড লেটিং করতে হয়, বলে জানালেন ডা. মণ্ডল। সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্ত ফেলে দিতে হয়, যা অন্য কাউকে দেওয়াও যায় না।

তাই অ্যানিমিয়া হলেই আয়রন ট্যাবলেট নয়। রক্তাল্পতা কেন হচ্ছে, সেই কারণ খুঁজে বার করে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Anemia Health Checkup Doctor's Advice

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy