রাহুল গান্ধী এক বার বলেছিলেন, তিনি লখনউয়ে গেলে টুন্ডে কাবাব এবং গালৌটি কবাব চেখে দেখতে ভোলেন না। লখনউয়ের অতি প্রাচীন রেস্তরাঁয় বসে কবাবের টুকরো মুখে পোরা মাত্র গলে যাওয়ার যে অনুভূতি, সেটি অদ্ভুত ভাল লাগে তাঁর!
অবশ্য লখনউয়ের খাবারের ভক্ত রাহুল একা নন। দেশের বড় বড় তারকা এবং খাদ্যরসিকেরাও লখনউয়ের কাবাবের নাম শুনলে একই ভাবে জিভের জল সামলান। সেলেব শেফ রণবীর ব্রার তো বলেইছিলেন, তিনি যে রন্ধনশিল্পী হিসাবে নাম করেছেন, তার মূলে রয়েছে ওই লখনউয়ের খাবার। অওয়ধি খাবার বানানোর শিল্পের প্রেমে পড়েই শেফ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি!
এমন যার ভক্তকুল, সেই খাবার নিয়ে গর্ব না করে উপায় নেই লখনউবাসীর। তারা তা করেও। লখনউয়ের মানুষজন কায়মনে বিশ্বাস করেন লখনউয়ের চিকনকারির নকশার মতো চিকেন কবাব রান্নাতেও শিল্পের ছোঁয়া থাকে। সম্প্রতি সেই ভাবনাকেই খাতায়কলমে প্রমাণ করতে ইউনেস্কোর কাছে শংসাপত্রের দরবার করেছিল লখনউ প্রশাসন। সেই আবেদন গৃহীত হয়েছে। খাদ্যরসসিক্ত সেরা শহরের দৌড়ে ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে মনোনয়ন পেয়েছে লখনউ।
আরও পড়ুন:
ইউনেস্কোর বাছাই করা স্বাদু-শহর বা সিটি অফ গ্যাস্ট্রোনমির তালিকায় এই মুহূর্তে বিশ্বের ৫৬টি শহর রয়েছে। তার মধ্যে ভারতীয় শহর মোটে একটি। হায়দরাবাদ। লখনউ যদি দৌড়ে জেতে, তবে বিশ্বের খাদ্য মানচিত্রে হায়দরাবাদি বিরিয়ানির পাশাপাশি চিরতরে জুড়ে যাবে লখনউয়ের পরোটা-কবাবও। কিন্তু প্রশ্ন হল, লখনউ আর হায়দরাবাদ যদি ভারতের সুস্বাদু খাবারদাবারের শহর হিসাবে গণ্য হতে পারে, তবে কলকাতা কেন নয়!
খাদ্যরসে কলকাতা ওই দুই শহরের চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না। খাবারের ব্যাপারে এ শহরের নিজস্ব পরিচিতিও আছে। কিন্তু সে কথায় যাওয়ার আগে জানা দরকার ইউনেস্কোর ‘সিটি অফ গ্যাস্ট্রোনমি’ আসলে কী, কিসের ভিত্তিতেই বা এই ধরনের স্বাদু শহরের নির্বাচন করা হয়।
ইউনেস্কো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ২০০৫ সাল একটি উদ্যোগ নেয়। তারা ঠিক করে, পৃথিবীর বিভিন্ন শহরকে তার সংস্কৃতি, সাহিত্য, লোকশিল্প, খাওয়াদাওয়ার ঐতিহ্যের ভিত্তিতে বিশেষ বলে বেছে নেওয়া হবে। আর ওই ধরনের বিশেষ শহরগুলিকে নিয়ে তৈরি হবে ইউনেস্কো ক্রিয়েটিভ সিটি নেটওয়ার্ক (ইউসিসিএন)। এর মধ্যে খাবারের নিক্তিতে যে সমস্ত শহরকে বেছে নেওয়া হবে তারা স্বীকৃতি পাবে ইউনেস্কোর ‘সিটি অফ গ্যাস্ট্রোনমি’ বা স্বাদু-শহর হিসাবে।
তবে তার আগে ইউনেস্কো নির্ধারিত আট রকমের শর্তে উতরোতে হয় শহরটিকে।এই আট রকমের শর্তের মধ্যে অন্যতম হল ঐতিহ্য। ইউনেস্কো খতিয়ে দেখে শহরের ঐতিহ্যবাহী খাবার কী কী? শহরটির সংস্কৃতি সেই ঐতিহ্যবাহী খাবারদাবারকে সেলিব্রেট করে কি না। ঐতিহ্যবাহী রেস্তরাঁর রন্ধনপ্রণালীতে আদি অকৃত্রিম বৈশিষ্ট্যগুলিকে মেনে চলা হয় কি না। আর সর্বোপরি আধুনিকতার দাপটে কতটা টিকিয়ে রাখা গিয়েছে খাওয়াদাওয়ার পুরনো রীতি-রেওয়াজ। কলকাতায় এই সব শর্ত পূরণকারী খাবারের কমতি নেই।
মিষ্টি
কথায় আছে শেষ ভাল যার, সব ভাল। শেষ পাতে খাওয়া মিষ্টির গুরুত্ব সেখানেই স্পষ্ট হয়ে যায়। আর কলকাতা সেই মিষ্টির তীর্থক্ষেত্র। বাকি দুনিয়া ময়দা, ক্ষীর, দুধ, ক্রিম, চিজ় দিয়ে যা-ই বানাক, বাংলার টাটকা ছানার হালকা তুলতুলে মিষ্টি তাদের ধরে ধরে দশ গোল দেবে। রসগোল্লা হোক বা চমচম, ল্যাংচা-পান্তুয়া বা মিষ্টি দই— বাঙালি মিষ্টি চেখে দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন ভিন্রাজ্যবাসী এমনকি, ভিন্দেশিরাও।
কলকাতা চাইনিজ়
এ চাইনিজ় খেতে চিনাদেরও কলকাতাতেই আসতে হবে। কারণ কলকাতার চাইনিজ় স্বাদে, গন্ধে, উপকরণে এবং রন্ধনপ্রণালীতে চিনা খাবারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কলকাতার চাউমিন, চিলি চিকেন, ফ্রায়েড রাইস, মাঞ্চুরিয়ানে ব্যবহার করা আদা, রসুন, গ্রিন চিলি সসের মতো উপকরণ, যার কোনওটিই ব্যবহার করা হয় না চিন দেশের চিনা খাবারে। কিন্তু ১৮০০ শতকের শেষে যখন দক্ষিণ চিন থেকে বহু মানুষ কলকাতায় এসে ট্যাংরায় পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করলেন, তখন তাঁদের হাতে চিনা রন্ধনপ্রণালী এবং কলকাতার মশলাপাতি দিয়ে তৈরি হল এক নতুন ধরনের ফিউশন খাবার। যা সাধারণ চিনা খাবারের থেকে অনেক বেশি মশলাদার। কিন্তু ভারতীয় জিভে সেই খাবারই রুচলো। তৈরি হল কলকাতা চাইনিজ়। এখনও ট্যাংরা এবং টেরিটি বাজারে গেলে কলকাতাবাসী চিনা সম্প্রদায়ের হাতে তৈরি কলকাতা চাইনিজ় পাওয়া যায়, যা দেড়শো বছর পার করেও জনপ্রিয়তা হারায়নি। বরং নতুন করে গোটা দেশে কলকাতা চাইনিজ় খাওয়ার ধুম পড়েছে।
কলকাতা বিরিয়ানি
প্রতিযোগিতা যেখানে লখনউ আর হায়দরাবাদের সঙ্গে সেখানে আলোচনায় বিরিয়ানি থাকবে না, হতেই পারে না। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই খাবারের এই তিন প্রকারের মধ্যে যুদ্ধ থামার নয়। তবে তেল-মশলার অধিক্যহীন, হালকা স্বাদের, মন ভরানো গন্ধের, হাড় থেকে খুলে আসা মাংসের টুকরো আর নরম আলু দেওয়া বিরিয়ানির মহিমা কী, তা খাদ্যারসিকেরা জানেন। এই বিরিয়ানির জন্ম খাস কলকাতাতেই। লখনউয়ের নবাব ওয়াজ়েদ আলি শাহের জন্য বানিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত রাঁধুনি। কেন বিরিয়ানিতে আলু দেওয়া হয়েছিল, কেন মশলা কম দেওয়া হয়েছিল, সে ব্যাপারে বিতর্ক আছে। অনেকে নবাবের আর্থিক অবনতির কথা বললেও কেউ কেউ এ-ও বলেন যে নবাব বৃদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর হজমক্ষমতাও কমে এসেছিল। তাই তাঁর খাওয়ার সুবিধার জন্যই বিরিয়ানিতে মশলা কমিয়ে হালকা বানানো হয়েছিল। অতিরিক্ত মাংসের বদলে দেওয়া হয়েছিল আলু। মাংসের টুকরোও রাখা হত অত্যন্ত নরম। যাতে বৃদ্ধ নবাবের খেতে বা হজম করতে অসুবিধা না হয়। কলকাতার সেই বিরিয়ানি সে যুগ থেকে এ যুগ পর্যন্ত একই ভাবে আছে। শুধু আছে বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। কারণ কলকাতা বিরিয়ানি তার পূর্বজ লখনউ বিরিয়ানি এবং হায়দরাবাদ বিরিয়ানিকে টক্কর দিয়ে ক্রমশ জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে তো বটেই, বিদেশেও।
চেলো কবাব
চেলো অর্থাৎ ভাত আর কাবাব হল ঝলসানো মাংসের টুকরো। তবে চেলো কাবাব তার বাইরে আরও অনেক কিছু। খাবারটি ইরানের। তবে কলকাতা বা বলা ভাল পার্ক স্ট্রিটের এক বৈগ্রহিক রেস্তরাঁ তাকে নিজের মতো করে আপন করে নিয়েছে। স্থানীয় উপকরণ এবং মশলায় ইরানের খাবারে মিশেছে কলকাতার আস্বাদ। আর তার সঙ্গে জুড়েছে পার্ক স্ট্রিটের ওই রেস্তরাঁর আলো-আঁধারি পরিবেশ। সেই পরিবেশে মাখন দেওয়া গরম ভাত যখন টলটলে ডিমের কুসুম, দু’রকমের কাবাব, ঝলসানো টম্যাটো, পেঁয়াজ, লেবু সহযোগে থালায় সেজে আসে, তখন চোখের সামনে অন্য কিছু নজরে পড়ে না। চেলো কাবাব খেতে ভিন্রাজ্য তো বটেই, বিদেশ থেকেও খাদ্যরসিকেরা হাজির হন কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে।
কাঠি রোল
খাস্তা পরোটার বুকে নরম মাংসের টুকরো আর লেবুর রসে মাখা পেঁয়াজ ছড়িয়ে মুড়ে দেওয়া ‘অমৃত’। তিরিশের দশকে কলকাতার পুরনো রেস্তরাঁ নিজ়ামে এর উৎপত্তি। সেখানে তখন কবাব খেতে আসতেন ব্রিটিশ সৈন্যেরা। কিন্তু স্বাদ পছন্দ হলেও হাতে ধরে কবাব খাওয়ায় তাদের আপত্তি ছিল ঘোরতর। আঙুল নোংরা না করে ব্রিটিশ সেনাদের কবাব খাওয়ার বন্দোবস্ত করতেই পরোটায় মুড়ে কবাব দেওয়ার চল হয়, যা পরে জনপ্রিয় হয় কাঠিরোল নামে। যেহেতু কবাবের টুকরো বাঁশের কাঠিতে গেঁথে ঝলসানো হত, তাই ওই নাম। তবে উৎপত্তি যে ভাবেই হোক, কাঠি রোল কালোত্তীর্ণ হয়ে টিকে গিয়েছে। আর বিদেশ থেকে আসা পিটা ব্রেড দিয়ে সাওয়ারমা রোল কিম্বা স্বাস্থ্যকর র্যাপের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে চলেছে।
ঝালমুড়ি
কলকাতার ঝালমুড়ির জনপ্রিয়তা কতটা তা বোঝা যায় লন্ডনে গেলে। সেখানে ‘কলকাতার ঝালমুড়ি’ ব্যানার লাগিয়ে হুবহু কলকাতার কেতাতেই ঝালমুড়ি মাখেন অ্যাঙ্গাস ডিনুন নামে এক সাহেব। ব্রিটেনের কোনও শহরের ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ থাকলে তিনি সেখানে পৌঁছে যান। আর স্টেডিয়ামের বাইরে তার বানানো ঝালমুড়ি খেতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ভারতীয় এবং ভারতীয় দর্শকের মধ্যে। এক বার তাঁর সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল প্রতিবেদকের। ডিনুন বলেছিলেন, “কলকাতার ঝালমুড়ি শুধু একটা খাবার নয়, একটা ঝলমলে ১ মিনিটের অনুষ্ঠান। ওই যে হাতের অদ্ভুত কায়দায় ঝালমুড়িওয়ালারা মুড়ির টিনে একের পর এক উপকরণ ঢেলে ঠন ঠন আওয়াজ তুলে ঘোরায়, উপর থেকে নীচে নামিয়ে আনে সর্ষের তেলের কৌটো, তার যে ঝাঁঝ, মশলার গন্ধ নাকে এসে লাগে, সেটা শুধু খাওয়া নয় একটা অভিজ্ঞতা। আমি সেটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।” ডিনুনের মতো ওই অভিজ্ঞতার প্রেমিক-প্রেমিকা অগুনতি।
ফুচকা
শেষ পাতের মিষ্টি দিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। তাই শেষটা হোক শুরুর পাতের ক্ষুধাবর্ধক খাবার বা অ্যাপেটাইজার দিয়ে। ফুচকা পেট ভরানোর খাবার নয় বটে। তবে মন ভরাতে ওস্তাদ! দেশের অন্য রাজ্যে ফুচকার তুতো ভাইবোন গোলগাপ্পা, পানিপুরি ইত্যাদি থাকলেও ফুচকার স্বাদ একেবারে আলাদা। হালকা মশলা আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা আলু আর টক-ঝাল তেঁতুলের জল। ফুচকা তার সহজ-সরল স্বাদের জন্যই বাকিদের থেকে স্বতন্ত্র এবং সমাদৃতও। এতটাই যে ইদানীং মুম্বইয়ের কলকাতা থিম রেস্তরাঁ থেকে ফুচকা অনিয়ে খাচ্ছেন অদিতি রাও হায়দারি, রাজকুমার রাওয়ের মতো টিনসেল টাউনের তারকারা। এমনকি, দীপিকা পাড়ুকোনও কলকাতায় এসে এ শহরের ফুচকা চেখে দেখে গিয়েছেন!
এ তো মোটে সাত রকমের খাবারের কথা! কলকাতার এমন আরও অনেক খাবার আছে, যার স্বাদ পেতে এই শহরেই আসতে হবে। তাই হায়দারবাদের পরে যদি লখনউ ইউনেস্কোর স্বাদু শহরের শিরোপা পেয়ে যায়, তবে খাদ্য সংস্কৃতির ‘পীঠস্থান’ হয়ে কলকাতাই বা পিছিয়ে থাকে কেন!