Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জীবনযাত্রার কারণেই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে রোগ

স্থূলতা, মানসিক অবসাদ বা ডায়াবিটিস— জীবনযাপনের ধরন ডেকে আনছে এমন সব রোগ। বায়োলজিক্যাল ক্লকের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হতে দিলেই বিপদ। লিখছেন দেবদূত ঘোষঠাকুরস্থূলতা, মানসিক অবসাদ বা ডায়াবিটিস— জীবনযাপনের ধরন ডেকে আনছে এমন সব রোগ। বায়োলজিক্যাল ক্লকের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হতে দিলেই বিপদ।

দুশ্চিন্তা রাত জেগে কাজ করার অভ্যাস ডেকে আনতে পারে নানা রোগ। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

দুশ্চিন্তা রাত জেগে কাজ করার অভ্যাস ডেকে আনতে পারে নানা রোগ। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:৫৩
Share: Save:

অফিস থেকে ফিরে অনেক ক্ষণ মাথা চেপে বসেছিলেন বছর তিরিশের সুব্রত পাল। মা খাওয়ার জন্য দু’বার ডেকে গেলেও সাড়া দেননি। বাবা কিছুটা রাগ দেখিয়েই ছেলেকে হাত ধরে তুলতে গেলেন। সুব্রতর মাথা এক দিকে ঝুলে পড়ল। ডাক্তার এলেন। বালিগঞ্জের বাসিন্দা ওই যুবককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানিয়ে দিলেন, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর।

সুব্রত যে হাইপার টেনশনের রোগী তা জানতেই পারেননি তাঁর বাবা-মা। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার লড়াইটা সুব্রতের শরীর নিতে পারেনি। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি সুব্রত। তাতেই হয়তো এমন বিপত্তি— এই বিশ্লেষণ সুব্রতর এক বাল্যবন্ধুর, যিনি পেশায় হৃদ্‌রোগ চিকিৎসকও।

ওই বাল্যবন্ধুর কথায়, চাকরিতে ঢোকার পরেই সুব্রতর রাতে ঠিক মতো ঘুম হত না। ইদানীং সিগারেট খাওয়া ধরেছিলেন। সঙ্গে মদ্যপান। রোল, বার্গারেই অধিকাংশ দিন দুপুর ও রাতের খাবার সারতেন। হৃদ্‌রোগ চিকিৎসক ওই বন্ধুর মন্তব্য, ‘‘বছর তিরিশের সুব্রত আসলে লাইফস্টাইল ডিজ়িজের শিকার।’’

স্কুলে সারা ক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতেন সুব্রত। মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানেও খেলার মাঠের ধারকাছে তাঁকে কেউ দেখেননি। পড়াশোনার শেষে ভাল চাকরিও পেলেন তিনি। কিন্তু চাকরিতে যে এত ঝামেলা, তা বোধ হয় অনুমান করতে পারেননি ওই যুবক। তাই সব চাপ একসঙ্গে পড়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন সুব্রত। হৃদ্‌রোগের চিকিৎসক ওই বন্ধুর কথায়, ‘‘নিশ্চয়ই সুব্রতের হৃৎপিণ্ড কিংবা করোনারি আর্টারিতে কোনও সমস্যা ছিল। ছোট থেকে সুব্রতের লাইফস্টাইল বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল হয়তো সেই সমস্যাকেই। তাতেই এই অকালমৃত্যু। পরিবারকে কিছু বুঝতে না দিয়েই চলে গেলেন ওই যুবক।

ছোট থেকে ঠিক জীবনযাপন না করলে কী হয়, তার মাসুল দিচ্ছে সুব্রতর পরিবার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) হিসেবে, বিশ্বে বছরে যত মানুষ মারা যান, তাঁদের ৬০ শতাংশেরই মৃত্যু হয় সংক্রামক নয় এমন রোগে। ৬০ শতাংশের মধ্যে ৪৪ শতাংশের অকাল মৃত্যু হয়। যার কারণ মূলত জীবনযাপন সংক্রান্ত সমস্যা।

অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (অ্যাসোচ্যাম)-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারতে চাকুরিরতা মহিলাদের (২১ থেকে ৫২ বছর) ৬৮ শতাংশ স্থূলতা, মানসিক অবসাদ, পিঠে ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবিটিসের শিকার। এগুলি সবই জীবনযাপন সংক্রান্ত রোগ বা লাইফস্টাইল ডিজ়িজ। ওই সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, সুষম খাবার (ব্যালান্সড ডায়েট) এবং সপ্তাহে পাঁচ দিন কম পক্ষে আধ ঘণ্টার ব্যায়াম এই ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার এক অধ্যাপকের ব্যাখ্যা, শরীরের বিভিন্ন তন্ত্র (সিস্টেম) নির্দিষ্ট ছন্দে চলে। সেই ছন্দটাকেই বলা হয় বায়োলজিক্যাল ক্লক। বায়োলজিক্যাল ক্লকের ভারসাম্য নির্ভর করে খাওয়া, ঘুমোনো, ওঠাবসা, আবেগ এই সব কিছুর উপরে। এই ভারসাম্য বজায় থাকলে ওই সব তন্ত্র স্বাভাবিক থাকে। ভারসাম্য নষ্ট হলেই বিপদ। বায়োলজিক্যাল ক্লকের ভারসাম্য নষ্ট হলে বিভিন্ন তন্ত্র একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে তা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। প্রতিটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াই চাপে পড়ে যায়। এক সময়ে বিভিন্ন তন্ত্রের মধ্যে ছন্দটাই হারিয়ে যায়। আর তাতেই উৎপত্তি লাইফস্টাইল ডিজ়িজের।

কলকাতার এক নামী অস্থি চিকিৎসক শোনাচ্ছিলেন, প্রায় অথর্ব হয়ে যাওয়া ৪২ বছরের এক মহিলাকে সচল করার কাহিনি। রোল, মোগলাই, বিরিয়ানি, চাঁপের ভক্ত ওই পৃথুলা মহিলা কাজ করেন এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায়। সাতসকালে বেরিয়ে যাওয়া, সারাদিন ভুল নকশার চেয়ারে বসে কাজ করে সন্ধ্যায় বিরিয়ানি-রোল খাওয়া। বাড়ি এসেই টিভির সামনে এলিয়ে পড়তেন মহিলা। ওজন বাড়ার কারণে মহিলার শ্বাসজনিত সমস্যা ছিলই, দীর্ঘকাল ওই ভাবে অফিসের চেয়ারে বসতে বসতে প্রথমে পিঠে-কোমরে ব্যথা, এক সময়ে প্রায় ধনুকের মতো বেঁকে যেতে থাকলেন মহিলা। এর পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই হল।

ওই অস্থি চিকিৎসক বললেন, ‘‘মহিলার খাওয়াদাওয়া নির্দিষ্ট করে দিলাম। কী ধরনের চেয়ারে (এর্গোনমিক চেয়ার) তিনি বসবেন, তা ওঁর সংস্থাকে লিখে দিলাম। সেই সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম করতে দিলাম। মহিলার ওজন কমল না, কিন্তু পিঠটা বাঁচল। অক্ষম হতে হতে বেঁচে গেলেন ওই মহিলা।’’

কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অকুপেশনাল হেল্‌থ (এনআইওএইচ)-এর অবসরপ্রাপ্ত এক বিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ, বাড়ি হোক বা অফিস, কারখানা হোক বা চাষের মাঠ— যে যেখানেই কাজ করুন না কেন, তাঁকে কিছু নিয়ম মেনে চলতেই হয়। না হলেই ঘটে যায় বিপত্তি। ওই বিজ্ঞানী বলেন, ‘‘আমরা শরীরকে একটি যন্ত্র হিসেবে দেখি। যন্ত্রের যেমন রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন, তেমনই মানব-যন্ত্রেরও ন্যূনতম রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। কোনও যন্ত্রকে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করলে, খারাপ তেল দিয়ে অয়েলিং করলে সেই যন্ত্র ঠিক মতো কাজ করবে না। মানব-যন্ত্র আরও সংবেদনশীল। তাই তার রক্ষণাবেক্ষণে ঠিক মতো নজর দিতেই হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Disease Lifestyle
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE