Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আচমকা সংজ্ঞা ছিনিয়ে নিমেষেই মারমুখী

ক’দিন ধরে সর্দিকাশি চলছিল। গলায় ব্যথা। এসি’তে ঢুকলে কাঁপুনি। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া পরীক্ষায় কিছুই মেলেনি। তাই ঠান্ডা লেগেছে ভেবে চাদর-মাফলার জড়িয়ে দিব্যি অফিস করছিলেন দেবব্রত বসু।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ০২:৪২
Share: Save:

ক’দিন ধরে সর্দিকাশি চলছিল। গলায় ব্যথা। এসি’তে ঢুকলে কাঁপুনি। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া পরীক্ষায় কিছুই মেলেনি।

তাই ঠান্ডা লেগেছে ভেবে চাদর-মাফলার জড়িয়ে দিব্যি অফিস করছিলেন দেবব্রত বসু। কিন্তু এক দিন অফিস থেকে সন্তোষপুরের বাড়ি ফিরে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন বছর পঁয়তাল্লিশের ভদ্রলোক। পরিজনেরা পর দিন ধরাধরি করে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। সেখানেও চোখ উল্টে যায় যায় অবস্থা। ঠাঁই হল হাসপাতালে।

একবালপুরের নুরউদ্দিনেরও প্রায় এক হাল। বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়ের বেশ ক’দিন ধরে জ্বর আসছিল-যাচ্ছিল। মুখে অরুচি। দু’বার করে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া পরীক্ষায় কিছু ধরা পড়েনি। সাত দিনের মাথায় দেখলেন, খেতে পারছেন না। জিভ যেন ভিতরের দিকে টানছে! শেষে এক সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই পড়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরল না বহু ক্ষণ। আইসিসিইউয়ে ঢোকাতে হল।

ভবানীপুরের সৌম্য দত্ত অবশ্য যথেষ্ট সাবধানী। গরম জামা চাপিয়ে মর্নিং ওয়াকে বেরোচ্ছিলেন, বাড়িতে ফ্যানও বন্ধ। তবু কাশিতে ধরল। কিছুতেই থামে না! কফে গলা ভর্তি। রক্তপরীক্ষায় কিছু না-মেলায় টনসিলাইটিসের চিকিৎসা হল। এক দিন জল খেয়ে বমি, সঙ্গে রক্ত। চার দিন হাসপাতালে থেকেও উঠে বিছানায় বসতে পারছেন না পঞ্চাশের প্রৌঢ়।

দেবব্রত, নুরউদ্দিন, সৌম্য— তিন জনের অসুস্থতা কিন্তু একটি সূত্রে গাঁথা। হাসপাতালে ভর্তির পরে তিন জনেরই রক্তে ডেঙ্গির হদিস মিলেছে। এবং তিন জনেরই প্লেটলেট কাউন্ট নেমে গিয়েছে ৭০ হাজারের নীচে! হাসপাতালে আসার আগে দেবব্রতের প্লেটলেট কাউন্ট ছিল দেড় লক্ষের আশপাশে। নুরউদ্দিনের ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে দু’লক্ষ। সৌম্যবাবুর ক্ষেত্রেও আগে তা দেড় লক্ষের নীচে নামেনি।

তাই তিন জনকেই ডাক্তারেরা প্রথমে নিদান দিয়েছিলেন, চিন্তার কারণ নেই। এখন ওঁদের অবস্থা দেখে পরজীবী-বিশেষজ্ঞদের অনেকে হতভম্ব। এক জনের বিশ্লেষণ, ‘‘ডেঙ্গির ভাইরাস রক্তের ভিতরে ঘাপটি মেরে ছিল। পরীক্ষার জালে ধরা তো দেয়ইনি, উল্টে নিঃশব্দে বংশবিস্তার করে গিয়েছে। মওকা বুঝে হঠাৎ টেনে নামিয়ে দিয়েছে প্লেটলেটের সংখ্যা। তাতেই শক সিনড্রোম।

সংজ্ঞা বিলোপ।’’

হাসপাতাল জানিয়েছে, ডেঙ্গি-হামলায় নুরউদ্দিন ও সৌম্যর লিভার, কি়ডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সৌম্যর তো মস্তিষ্কেও সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। তাই জ্ঞান ফিরছিল না। শুক্রবার সকালে তিনি চোখ মেলে চাওয়ায় পরিজনেরা যেমন স্বস্তিতে, তেমন ডাক্তারও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কিন্তু ডেঙ্গি-রোগীরা এ ভাবে আচমকা জ্ঞান হারাচ্ছেন কেন?

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা তথা পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর ব্যাখ্যা, ‘‘এ বার দেখতে পাচ্ছি, রক্তের প্যাকড সেল ভলিউম (লোহিতকণিকার ঘনত্ব, সংক্ষেপে পিসিভি) বেড়ে যাচ্ছে। এটা রক্তে জলের পরিমাণ কমার লক্ষণ। জল এতটাই কমছে যে, মস্তিষ্কে অক্সিজেন ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে না। অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন।’’

এমনই এক রোগী এ দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে বলেন, ‘‘বুধবার রাতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলাম। বৃহস্পতিবার সকালে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েও তা-ই। ডাক্তার বলছিলেন, ব্রেনে অক্সিজেন ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে না।’’

হাসপাতালে ভর্তির সময়ে তিনি নিজেও ব্যাপারটা কিছুটা টের পেয়েছেন। ‘‘নিজের নামের বানান ভুল করেছি। স্ত্রীর মোবাইল নম্বরও ভুল লিখেছিলাম। শুনলাম, পিসিভি বেশ কমে গিয়েছে।’’— বলছেন ওই রোগী। পুরো এক দিন স্যালাইন চলার পরে উনি অনেকটা সুস্থ। এ দিন বিকেলে ওঁর মন্তব্য, ‘‘মাথা অনেকটা হাল্কা লাগছে। ঠিক সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বেঁচে গিয়েছি।’’

এ দিকে কলকাতা ও আশপাশে একটু-একটু ঠান্ডা পড়ছে। বিশেষজ্ঞেরা আশায় ছিলেন, তাপমাত্রা নামার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গি-জীবাণুর সক্রিয়তা ও মশা কমবে। কিন্তু এখনও তেমন ইঙ্গিত নেই। ‘‘বরং আইডি’তে দেখেছি, সার দিয়ে ডেঙ্গি রোগী ভর্তি! বয়স্কদের সংখ্যা বেশি।’’— পর্যবেক্ষণ বেলেঘাটার কেন্দ্রীয় সংস্থা নাইসেড-এর এক বিজ্ঞানীর। এমনও দেখা যাচ্ছে, এক বাড়িতে চার জনের ডেঙ্গি! যার কারণ হিসেবে ডাক্তারদের ব্যাখ্যা: এই সময়ে বাড়ির জানলা-দরজা বন্ধ থাকে। ডেঙ্গি-জীবাণুর বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশা ঘরে এক বার ঢুকলে সহজে বেরোতে পারে না। তার কামড় খাওয়া প্রত্যেকের ডেঙ্গি হতে পারে। এক প্যাথলজিস্ট বলেন, ‘‘যার রক্ত পরীক্ষায় কোনও বার ডেঙ্গির নামগন্ধ ছিল না, ক’দিন বাদে তাঁরই রক্তের স্যাম্পেলে বিপুল ডেঙ্গি-ভাইরাস! ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক।’’

এবং এই প্রসঙ্গেই উঠে আসছে ধন্দ— ডেঙ্গি ভাইরাসের জিনতত্ত্ব কি বদলে গেল?

অমিতাভবাবু যেমন বলছেন, ‘‘পরজীবীরা পরিবেশ টিকে থাকতে হামেশা নিজের জিন-চরিত্র বদলে ফেলে। ডেঙ্গি-জীবাণুও ফেলেছে কিনা, গবেষণা জরুরি।’’ বস্তুত একটা রোগে এ বার এত ধরনের উপসর্গ দেখে ওঁরা বেশ অবাক। আইসিএমআরের এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘শরীরে ঘাপটি মেরে বসে থেকে ডেঙ্গি-ভাইরাস হঠাৎ ছোবল মারছে কেন, বুঝতে পারছি না।’’ ডেঙ্গির কোন প্রজাতির জীবাণু সক্রিয় হচ্ছে, তা যাচাই করে দেখে নাইসেড। তাদের একাংশও জিনগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কী রকম?

নাইসেডের এক বিজ্ঞানী বলেন, ‘‘ডেঙ্গি-জীবাণুর যে চারটি প্রজাতি (ডেঙ্গ-১, ডেঙ্গ-২, ডেঙ্গ-৩ ও ডেঙ্গ-৪), সেগুলো যতো কম পরিমাণেই রক্তে থাকুক না কেন, এলাইজা টেস্টে ধরা পড়বেই। একমাত্র জিনগত পরিবর্তনের দরুণ নতুন কোনও প্রজাতির জন্ম হয়ে থাকলে এলাইজায় ধরা না-ও পড়তে পারে।’’

তেমনটা সত্যিই ঘটেছে কিনা, পরীক্ষা করে দেখার সময় এসে গিয়েছে বলে মনে করছেন ওঁরা। ‘‘এ বারের ডেঙ্গি-পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেই আমরা গবেষণায় হাত দেব। নমুনা জোগাড় করছি।’’— বলেছেন নাইসেডের বিজ্ঞানীটি। পরজীবী-বিশেষজ্ঞদের অনেকেরও অভিমত, অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা নাইসেড-কে দিয়ে ডেঙ্গির নতুন উপসর্গ সম্পর্কে আম-চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিলে আগামী বছরগুলোয় রোগ মোকাবিলা সহজ হবে।

রাজ্য সরকারের কী মনোভাব?

স্বাস্থ্যভবনের একাধিক সূত্রের বক্তব্যে অবশ্য তেমন কোনও পরিকল্পনার আঁচ নেই। ডেঙ্গির ভোলবদল নিয়েও স্বাস্থ্য-কর্তারা বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নন। উল্টে তাঁদের দাবি, আবহাওয়া পাল্টানোর সঙ্গে রাজ্যে ডেঙ্গির প্রকোপ কমছে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সঙ্কট মিলিয়ে যাবে।

আশার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক থাকবে কিনা, সময়ই বলে দেবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dengue debdut ghoshthakur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE