এক সময় চশমা ছিল চোখের সমস্যা মেটানোর দাওয়াই। পরে চশমা ছেড়ে লেন্স পরার ধুম পড়ে। কেতা মানেই ছিল কেবল রোদচশমা। সেলুলয়েডে চশমা পরা নায়ক বা নায়িকা মানেই তার ‘মেকওভার’-এর প্রয়োজন। ‘কল হো না হো’ এবং ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’-র ‘চশমিশ নয়না’র কথা মনে আছে? ছবির প্রথম ভাগে চশমা পরিহিতা সাদামাঠা মেয়ে, দ্বিতীয় ধাপে তারা চশমা ছেড়ে লাস্যময়ী ও কেতাদুরস্ত নারী। অথবা ‘যব উই মেট’-এর ‘আদিত্য’? মানসিক অবসাদাচ্ছন্ন ছেলের চোখে ছিল চশমা, ধীরে ধীরে মুখে হাসি ফুটল আর চশমা গেল উধাও হয়ে। চশমাকে খানিক সে ভাবেই দেখা হত সাম্প্রতিক অতীতেও।
আর এখন? লেন্সের জনপ্রিয়তার জমানা গিয়েছে। রোদচশমার চেয়ে চশমার প্রতি ঝোঁক বেড়েছে অনেকের। ‘প্রজাপতি ২’-এর দেব, ‘কিলবিল সোসাইটি’র কৌশানী মুখোপাধ্যায় অথবা ‘মিতিন মাসি’-র কোয়েল মল্লিকের চরিত্রের কথা মনে করুন। কেউ রিমলেস চশমার কায়দায়, কেউ বা মোটা কালো ফ্রেমে, কেউ আবার অফ হোয়াইটের নতুন কেতার সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন। সেখানে চশমা খোলানোর প্রয়োজন পড়েনি। চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে ফ্রেমগুলি।
গত কয়েক বছরে সাজগোজের মানচিত্রটাই বদলে গিয়েছে। আর তাতে সংযোজন হয়েছে চশমার। পাওয়ার থাকুক বা না থাকুক, চশমা এখন ব্যক্তিত্বের অংশ। পোশাক বদলালে যেমন ব্যাগ বদলায়, তেমনই বদলাচ্ছে চশমা। অনেকের ড্রয়ারে এক নয়, একাধিক চশমা থাকে। তবে ২০২৫ সাল জুড়ে চশমার ফ্যাশনের ধারায় খানিক বদল এসেছে। ঠিক যে ভাবে পুরনো চশমা নতুন ভাবে ফিরেছে, সে ভাবেই উদ্ভট, মজাদার ফ্রেমের রমরমা বেড়েছে। ২০২৬ সালেও সে সব চশমার আধিপত্য থাকবে বলেই মনে করা যেতে পারে। দলে যোগ দিতে পারে আরও নতুন ধরনের ফ্রেমও।
ছোট মুখে বড় কথা
ছবি: সংগৃহীত।
মুখের আকার-আয়তনকে ছাপিয়ে যাবে। ভ্রু থাকবে নীচে, মুখমণ্ডলের রেখা থাকবে ভিতরে, গালের নিম্নাংশ ছোঁবে চশমা। এমন চশমার প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে বহু বছর ধরেই। এ বছরও তার হেরফের হয়নি। চোখ ঢেকে রাখার চেয়ে চোখকে ঘিরে ধরাই লক্ষ্য। মুখের গড়ন বদলে যাওয়ার মতো দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে। আগে চশমা মুখের সঙ্গে মানাচ্ছে কি না, তা দেখা হত। এখন উল্টো। চশমার চরিত্র কেমন, তা বুঝে অভিব্যক্তি বদলানো হচ্ছে। যেমন বড়, মোটা ফ্রেম পরা হয় কর্তৃত্বপূর্ণ মেজাজ আনতে। তেমনই চুলের সঙ্গেও অনেকে চশমা বদলান। ছোট করে চুল কাটলে বড় ফ্রেম পরতে চান অনেকে। তা সে হেক্সাগন হোক বা ওয়েফেয়ারার, ক্লাবমাস্টার হোক বা রিমলেস। মস্ত বড় চশমা থাকবে চোখের চারধারে।
বড় মুখে ছোট কথা
ছবি: সংগৃহীত।
নব্বইয়ের দশক থেকে নতুন শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত মুখের সঙ্গে চশমার কায়দা মানানসই হতে হত। সেই ধারাই ফিরতে শুরু করেছে এখন। অর্থাৎ বড় নয়, ছোট ফ্রেমের দিকে ঝুঁকছেন অনেকে। কিন্তু ছোট হতে হতে তার জল গড়িয়ে গিয়েছে বেশ খানিক দূর। চোখের কোল ছাড়িয়ে বেরোতে চাইছে না নতুন ফ্রেমগুলি। এক সময়ে যা কেবল রিডিং গ্লাস হিসেবে ব্যবহৃত হত, সে রকম ফ্রেম এখন কেতার জন্য পরা হচ্ছে। কখনও গোল, কখনও ডিম্বাকৃতি, কখনও চৌকো, কখনও বা আয়তাকার হতে পারে সে সব ফ্রেম।
চোখ যেখানে মুখ্যচরিত্রে
ছবি: সংগৃহীত।
মহাত্মা গান্ধী থেকে হ্যারি পটার, জন লেনন থেকে ‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’-এর ‘রাজ’— গোল বা আয়তাকার রিমলেস চশমার দৌড় বাস্তব থেকে পর্দায়। সেই ফ্রেমগুলি বহু বছর ধরেই ফ্যাশন জগতে জায়গা পেয়েছে। তবে মাঝে রিমলেসের জনপ্রিয়তা খানিক কমেছিল। তখন কেবল মোটা ফ্রেমের চশমার দিকে ঝোঁক বেড়েছিল চশমাধারীদের। চোখকে আড়াল করার একটা প্রবণতা ছিল। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে আবার চোখকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়েছে। তা রিডিং গ্লাসের কেতাই হোক বা হ্যারি পটারের মতো গোল, মস্ত হোক বা ছোট্ট ফ্রেম। কিন্তু ফ্রেমের চারধারে বর্ডার আঁকার ঝোঁক কমেছে একাংশের। সেখানে চোখের সঙ্গী হয়েছে এই ধরনের ফ্রেম। তবে পুরনো সেই ধারায় নয়া সংযোজন হয়েছে আধা-রিমলেস। চশমার অর্ধেক রিমলেস, অর্ধেক অংশে শাড়ির মতো সরু পাড়। কখনও বা উপরে, কখনও বা নীচে, কখনও আবার ‘ইনফিনিটি’ চিহ্নের মতো এক চোখ থেকে নাক বেয়ে অন্য চোখে বয়ে গিয়েছে রিম।
চোখ যেখানে পার্শ্বচরিত্রে
ছবি: সংগৃহীত।
চোখ নয়, চশমাই আসল। পাতলা মেটাল নয়, বরং মোটা অ্যাসিটেট ফ্রেমের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। ষাট কিংবা সত্তরের দশকের ভিন্টেজ, অর্থাৎ বড়, মোটা ফ্রেমের দাপট বেড়েছে বেশ কিছু দিন ধরে। ঠিক যেন পুরনো সিনেমার চরিত্র হয়ে ওঠা যায় সে সব চোখে পরে। তা ছাড়া রঙেও পার্থক্য এসেছে। আগে নিরপেক্ষ রঙেই আটকে থাকত চশমা। এখন দেখা যাচ্ছে, জলপাই সবুজ, পোড়া কমলা, ওয়াইন রং, নীলচে ধূসর, কচি কলাপাতা। এমনকি, হালকা প্যাস্টেল শেডও জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে রঙিন ফ্রেম মানে নিজের বিশেষ মেজাজ ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করার হাতিয়ার।
বাঁধ ভেঙে দাও
ছবি: সংগৃহীত।
২০২৫ সাল শেষ হওয়ার আগেই দেশে-বিদেশে ছকভাঙা কায়দার ফ্রেম চোখে পড়ছে। ফিউচারিস্টিক বা ভাবীকালের ফ্যাশনের ছোঁয়া রয়েছে নতুন ধরনের এই চশমাগুলোয়। কিছু চশমা একেবারে ছকভাঙা। ২০২৬ সালে এই প্রবণতা আরও এক ধাপ এগোতে চলেছে। চশমা হবে আরও ব্যক্তিগত। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক। ফ্রেমে দেখা যাবে অদ্ভুত গঠন। কোথাও খুব পাতলা ফ্রেম, কোথাও আবার অসমান আকার। এক চোখের দিকে ফ্রেম মোটা, অন্য দিকে পাতলা। ফ্রেমের দু’দিকের দু’টি ভিন্ন রং। ২০২৬ সালে আর নিখুঁত হওয়ার দিকে ছুটবেন না অনেকে। বরং ইচ্ছাকৃত অসম্পূর্ণতাই ফ্যাশন হয়ে দাঁড়াবে। তেমন কয়েক ধরনের ফ্রেমের ঝলক মিলেছে ২০২৫ সালেও। স্টিমপাঙ্কের নয়া ধরন, সাইবারপাঙ্ক ফিউচারিস্টিক ফ্রেম, ব্লক গ্লাসেস, ভাঁজ করা যায় এমন ফ্রেম, নাকের মাঝখানে খোলা ও জোড়া যায়, এমন চশমা। অ্যাসিমেট্রিক, এক দিকে গোল অন্য দিকে চৌকো, এমন চশমাও পরছেন অনেকে। আবার একান্ত নিজস্ব পছন্দের ডিজ়াইনার চশমা জায়গা করে নিচ্ছে ফ্যাশনদুনিয়ায়।
রঙিন কাচের রকমারি
ছবি: সংগৃহীত।
রোদচশমা পরে নিজেকে দেখতে বেশি সুন্দর লাগে? কিন্তু সানগ্লাস সারা ক্ষণ পরে থাকা সম্ভব নয়। সাধারণ চশমা স্রেফ সাদামাঠায় আটকে নেই অনেক দিনই। চশমার কাচের উপর লেপে দেওয়া হয় হালকা রং। চশমা ও রোদচশমার মধ্যপন্থা যাকে বলে। হালকা হলুদ, হালকা লাল, হালকা নীল বা বেগনি— নানা রঙের ছোঁয়া এখন চোখের উপর। সারা ক্ষণ। রোদেও। ছায়াতেও। স্বচ্ছতা কাটিয়ে ধোঁয়াটের কাচের দিকেও ঝুঁকছেন অনেকে। তবে ফোটোক্রোমের জনপ্রিয়তায় খানিক ভাটা দেখা গিয়েছে গত কয়েক বছরে।
বিশ্ব জুড়ে ধীরে ধীরে লিঙ্গের ছক ভাঙছে চশমা। মেয়েদের চশমা, ছেলেদের চশমার কাঠামো ভেঙে লিঙ্গনিরপেক্ষ হয়ে উঠছে ফ্রেম। ২০২৬-এ এই সীমারেখা আরও আবছা হবে বলে আশা করা যেতে পারে। চশমার শত, হাজার রকমের ফ্রেমের হাতছানিতে নতুন ভাবে ভাবছেন অনেকে। চশমাধারী থেকে চশমাপ্রেমী হয়ে ওঠার পথে হাঁটছেন তাঁরা। চশমাবিলাসে মজে গোটা বিশ্ব।