Advertisement
E-Paper

বাবা যে একজন বিখ্যাত সুরকার, বুঝতে আমার সময় লেগেছিল

পেশাগত দায়বদ্ধতার বাইরে ব্যক্তিজীবনেও একাধিক সত্তা ছিল সলিল চৌধুরীর। প্রয়াত সুরকারের জন্মশতবার্ষিকীতে সেই দিকগুলি নিয়ে লিখলেন কন্যা অন্তরা চৌধুরী।

অন্তরা চৌধুরী

অন্তরা চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ১০:১৬
Bengali singer Antara Chowdhury penned her association with father Salil Chowdhury on his birth centenary

সুরকার সলিল চৌধুরী। চিত্রাঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।

দেখতে দেখতে ৩০টা বছর কেটে গেল— বাবা নেই! একটা দীর্ঘ শূন্যতা। সেই শূন্যতা কোনও দিন পূরণ হবে না জানি। তাই তাঁর সঙ্গীতকে অবলম্বন করেই বেঁচে রয়েছি। আজ সন্ধ্যায় বাবার জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে গাইব। বাবার কথা মনে পড়বে। গত কয়েক দিন ধরে শিল্পীদের সঙ্গে রিহার্সাল করলাম। তাঁর গান নিয়ে মানুষের আগ্রহ এবং নিরন্তর চর্চা দেখে সত্যিই মনে হয়, বাবা আমাদের মধ্যেই রয়েছেন।

বাবা কী ভাবে সঙ্গীত তৈরি করতেন, তা নিয়ে এখনও মানুষ আমার কাছে জানতে চান। সাগরকে তো স্বল্প পরিসরে একটি পাত্রে রাখা সম্ভব নয়। তাই আজকের এই লেখায় বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের নানা দিকগুলোকেই পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই। সুরকার সলিল চৌধুরী এবং বাবা হিসেবে সলিল চৌধুরী— সব মিলিয়ে মানুষটা বড্ড খাঁটি ছিলেন। দিনকয়েক আগে বাবার পুরনো ডায়েরির পাতা খুঁজে পেলাম। আমাকে নিয়ে কত ভাল ভাল কথা লিখেছেন। পড়েই চোখে জল এসে গিয়েছিল।

বাবা আমায় ‘মানু’ বলে ডাকতেন। আর আমি সব সময়ে বাবার সঙ্গে থাকতাম। আমি তো মুম্বইয়ে বড় হয়েছি। বাবাকে কখনও ‘বাবা’, কখনও ‘ড্যাড’ বলে ডাকতাম। বাবা তার জন্য কিছু মনে করতেন না। তিনি যে কতটা সহজ মানুষ ছিলেন, কয়েকটা ঘটনা বললেই স্পষ্ট হবে। বাড়িতে ফিরলেন। সোফায় বসেই বললেন, ‘‘মানু, দেখ তো পাকা চুল দেখা যাচ্ছে কি না। সন্নাটা নিয়ে আয়।’’ আবার সারা দিন কাজ করে বাড়ি ফিরেছেন। পায়ে খুব ব্যথা। বললেন, ‘‘পায়ের উপর একটু দাঁড়া তো।’’ তার পর আমার হাত ধরে বাবা ব্যালান্স করতেন।

Bengali singer Antara Chowdhury penned her association with father Salil Chowdhury on his birth centenary

বাবার সঙ্গে অন্তরা। ছবি: সংগৃহীত।

বাবা যে একজন বিখ্যাত সুরকার, সেটা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল। কারণ, বাড়িতে তিনি তো অন্য মানুষ। প্রেক্ষাগৃহে ‘রজনীগন্ধা’ বা ‘ছোটি সি বাত’-এর মতো ছবিগুলো দেখতে গিয়ে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পর্দায় বাবার নাম ফুটে উঠত। দেখে বুঝলাম, আমার বাবা একজন বিখ্যাত মানুষ। বাড়িতে অতিথিদের আগমন দেখেও সেটা বুঝতে পারতাম। বাড়িতে রিহার্সাল বা আড্ডায় আসছেন মান্নাকাকা (মান্না দে), আশাদি (আশা ভোঁসলে)। স্টুডিয়োয় গিয়ে দেখলাম ‘আজ নয় গুনগুন’-এর রেকর্ডিংয়ে লতাদি (লতা মঙ্গেশকর) এসেছেন। উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, বাবা বিখ্যাত কেউ।

বাবা কাজের জায়গায় খুব পরিশ্রম করতে পারতেন। সারা দিন হয়তো সুর করছেন বাড়িতে। পিয়ানো ছেড়ে ওঠার সময় নেই। মা দেখলাম বাবাকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছেন। শেষ বয়সে বাবা তখন বম্বের ‘কুরুক্ষেত্র’, ‘দরার’-এর মতো একাধিক ধারাবাহিকের জন্য সুর করছেন। সঙ্গে আমি প্রোগ্রামিং করতাম। খুব কম বাজেট। কিন্তু তার জন্য যে বাবা কম সময় দেবেন, এটা দেখিনি। দেখতাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে চলেছেন।

সঙ্গীতের প্রতি যতটা বাবার দায়িত্ববোধ, পরিবারের প্রতিও যেন ঠিক ততটাই দায়িত্ব। বাবা অঙ্ক এবং ফিজ়িক্সে ভাল ছিলেন। আমায় পড়াতেন। কোনও দিন এতটুকু বকাবকি করতে দেখিনি। কিন্তু ফ্লোরে হয়তো সঙ্গীতশিল্পীরা কোনও সুর বাজাতে পারছেন না। বার বার টেক করলে তখন বাবা একটু হতাশ হয়ে পরতেন। আবার আমি হয়তো গান গাইতে পারছি না। বাবা কিন্তু না রেগে ধীরে ধীরে বলতেন, ‘‘মানু, মুখটা এমন জড়িয়ে গাইছ যে কোনও কথা বুঝতে পারছি না। একটু খুলে গাও।’’ বাবা কিন্তু আমাকে সব সময়ে সাপোর্ট করতেন। চেয়েছিলেন, আমি যেন সঙ্গীত তৈরি করি। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।

Bengali singer Antara Chowdhury penned her association with father Salil Chowdhury on his birth centenary

রেকর্ডিং স্টুডিয়োয় (বাঁ দিক থেকে) সবিতা, অন্তরা এবং সলিল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত।

১৯৭৬ সালে ‘সিস্টার’ ছবিতে কোরাসে গান গেয়েছিলাম। পরের বছর বাবা ‘মিনু’ ছবিতে কাজ করছেন। আমার তখন ৭ বছর বয়স। বাবা একজন শিশুশিল্পীর কণ্ঠস্বরের সন্ধানে ছিলেন। তখনকার দিনে লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোঁসলে নিজেরাই ছোটদের গলায় গান গেয়ে দিতেন। মা তখন আমাকে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন বাবাকে। বাবা রাজি হলেন এবং আমারও সঙ্গীত সফরের সূত্রপাত ঘটল। মনে আছে, মুম্বইয়ের মেহবুব স্টুডিয়োয় ‘ও কালী রে’ গানটার রেকর্ডিং করেছিলাম। ছোটবেলায় পুতুল খেলতে ভালবাসতাম বলে বাবা আমাকে পুতুল নিয়েও অনেক গান তৈরি করে দিয়েছিলেন। ‘মিনু’র গান জনপ্রিয় হওয়ার পর একদিন বাড়িতে ভি বালসারা এলেন। আমাকে দিয়ে বাচ্চাদের পুজোর গান তৈরির পরামর্শ দিলেন। ফলে একে একে তৈরি হল ‘বুলবুল পাখি’, ‘পুজোর গন্ধ এসেছে’-র মতো গান।

বাবা খাদ্যরসিক ছিলেন। মাছের বিভিন্ন পদ খেতে খুব পছন্দ করতেন। তার মধ্যে ইলিশ, গুলে মাছ ছিল অন্যতম। বাবা তাঁর বোন, অর্থাৎ আমার আল্লা পিসির হাতের রান্নাও খেতে খুব পছন্দ করতেন। বাবা কিন্তু নিজেও ভাল রাঁধুনি ছিলেন। ব্যস্ততা সত্ত্বেও নিজের হাতে বাজার করে রান্না করতেন। বাবার রান্না করা কষা মাংসের স্বাদ আজও ভুলতে পারি না। আমি নিজেও বাবার কাছে রান্না শিখেছি। খাওয়াদাওয়া নিয়ে নিজেও মারাত্মক রকমের হুজুগে ছিলেন। হঠাৎ ঠিক করলেন বাড়িতে দোসা তৈরি করবেন। পাথরের বিশাল দোসা মেকার চলে এল। একদিন হঠাৎ জানালেন, বাড়িতেই মুড়ি তৈরি করবেন। সেই মুড়ি তৈরি করে ছাতু দিয়ে খেয়ে নিলেন। সন্ধ্যায় বাড়ির নীচ থেকে চপ কিনে এনে আড্ডা জমাতেন। আর আমাদেরও দিতেন। চপ খেলে গলা খারাপ হবে বলে মা খুব রাগারাগি করতেন। আর বাবা হেসে বলতেন, ‘‘কিচ্ছু হবে না!’’

সঙ্গীতের মতো বাবার বাজার করাটাও ছিল ‘গ্র্যান্ড’! আশির দশকে আমরা তখন কলকাতায় চলে এসেছি। বাবা সকালে বেকবাগান বাজারে যেতেন। কখনও কখনও আমিও সঙ্গে যেতাম। বিক্রেতারা সবাই ‘‘সলিলদা, সলিলদা’’ বলে ডাকতেন। বাবাও ব্যাগ বোঝাই করে বাজার করে আনতেন। মা খুব রেগে যেতেন। কারণ, বেশি বাজার করলে সেগুলো নষ্ট হবে।

Bengali singer Antara Chowdhury penned her association with father Salil Chowdhury on his birth centenary

মঞ্চে গাই গাইছেন (বাঁ দিক থেকে) অন্তরা, সঞ্চারী, সবিতা এবং সলিল চৌধুরী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

বাবা নিজে খুব নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুম্বইয়ে থাকাকালীন সকালে পেডার রোডে হাঁটতে যেতেন। আবার কলকাতায় যোগাভ্যাস করতেন। একজন প্রশিক্ষক আসতেন রোজ। তাঁর নাম ছিল ফোনে। বাবা মজা করে বলতেন, ‘‘কী রে, ফোনে ফোন করেছে?’’ বাবা নিজে খুব রসিক মানুষ ছিলেন। এক বার শিশির মঞ্চে বাবার একক শো হবে। পিয়ানোয় সানাই প্র্যাকটিস করতে করতে বললেন, ‘‘বিসমিল্লা আর হতে পারলাম না। মনে হয় উনিশমিল্লা হতে পেরেছি।’’ দ্বিজেনকাকার (দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে একদিন বাবা আড্ডা দিচ্ছেন। কাকা জানালেন যে, তাঁর খুব গরম লাগছে। বাবা বললেন, ‘‘তুই তো সূর্যের খুব কাছে থাকিস। তাই তোর গরম বেশি লাগছে!’’ আসলে বাবার মন্তব্যের নেপথ্যে ছিল দ্বিজেনকাকার দীর্ঘ চেহারা।

অনেকেই হয়তো জানেন না, বাবা কিন্তু খুব ভাল ভূতের গল্প বলতে পারতেন। নিজে চিত্রনাট্যকার ছিলেন বলেই হয়তো অত ভাল গল্প বলতেন। ছোটবেলায় আমি আর জুলি (বোন সঞ্চারী) বাবার কাছে সেই গল্প শুনে ভূতের ভয় পেতাম। বাবা একটা খালি কাচের বোতলে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ফেলে দিতেন। তার পর বোতলের মুখটা বন্ধ করে বলতেন, ‘‘দেখ, ভূত আটকে গিয়েছে। আর ভয় নেই। এ বার তোরা ভাল করে ঘুমো।’’

বাবার উপর সেই ভাবে কোনও দিন রাগ করিনি। কিন্তু বম্বে থেকে আমাকে আর সঞ্চারীকে বাংলা শেখার জন্য কলকাতায় গোখেল স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন বাবা। তখন হোস্টেলে থাকতাম। মা-বাবার সান্নিধ্য পেতাম না বলে খুব রাগ হত। সেটা কিন্তু বাবাকে বলতাম না। মাকে বলতাম। বড় হওয়ার পর বাবা আমার বন্ধুর মতো হয়ে গেলেন। তখন বলেছিলাম। পরবর্তী সময়ে বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা যা করেছিলেন, সেটা আমার ভালর জন্যই। কারণ বাবা-মাকে প্রচুর ঘুরতে হত। সেখানে হস্টেলে থেকে আমার পড়াশোনার কোনও ক্ষতি হয়নি। কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম বা স্যাম ইঞ্জিনিয়ারের কাছে পিয়ানো শেখা— সবই তো কলকাতায়।

Bengali singer Antara Chowdhury penned her association with father Salil Chowdhury on his birth centenary

একান্ত অবসরে লেখালিখিতে ব্যস্ত সলিল চৌধুরী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

সঙ্গীত শোনা এবং রেওয়াজের প্রতি বাবা খুব জোর দিতেন। এ রকমও হয়েছে, আমি মাস্টারমশাইয়ের কাছে গান শিখছি। বাবা এসে বসে পড়লেন। বললেন, ‘‘আমিও শিখব এই বন্দিশটা। শেখার কোনও শেষ নেই।’’ তার পর সেটা দিয়েই আমার জন্য একটা নতুন গান তৈরি করে দিলেন। আমি তখন অনেকটাই বড়। প্রতি দিন বিকেলে নিয়ম করে রেকর্ডে বাবার সঙ্গে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত শুনতাম। বাখ্‌, বিঠোফেন, মোৎজ়ার্ট, স্ট্রাভিনস্কি— কিছু বাদ থাকত না। আর বাবা বলতেন, ‘‘মানু, শুধু খেয়াল কর, কী ভাবে শুরু করছেন পিসটা। সঙ্গীতায়োজনটা উপলব্ধি করার চেষ্টা কর। আর ভাব, যাঁরা এটা শুনছেন না, তাঁরা কতটা বঞ্চিত হচ্ছেন।’’ ভারতীয় ধ্রূপদী সঙ্গীতের প্রতিও বাবার অসীম শ্রদ্ধা ছিল। ফৈয়জ় খান সাহেব এবং করিম খান ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় শিল্পী।

আমাদের পরিবারটাই ছিল সুরে মোড়া। অদ্ভুত একটা পরিবেশ। একটা ঘরে মা রেওয়াজ করছেন। দাদা (সঞ্জয় চৌধুরী) হয়তো একটা ঘরে ড্রাম প্র্যাকটিস করছে। বাবা একটা ঘরে পিয়ানোয় বসে। আবার অন্য ঘরে হয়তো আমি আর সঞ্চারী পড়াশোনা করছি। বাবা হঠাৎ একটা সুর পেয়ে আমাদের তিন জনকে ডাকলেন। হারমনি করতে বললেন। আমি মেলডি, মা হাই পার্ট এবং সঞ্চারী লো পার্ট। তৈরি হল ‘সূর্যের আলো এসে’ গানটা। ছোটবেলায় খুব ‘অ্যাবা’ শুনতাম। ওদের ‘টেক আ চান্স অন মি’ গানের সুর শুনে বাবা ‘এক্কা দোক্কা টেক্কা’ গানটা তৈরি করে দিলেন। এ রকম উদাহরণ অজস্র রয়েছে।

আশির দশকে বাবা মুম্বই ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। কারণ তখন ‘ডিস্কো’ সঙ্গীত চলে এল। বাবার আর ভাল লাগত না। বেহালায় ‘সাউন্ড অ্যান্ড সাউন্ড’ নামে একটা উন্নত স্টুডিয়ো খুললেন। কিন্তু সেই ব্যবসা ভাল চলল না। বাবাকেও আমি অবসাদে ভুগতে দেখেছি। কলকাতায় কেউ কাজের প্রস্তাব দিতেন না। বাবাকেও খাতা পেন নিয়ে চুপ করে বসে থাকতে দেখেছি। লিখতে পারছেন না। আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছেন। বন্ধুবান্ধবের আসা-যাওয়া কমে গিয়েছিল। তখন হয়তো বাবার সঙ্গে আমি বা মা সঙ্গ দেওয়ার জন্য গল্প করছি। একজন শিল্পী যে সব সময়ে একাকিত্বের স্বীকার, সেটা বাবাকে দেখে উপলব্ধি করেছিলাম। তার উপর, বাবা ছিলেন সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একজন শিল্পী। কাজের জন্য বাবাকে আবার শেষে মুম্বই যেতে হল। ১৯৯০ সালে ‘আশ্রিতা’ ছবির আবহসঙ্গীত করলেন। মলায়লাম ইন্ডাস্ট্রি থেকেও একের পর কাজ আসতে শুরু করল। তবে কাজ নেই বলে বাবাকে কোনও দিন ভেঙে পড়তে দেখিনি। সব সময় নিজেকে নতুন করে গড়তেন। ডায়েরির পাতাতেও সেই চেষ্টার কথা লিখে গিয়েছেন। আমাদের বলতেন, ‘‘দেখ, আমাকে হয়তো এখন কেউ বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি চলে যাওয়ার ৫০ বছর পরেও দেখবি আমাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’’

বাবা কিন্তু পুরস্কার পেতে পছন্দ করতেন। একটা জায়গায় লিখেওছিলেন, ‘‘অ্যাওয়ার্ড পেতে কার না ভাল লাগে!’’ একটা মাত্র ফিল্মফেয়ার পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে বাবা পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ, সারা জীবনের শেষে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী দিতে চায়। এ দিকে অন্যেরা তত দিনে ‘পদ্মভূষণ’ বা ‘ভারতরত্ন’ পেয়ে গিয়েছেন। বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। সমসাময়িক শিল্পীদের নিয়ে বাবাকে কোনও দিন সমালোচনা করতে শুনিনি। সঙ্গীতে বুদ্ধিমত্তার ছাপ রাখায় বিশ্বাসী ছিলেন। আরডি বর্মণ প্রসঙ্গে বলতেন, ‘‘পঞ্চম ইজ় আ উইজ়ার্ড ইন রিদ্‌ম।’’ আবার ‘তেজ়াব’ ছবির ‘এক দো তিন’ গানটা কেন মানুষ শুনছে, তা নিজের মতো বিশ্লেষণ করলেন বাবা। ‘রোজ়া’ ছবির গান শুনে এআর রহমান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘গানগুলো শুনেছি। ভাল হয়েছে।’’ কিন্তু অশালীন গানের কথা বাবার পছন্দ ছিল না। তবে আজকে সঙ্গীতজগতের পরিস্থিতি দেখে বাবা হয়তো একটু কষ্টই পেতেন।

নব্বইয়ের দশকে নিজের লেখা গল্প নিয়ে বাবা ‘ইয়াদগার’ বলে দূরদর্শনের জন্য একটা ধারাবাহিক করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অভিনয়ে কমলজিৎ এবং দেবশ্রী রায়কে নির্বাচন করলেন। কিন্তু বাবা অসুস্থ হলেন। হাসপাতালে বাবাকে দেখতে মৃণালকাকা (মৃণাল সেন) এবং হৃষীকাকা (হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়) এসেছিলেন। মনে আছে অমিতাভ বচ্চন এবং অনুপ জলোটা মুম্বই থেকে ফোন করে বাবার খবর নিয়েছিলেন। তার পর তো একদিন বাবা চলে গেলেন! এখনও বাবার স্পর্শ মিস্‌ করি। রেওয়াজের মাঝে পিছন থেকে আমার মাথায় বাবার হাত রাখা আজও মনে পড়ে। সে দিনও ‘বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু’ গাইতে গিয়ে চোখে জল এল।

সঙ্গীতের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন বাবা। খ্যাতির শিখর ছুঁয়েছেন। চলার পথে ধাক্কা খেয়েছেন। আবার নিজেকে নতুন করে ভেঙে গড়েছেন। আমার তো মনে হয়, ‘যাক যা গেছে তা যাক’ গানটার মতোই বাবার জীবনদর্শন। চিরকাল পজ়িটিভ থেকেছেন। বাবা বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মানুষ একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে জন্ম নেন। এখন শুধু মনে হয়, বাবার কাজ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের জন্যই হয়তো আমার জন্ম হয়েছে। বাবাকে নিয়ে ভবিষ্যতে একটা মিউজ়িয়াম তৈরির ইচ্ছা রয়েছে। তাঁর কন্যা হয়ে জন্মেছি বলে আমি গর্বিত। জন্মদিনে বাবাকে আরও এক বার প্রণাম জানাই।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)

Salil Chowdhury Antara Chowdhury Celebrity Birthday Bengali Music Music Composer Memoir
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy