Advertisement
E-Paper

স্থানীয় খাবারে বিদেশি ছোঁয়া, রন্ধনশিল্পীদের পরীক্ষামূলক খাবার, বছর জুড়ে ভোলবদলে সেরা ক্যাফে

আনন্দবাজার ডট কম-এর সাংবাদিকেরা সারা বছর কলকাতার ক্যাফে ও রেস্তরাঁ ঘুরে দেখেছেন, খাবারে ও রন্ধনশৈলীতে কী ভাবে সাবেক ও সাম্প্রতিকের মেলবন্ধন হয়েছে, কোথায় মেনুতে নতুন খাবার যোগ হয়েছে, স্থানীয় খাবারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক খাবারের মিলন কী ভাবে হয়েছে, খাবার পরিবেশনের শিল্পে কী ধরনের নতুনত্ব এসেছে। কলকাতার সিয়েনা ক্যাফে খাদ্যপ্রেমীদের কাছে নতুন ঠিকানা নয়। তবে গত বছর জুড়ে নিজেদের সমস্ত পুরনো রীতি, খাবার, শৈলীতে পরিবর্তন এনে নতুন ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে। তাই ২০২৫ সালটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আনন্দবাজার ডট কম সিয়েনার এই নতুন রূপকে তুলে ধরেছে। সফরে সঙ্গী হয়েছিলেন অভিনেত্রী বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়। সিয়েনার খাবার চেখে দেখলেন তিনি।

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৩:৩২
সিয়েনার খাবারে মুগ্ধ বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়।

সিয়েনার খাবারে মুগ্ধ বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

সপ্তাহান্ত নয়, তবু সেই সন্ধেয় সিয়েনা ক্যাফে অ্যান্ড স্টোরের দরজা ঠেলতেই টের পাওয়া গেল, সহজে বসার জায়গা পাওয়া যাবে না। দু’পা এগোতেই এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। সিয়েনায় এই ভিড় নতুন নয়। ভাল খাবার কি কেবল শনি-রবিতেই চান মানুষ? খাদ্যরসিকেরা তো সোম কিংবা মঙ্গলেও খাদ্যরসিকই থাকেন। সিয়েনার একতলায় এখন স্টোর আর ক্যাফে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নতুন করে সাজানোর পর স্টোরের আয়তন বেড়েছে। সামনের ঘর থেকে প্রায় ক্যাফে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে স্টোর। তাদের শান্তিনিকতনের ওয়ার্কশপ থেকে আরও অনেক বেশি জিনিসপত্র কলকাতায় এনে রাখা হয়েছে। ডোকরার গয়নাগাটি, তামার কানের দুল, সেরামিকের প্রদীপ, শীতের উৎসবের মরসুমের জন্য কাপড়ের বল, সেরামিকের স্টার, ডায়েরি, ব্যাগ, কোস্টার-সম‌েত গ্লাস। মিনিটখানেক সেখানে ঘোরার পরই খিদে এমন চাগাড় দিয়ে উঠল যে। ক্যাফেতে বসে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়াটা সঠিক মনে হল না। একতলায় ‘বসার ঘর’-এ না বসে দোতলায় ‘খাওয়ার ঘর’-এ গিয়ে খাওয়ার শখ জাগল।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নতুন করে সাজানোর পর স্টোরের আয়তন বেড়েছে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নতুন করে সাজানোর পর স্টোরের আয়তন বেড়েছে। নিজস্ব চিত্র।

ইতিমধ্যে বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়ও পৌঁছে গিয়েছেন সিয়েনায়। সেখানে পা রেখেই চমকে গেলেন বিবৃতি। ২০২০ বা ২০২১ সালে সিয়েনায় খেতে এসেছিলেন তিনি। স্টোরের বহর দেখে উত্তেজিত নায়িকা বললেন, ‘‘উপরে গিয়ে খাবার অর্ডার দিয়ে নীচে এসে শপিং করে যাব। অনেক কিছু নতুন হয়েছে দেখছি। কী ভাল লাগছে!’’ সিয়েনার এই দ্বিতীয় কিস্তিতে আরও দু’টি তলা তৈরি হয়েছে। নতুন ভাবে তৈরি হওয়ার পর বিবৃতি প্রথম বার সিয়েনায় পা রেখেছেন।

সিয়েনার দোতলায় ‘খাওয়ার ঘর’-এ ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পাশের টেবিল থেকে দু’টি সারমেয় স্বাগত জানাল বিবৃতিকে। ক্রিসমাসের মরসুমে লাল ঝলমলে পোশাক পরানো হয়েছে তাদের। তারাও খেতে এসেছে পরিবারের সঙ্গে। নতুন সিয়েনায় আরও বেশি জায়গা মেলায় পোষ্যদের ঘুরে বেড়ানোয় খুবই সুবিধা হয়েছে। পোষ্যপ্রেমী বিবৃতিও তাদের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটালেন। বিবৃতির কথায়, ‘‘আমি জানতাম না, এখানে পোষ্যদের নিয়ে আসা যায়। শুরুতেই মন ভাল হয়ে গেল। তার উপরে গোটা দোতলাটা যে ভাবে সাজানো হয়েছে, তাতে পুরনো বাড়ির আমেজ রয়েছে। আমি নিজের বাড়ি নতুন করে সাজাব যখন, তখন এ রকম ভাবে দেওয়ালটা করব। বড় বড় আলো জামদানি শা়ড়ি দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া, আর্চের আকারে দরজা বানানো, মাটির বা়ড়ির মতো দেওয়াল— সবই চোখ টানছে।’’

এ বার সিয়েনার মূল আকর্ষণের পালা। অর্থাৎ খাবার। গত প্রায় ১০ বছর ধরে সিয়েনা খাবারদাবার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছে। একেবারে স্থানীয় খাবারকে আন্তর্জাতিক মোড়কে পরিবেশন করে তারা। একতলায় ক্যাফের মেনুতে বহু বছর ধরেই চা-কফির সঙ্গে ফিউশন ধারার খাবারদাবার পাওয়া যেত। মাঝেমধ্যে বিশেষ উপলক্ষে নতুন খাবার রাখা হত। সেগুলির মধ্যে একাধিক পদ অতিথিদের এতই পছন্দ হয়ে যায় যে, তাঁরা চান, সারা বছরের মেনুতেই সে সব খাবার থাকুক। তবে তার জন্য বড় জায়গা, বড় রান্নাঘর, অতিথিদের খেতে দেওয়ার পাকাপোক্ত জায়গার দরকার ছিল। সেই শখপূরণেই তৈরি হয়েছে দোতলা। ‘খাওয়ার ঘর’-এ মধ্যাহ্নভোজন ও নৈশভোজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশেই বানানো হয়েছে ছোট্ট এক বার কাউন্টার, যেখান থেকে মজাদার সমস্ত ককটেল পরিবেশন করা হয়। নাম দেওয়া হয়েছে, ‘বারাবাড়ি’।

‘খাওয়ার ঘর’-এ মধ্যাহ্নভোজন ও নৈশভোজের ব্যবস্থা হয়েছে গোটা বছর জুড়ে।

‘খাওয়ার ঘর’-এ মধ্যাহ্নভোজন ও নৈশভোজের ব্যবস্থা হয়েছে গোটা বছর জুড়ে। নিজস্ব চিত্র।

সিয়েনায় খাবার টেবিলে আসার সঙ্গে সঙ্গে দু’ধরনের অনুভূতি একসঙ্গে হয়। চেনা এবং অচেনা। দূরের এবং একান্ত কাছের। চেনা খাবারের অচেনা মোড়ক। একই উপকরণ নিয়ে রান্না, অথচ ভাপা, কষা, ভাজার সমীকরণের বাইরে বেরিয়ে রাঁধা হয়। যেমন, চিংড়ি লেস ডাম্পলিং। রবিবার দুপুর হোক বা সারা বছরের পার্বণ, বাঙালি বাড়িতে চিংড়ির মালাইকারি হলে সে দিন কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া হয়। বাঙালির সেই স্বাদ আর চিনের ডাম্পলিং সংস্কৃতিকে একত্র করার চেষ্টা করা হয়েছে। চিংড়ি দিয়ে তৈরি ডাম্পলিং পরিবেশিত হয় মালাই ঝোলে। মালাইয়ের ঝোল মাখা ডাম্পলিং মুখে দিলেই যেন গলে যাচ্ছে। পরের খাবারটি টেবিলে আসতেই স্ট্রবেরিপ্রেমী বিব়ৃতি এক এক করে ফল মুখে পুরলেন। স্ট্রবেরির সঙ্গে নানাবিধ শাকপাতা। তবে এটি মূল খাবার নয়, এ কেবল গার্নিশিংয়ের অংশ। খাবারের মূল অংশ বানানো হয়েছে ভেটকি মাছ দিয়ে। কিন্তু ঝোল বা কষা নয়, একেবারে স্ট্যু! মাছের স্যুপ বললেও ভুল হয় না। পরের পদ কাঁকড়া ক্যারামেল। ছাঁকা তেলে ভাজা মুচমুচে ও নরম কাঁকড়া। তার পর ঝোলা গুড়, তেতো শাক দিয়ে মুচমুচে কাঁকড়া ভাজা পরিবেশিত হয়। বিবৃতি বলছেন, ‘‘প্রায় প্রত্যেকটা খাবারই ফিউশন। বাঙালি আর বিদেশি খাবারকে খুব সুন্দর করে মেলানো হয়েছে। শুরুতে নামগুলো খটোমটো লাগতে পারে, অথবা খাবার নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে, কিন্তু চেখে দেখলে বোঝা যাবে, সম্পূর্ণ নতুন খাবার। অর্ধেকটা চেনা, অর্ধেকটা অচেনা। কলকাতা শহরে তত বেশি ফিউশন খাবার আমরা পাই না, তার উপর এত সুস্বাদু! যেমন ধরা যাক, মটনের ভেজা ফ্রাই। ভেজা ফ্রাই তো আমরা সবাই খাই। কিন্তু সেটি যদি চিনের রেসিপি মেনে রান্না করা হয়? সয়া সসের মতো কিছু চাইনিজ় উপকরণ দিয়ে মটনের ভেজা ফ্রাই বানানো হয়েছে। মুচমুচে কোটিংয়ের ভিতরে নরম তুলতুলে ভেজা ফ্রাই। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও খেতে ভারি ভাল।’’ বিবৃতি মাছ খেতে পছন্দ করেন না। অথচ ভেটকি এবং চিংড়ির এই খাবারগুলি বেশ তৃপ্তি করে খেয়েছেন। পাশাপাশি শীতের সন্ধ্যায় লিকার মেশানো হট চকোলেটও পান করলেন তিনি।

মেনুতে আরও নতুন খাবারের সংযোজন।

মেনুতে আরও নতুন খাবারের সংযোজন। নিজস্ব চিত্র।

নতুন সিয়েনায় ক্যাফের মেনুতে যোগ হয়েছে কাঠের আগুনে বেক করা পিৎজ়া। প্রন অ্যান্ড ক্যালামারি পিৎজ়া, পেপারোনি পিৎজ়া, চিলি গার্লিক বেসিল পেস্তো পিৎজ়া, আরও কত কী! দোতলায় মিষ্টির পদে নতুনত্ব এসেছে। তা সে কাঁচালঙ্কার আইসক্রিম হোক বা দুধপুলি ও পান্ডান অয়েল হোক। তবে সবচেয়ে মজাদার সংযোজন হল, গলাভাত। রাধাতিলক, গোবিন্দভোগ, চিনেকামিনী চাল দিয়ে তৈরি গলাভাত, তার সঙ্গে সব্জির খোসা দিয়ে বাটা বা ভর্তা অথবা ভাজা। বাটা তৈরির জন্য মিক্সার গ্রাইন্ডার ছেড়ে শিলনোড়ায় ফিরে গিয়েছেন সিয়েনার রন্ধনশিল্পীরা।

দোতলার মেনুতে আবার উৎসবের মরসুমের কথা মাথায় রেখে নতুন খাবার রান্না করা হচ্ছে। শীতের সব্জি রোস্ট করে, তার সঙ্গে লাবড়া সস আর ব্যান্ডেল ক্রিম, অথবা গ্রিল করা শিমের সঙ্গে আচারি হল্যান্ডাইজ় সস ও পার্মেসান চিজ়, কিংবা হার্ব স্যালাড দিয়ে মাশরুমের পট পাই, বা ভেটকির পট পাই, অথবা পাঁঠার মাংসের পট পাই, বা রাম বলের সঙ্গে ঘি আইসক্রিম ও নলেন গুড়ের গুঁড়ো, বার্বান ব্রেডের পুডিং, প্লাম কেক ও বাটারস্কচে টক ক্রিম, এমনই নানা ধরনের নতুন নতুন খাবারের সন্ধান মিলল নতুন সিয়েনায়।

সিয়েনায় বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়।

সিয়েনায় বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।

সিয়েনার মেনু জুড়ে চেনা নামের পাশে অচেনা শব্দ। আর এই ভাবেই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকের মেলবন্ধন হয়েছে তাদের হেঁশেল জুড়ে।

২০২৫ সালের অগস্ট থেকে তিনতলায় ‘রান্নাঘর’ খুলেছে সিয়েনা। যেখানে খাবার অর্ডার করা যায় না নিজের মতো। রন্ধনশিল্পী নিজের পছন্দ মতো খাবার রান্না করবেন, পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন, আর সেটি চেখে দেখবেন অতিথিরা। মোট ১৩টি পদের কোর্স থাকবে। পাত পেড়ে খেতে বসতে হবে সেখানে। কিন্তু ৮ জনের বেশি বুকিং নেওয়া হচ্ছে না এখনই। ‘বসার ঘর’ বা ‘খাওয়ার ঘর’-এ অতিথিদের অর্ডার মতো রান্না করতে হয়। কিন্তু রন্ধনশিল্পীদের তাতে মন ভরে না। রোজ নতুন কিছু সৃষ্টির যে তাগিদ, তা মেটানোর জন্য তৈরি হয়েছে ‘রান্নাঘর’। যেখানে প্রতি পদে থাকবে চমক। এ পার বাংলা, ও পার বাংলা, গ্রামবাংলা, শহুরে বাংলা— সব কিছুকে এক ছাদের তলায় আনতে চেয়েছে সিয়েনা।

বাঙালির একান্ত নিজস্ব খাবার, রান্নার শৈলী, খাদ্যাভ্যাসকে দেশের অন্যান্য সংস্কৃতি ও বিশ্বের কাছে তুলে ধরে সিয়েনা। সেই কাজকেই আরও বিস্তৃত করতে গোটা বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে তারা। ২০২৫ সাল শেষ হওয়ার আগেই সম্পূর্ণ নতুন ভাবে জনপ্রিয় হল সিয়েনা। যেখানে বাঙালিয়ানাকেও নতুন ভাবে চেনার সুযোগ দিচ্ছে তারা।

Sienna Cafe Kolkata Cafe
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy