ম্যাপ দেখে গাড়িটা যে বাড়ির সামনে গিয়ে থামবে, সেটি দেখে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। সামনে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের দোকান, গেটে নেই কোনও রক্ষী, সিঁড়ির পাশে একটি লিফ্টও নেই! আর যা-ই হোক, তারকা দম্পতিরা এমন জায়গায় থাকেন কি? দু’পা হেঁটে আসল বহুতলটি দেখা গেলে কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।
দোতলায় লিফ্ট থামলে বেল বাজানোর আগে চোখ টানে নামের ফলকে শেক্সপিয়রীয় ছোঁয়া। গুরুগম্ভীর কাঠের দরজা খোলে গিয়ে ছিমছাম তবে শৈল্পিক বসার ঘরে। অনুপম রায়-প্রস্মিতা পালের সংসার এমনই।

বিয়ের পর দ্বিতীয় পয়লা বৈশাখে শিল্পী দম্পতি।
চোখধাঁধানো বিলাসিতার বহর নেই ঘরে। তবে যে দেওয়ালেই চোখ আটকাবে, তার সাজ বলে দেবে শিল্পীদের বসবাস এখানে। অনুপম বলেন, ‘‘বাইরের কারও সাহায্য নিইনি, নিজেরাই বাড়ি সাজাই, যখন যেমন ইচ্ছা হয়।’’
দরজা খুললেই চোখ টানে লন্ডন স্টেশন ক্লকের ছোট সংস্করণটি। চোখ এ বার অল্প নামলে টেনে ধরবে যামিনী রায়ের পেন্টিং। কার পছন্দ সে সব? অনুপমের সহজ উত্তর, ‘‘আমার! তবে ওটা নকল।’’ শিল্প-সংস্কৃতির সব ক্ষেত্র সম্পর্কেই যে সচেতন এ সঙ্গীতকার-গায়ক, তা বুঝতে ভুল করার অবকাশ তিনি দেন না।
বিয়ের পর দ্বিতীয় পয়লা বৈশাখ। বাঙালির নিজস্ব দিন বলে কথা। তাই গানের অনুষ্ঠান এবং অফিসের কাজের মাঝেও নিজেদের জন্য কিছুটা সময় আলাদা করে বার করে নিয়েছিলেন দম্পতি। তেমনই সময়ে তাঁদের ঘরকন্নায় উঁকি দিল আনন্দবাজার ডট কম। নেটাগরিকদের নজরের বাইরে থাকতে চাওয়া যুগল কিন্তু সাজগোজ, ছবি তোলায় একেবারেই স্বচ্ছন্দ নন। তবে ক্যামেরার সামনে একে অপরের পাশে দাঁড়ালে আর জড়তা থাকে না। বইয়ের পাতা উল্টে স্ত্রীকে পড়ে শোনালেন অনুপম। আর তাতেই প্রস্মিতা হেসে বলে উঠলেন, ‘‘লোকে কী কী ভাবে প্রেম করে, আর আমরা এই ভাবে প্রেম করি!’’

অরগ্যানজ়া ও পোচামপল্লি সিকো ইক্কতের যুগলবন্দি বৈশাখের প্রথম দিনে। গরমে ফুল-পাতা আঁকা ঘিয়েরঙা হালকা শাড়িতে সেজেছেন প্রস্মিতা। সঙ্গে হলুদ ব্লাউজ়ে রংমিলান্তি। কানে উঠেছে হাতে বোনা দুল। হাতে গোলাপি এক গোছা চুড়ি। সবুজের ছোঁয়া এল অনুপমের পাঞ্জাবিতে।
‘অন্য রকম’ সেই প্রেম তাঁদের সংসারের কোণে কোণে ছড়িয়ে রয়েছে। বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালেন দম্পতি। বসার ঘরের ল্যাম্পশেডে নরম আলো। তার পাশে অনুপম-প্রস্মিতার বিয়ের দিনের ছবি। আর তারই পাশে বইয়ের আলমারি। তাতে রাখা দু’টি ছোট্ট ক্যানভাস। অনুপম বলে উঠলেন, ‘‘একটা প্রস্মিতার আঁকা। অন্যটা আমার বাবার।’’ সঙ্গীতশিল্পী প্রস্মিতা এত সুন্দর ছবিও আঁকতে পারেন? স্ত্রীর গর্বে গর্বিত অনুপম বলেন, ‘‘প্রস্মিতা তো খুব সুন্দর আঁকে। আলপনা দেয়। রঙ্গোলিও বানায়।’’

বাংলা বর্ষবরণে সুতির জামদানি কাপড়ে তৈরি ওয়ান পিস ড্রেসে সাজলেন প্রস্মিতা। আধুনিকতার মাঝেও সাবেকিয়ানার ঝলক রাখলেন গায়িকা। সঙ্গে ভারী রুপোলি রঙের কাজ করা গয়না হাতে, গলায় ও কানে। ড্রেসের সঙ্গে জুটি বাঁধল শার্ট। নীলের উপর সাদা কাজের কুর্তা-শার্টেই দেখা দিলেন অনুপম।
শিল্পী-যুগলের বাড়ি। প্রমাণ রয়েছে ঘর, জানলা, আসবাবে। বাড়িভর্তি বই, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর নির্বাচিত গল্প, দীনেশ্চন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’, আন্তন চেকভের ছোটগল্প, স্টিফেন হকিন্সের ‘আ ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম’ থেকে শুরু করে মুরাকামি, সুকুমার-শরৎ চাটুজ্জের সাহিত্য সমগ্রও।
বই পড়েই অধিকাংশ সময় কাটে অনুপমের। প্রস্মিতার কথায়, ‘‘আমার সময় কাটে ল্যাপটপের সামনে কাজ করে। ওর সময় কাটে বইয়ের সামনে। বইয়ের তাকে যে চরিত্র ফুটে উঠছে, তা পুরোটাই অনুপমের নিজের হাতে তৈরি। কাজ, পড়াশোনা ও গানের বাইরের সময়টা তোলা থাকে আমাদের আড্ডা, ঠাট্টার জন্য।’’
সঙ্গীতচর্চার সরঞ্জামের জন্য নির্দিষ্ট ঘর আছে। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’-এর জায়গা যেন। পর পর দাঁড় করানো গিটার। আছে বই। কম্পিউটার। ছোট্ট খাট। আর সেখানেই আছে সে কালের ক্যাসেটের ভান্ডার। প্রয়োজন হারিয়েছে বটে, তবে মূল্য যে হারায়নি, রাখার যত্ন বলে দেয় সে কথা। ঘরের এই কোনাটি দম্পতির দু’জনেরই সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। সেখানেও ‘দেওয়াল-ঘড়ি কাঁটায়’ শৌখিনতার ছোঁয়া লেগে আছে।

অনুপম-প্রস্মিতার সংসারের নানা কোণ
খাবারেও মিল আছে দু’জনের। পরিপাটি বাঙালি রান্না পছন্দ অনুপমের। প্রস্মিতা শুধু খেতে নয়, রান্না করতেও ভালবাসেন। অনুপম আবার পছন্দ করেন নিজের হাতে বাজার করতে। সে কালের কর্তা-গিন্নিরা শুনলে বলতেন— এ হল রাজযোটক! প্রস্মিতা বলেন, ‘‘প্রবল ব্যস্ততার মাঝেও আমরা চেষ্টা করি, যাতে খাওয়াদাওয়াটা একসঙ্গে করা যায়। ওই যে কথায় বলে, ‘ফ্যামিলি দ্যাট ইটস টুগেদার, স্টেজ় টুগেদার’।’’ যে পরিবারে সকলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন, তাঁদের সম্পর্ক অটুট থাকে।
খাওয়ার টেবিলের এলাকাটি যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এ সংসারে, তা আলাদা করে বলে দিতে হয় না শিল্পী দম্পতির। সে কাজ করে দেয় আর এক শিল্পীর কাজ। দেওয়াল জুড়ে থাকা স্যালভাদ দালির পেন্টিং স্থান পেয়েছে ঠিক সেখানেই। বড় বড় তিনটি আলো উপর থেকে তাক করে রয়েছে দালির শিল্পের দিকে। নতুন বছর উপলক্ষে বাঙালি চর্ব্যচোষ্য সাজানো হল সে আবহেই।

বছর শুরু উপলক্ষে বিশেষ সাজে সেজেছেন দম্পতি। প্রস্মিতা বেছে নিয়েছেন সাদা লালপাড় গরদের শাড়ি। খোঁপায় জুঁইয়ের মালা। সঙ্গে সোনালি কানপাশা, হাঁসুলি নেকলেস ও সাবেক চূড়। সাবেকিয়ানায় আধুনিক পরশ আনতে ব্লাউজ়ের রং হল সবুজ। স্ত্রীর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে সাজে বাঙালিয়ানা রাখলেন অনুপম। সাদা রঙের জামদানি কাজ করা পাঞ্জাবির সঙ্গে পরলেন তাঁতের ধুতি।
নজর কাড়বে দু’টি বড় ঘড়ি। একটি ভিতরের ঘরে, একটি বাইরের ঘরে। ভিনটেজ ঘড়ির বিষয়ে শৌখিন গায়ক। গৃহসজ্জায় যে বড় ভূমিকা রয়েছে আলোর, তার প্রমাণ অনুপম-প্রস্মিতার বাড়িতে স্পষ্ট। বসার ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ছিমছাম অথচ আভিজাত্যপূর্ণ ল্যাম্পশেড। ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত লম্বা জানালা দিয়ে রোদের আলো, তার সঙ্গে কৃত্রিম আলোর খেলা বসার ঘরে।

অনুপম-প্রস্মিতার বসার ঘর
গৃহ-সফর সারতেই প্রস্মিতার আপ্যায়ন, ‘‘চা খাবেন তো সবাই? দুধ চা না কি লাল?’’ পরিচারিকা কাজ সেরে বেরিয়ে গিয়েছেন সময়মতো। তাই গায়িকা নিজেই রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন চা বানাতে। সাহায্যের জন্য হাত বাড়ালে রান্নাঘরেও সাদর আমন্ত্রণ জানালেন অতিথিদের।
চা-পানের আসরের মাঝেই চোখ পড়ে যাবে ফ্রিজের গায়ে সাজানো নানা দেশের ম্যাগনেটের দিকে। সফর-প্রেম নিয়ে সন্দেহ থাকে না আর। অনুপম জানান, তিনি নতুন নতুন শহর ঘুরে দেখতে পছন্দ করেন। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরের ভিড় তাঁকে আকর্ষণ করে। প্রস্মিতার শহর ভাল লাগে, আবার পাহাড়ও-জঙ্গল-সমুদ্রও পছন্দ। দুই ইঞ্জিনিয়ার কাজের সূত্রে বেশির ভাগ সময় শহরই দেখেছেন অবশ্য। এখন যেমন অফিসের কাজে বেঙ্গালুরুতে মাঝেমধ্যেই ঝটিকা সফরে যেতে হয় প্রস্মিতাকে। আর গানের অনুষ্ঠানের সূত্রে শহর-সফরেই বেশি সময় কাটে অনুপমের।

প্রস্মিতার কথায়, ‘‘আমার সময় কাটে ল্যাপটপের সামনে কাজ করে। ওর সময় কাটে বইয়ের সামনে। বইয়ের তাকে যে চরিত্র ফুটে উঠছে, তা পুরোটাই অনুপমের নিজের হাতে তৈরি।’’
সেই সূত্রেই অনুপমের মনে পড়ে যায় তাঁর বেঙ্গালুরুর জীবনের কথা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে চাকরি শুরু। আর সেখানে পয়লা বৈশাখের এই সময়টা বেশ আনন্দে কাটত। ‘‘কলকাতায় থাকলে পয়লা বৈশাখ নিয়ে যত মাতামাতি করি, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ব্যস্ত থাকতাম বেঙ্গালুরুতে। কারণ, সেখানে নিজের বাঙালিত্ব প্রমাণের দায় ছিল অনেকটা বেশি। অফিসের বাঙালিরা ও দিন পাঞ্জাবি পরে কাজে যেতেন। আমিও যেতাম। অবাঙালিদের চোখের সামনে বাঙালি সাজে ঘুরে বেড়ানোই যেন ছিল উদ্দেশ্য। কলকাতায় তো আর সেই অস্তিত্বসঙ্কট নেই,’’ হেসে বললেন অনুপম। তবে এখন কম ব্যস্ততায় কাটে না নতুন বছরের শুরু।

‘‘কলকাতায় থাকলে পয়লা বৈশাখ নিয়ে যত মাতামাতি করি, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ব্যস্ত থাকতাম বেঙ্গালুরুতে,’’ হেসে বলেন অনুপম।
সঙ্কট না থাকলেও বাঙালিয়ানা যে তাঁদের সংসারের মজ্জায় মজ্জায়, তা অবশ্য বুঝিয়ে দেওয়া আছে দেওয়াল, বইয়ের তাক, বাড়ির কোণ, টেবিলে সাজানো খাবারেও।

মঞ্চের বাইরে প্রস্মিতা-অনুপমের জগৎ।
আর লেখাপড়ায় মন থাকা বাঙালির ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি বিশেষ প্রেমের নজির তো আছে কলিং বেলের পাশেই। ফ্ল্যাটের নম্বর ‘টু বি’। ঠিক সে নম্বরের নীচে ব্র্যাকেটে লেখা উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকের অতি-চর্চিত সেই উক্তি, ‘অর নট টু বি’। মঞ্চের বাইরের অনুপম রায়ের জগৎ এমনই!
স্বীকৃতি
অনুপম রায়ের পোশাক: কোনিল সরকার, পরমা; প্রস্মিতা পালের পোশাক: কোনিল সরকার, পরমা, ভোমরা ডিজ়াইন কো.; গয়না: অঞ্জলি জুয়েলার্স, কোনিল সরকার, পোটলি গোপাল; স্টাইলিং: কোনিল সরকার; ছবি: উপহার বিশ্বাস; ছবি সহায়তা: সায়ন মণ্ডল; রূপটান: ভাস্কর বিশ্বাস; কেশসজ্জা: সুপ্রিয়া হালদার; খাবার: সপ্তপদী