Advertisement
E-Paper

দুর্গার জন্মদিনে সুভাষের স্বীকৃতি চান চিকিৎসকরা

ঠিক ৩৭ বছর আগে এই শহরে নিঃশব্দে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল, তাকে এ বার স্থায়ী স্বীকৃতি দিতে চাইছেন এই সময়ের চিকিৎসকরা। আজ, শনিবার ভারতের তথা এশিয়ার প্রথম টেস্টটিউব বেবি কানুপ্রিয়া অগ্রবাল ওরফে ‘দুর্গা’র জন্মদিন।

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:০৯
কানুপ্রিয়া অগ্রবাল (দুর্গা) ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়

কানুপ্রিয়া অগ্রবাল (দুর্গা) ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়

ঠিক ৩৭ বছর আগে এই শহরে নিঃশব্দে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল, তাকে এ বার স্থায়ী স্বীকৃতি দিতে চাইছেন এই সময়ের চিকিৎসকরা।

আজ, শনিবার ভারতের তথা এশিয়ার প্রথম টেস্টটিউব বেবি কানুপ্রিয়া অগ্রবাল ওরফে ‘দুর্গা’র জন্মদিন। এমন যুগান্তকারী সৃষ্টির পরেও স্বীকৃতি দূরে থাক, অবিশ্বাস বিদ্রূপ আর লাঞ্ছনাই জুটেছিল চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কপালে। অপমানে-হতাশায় ১৯৮১ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন। তারই প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে এ বার থেকে ৩ অক্টোবর দিনটিকে ‘জাতীয় গর্ভাধান দিবস’ (ন্যাশনাল ফার্টিলিটি ডে) হিসেবে পালন করতে চান সুভাষবাবুর অনুগামী চিকিৎসকেরা। রবিবার, ৪ অক্টোবর একজোট হয়ে রাজ্য সরকারের কাছে এই দাবি পেশ করবেন তাঁরা। চাওয়া হবে মরণোত্তর ভারতরত্নও। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, দাবির সঙ্গে তাঁরাও একমত। কী ভাবে বিষয়টি বাস্তবায়িত করা যায়, সে নিয়ে তাঁরাও ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন।

বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞদের জাতীয় সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর অ্যাসিস্টে়ড রিপ্রোডাকশন’ বা সংক্ষেপে ‘ইসার’-এর সম্পাদক গৌতম খাস্তগীরের আক্ষেপ, ‘‘সময়ের থেকে প্রায় ২৫ বছর এগিয়ে ছিলেন সুভাষবাবু। তারই খেসারত দিতে হয়েছিল তাঁকে।’’ অভিযোগ, সুভাষবাবু যাতে কোনও ভাবে স্বীকৃতি না পান, সে জন্য এক সময় উঠেপড়ে লেগেছিলেন বহু নামী চিকিৎসক। এমনকী তৎকালীন রাজ্য সরকারও। প্রকাশ্যে তাঁকে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল। ‘‘বিদেশে গিয়ে নিজের কাজ নিয়ে সুভাষবাবু যাতে কথা বলতে না পারেন, সে জন্য তাঁকে ভিসাও দেওয়া হয়নি,’’ বলছিলেন গৌতম। অথচ সুভাষবাবুকে আটকানো না-হলে, চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশই মনে করেন, ব্রিটেনের রবার্ট এ়ডওয়ার্ড এবং প্যাট্রিক স্টেপটো-র সঙ্গে তিনিও নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন। বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জন্মদাতা হিসেবে রবার্ট এবং প্যাট্রিক ২০১০ সালে নোবেল পান। ওঁরা ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই প্রথম টেস্টটিউব বেবিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন। তার ৬৭ দিন পরে সুভাষবাবু। কিন্তু রবার্টদের মতো ল্যাপরোস্কোপ ব্যবহার করেননি তিনি। সে দিক থেকে সুভাষবাবুর কাজ একেবারেই নজিরবিহীন ছিল বলে মনে করে আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান। ‘ইসার’-এর চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন— এখন যে আধুনিক পদ্ধতিতে ওষুধ দিয়ে মহিলাদের শরীরে একাধিক ডিম্বাণু তৈরি করে যোনিদ্বার দিয়ে তা বার করা হয় এবং ভ্রূণ তৈরি করে সংরক্ষণ ( ফ্রোজেন এমব্রায়ো) করা হয়, অত বছর আগে সুভাষবাবু সেই পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। ব্রিটেনের চিকিৎসকদের কাছেও তখন এই উপায় জানা ছিল না।

২০০২ সালে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’ সুভাষবাবুর কাজকে স্বীকৃতি দেয়। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের ‘রয়্যাল সোসাইটি অব মেডিসিন’ তাদের ‘ডিকশনারি অব মেডিক্যাল বায়োগ্রাফি’তে বিশ্বের সেরা ১০০০ গবেষকের মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে রেখেছিল। ‘ইসার’-এর রাজ্য শাখার চেয়ারপার্সন গীতা গঙ্গোপাধ্যায় মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ভ্রূণ তৈরির পরে সেই ভ্রূণকে সুভাষবাবু তরল নাইট্রোজেন-এ হিমায়িত করে রেখেছিলেন। সেই প্রক্রিয়া তখনকার নামী চিকিৎসকেরা বুঝতেই পারেননি। এগিয়ে আসেনি সরকারও। দেরিতে হলেও সুভাষবাবুকে যদি তাঁর প্রাপ্য সম্মান না-জানাই, তা হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’’

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দলের অন্যতম সদস্য এবং বর্তমানে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মেমোরিয়াল রিসার্চ সোসাইটির সম্পাদক সুনীত মুখোপাধ্যায়ও এই প্রস্তাবে অত্যন্ত আনন্দিত। তাঁর কথায়, ‘‘শেষ পর্যন্ত কিছু যে একটা হতে চলেছে, তাতেই আমি খুব খুশি। ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হাসপাতালে জন্মায় বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি মেরি লুইস ব্রাউন। তার আড়াই মাস পরে জন্মায় দুর্গা। পৃথিবীর এক দিকে যখন সৃষ্টিকে ঘিরে উল্লাস, অন্য দিকে তখন ছিল শুধুই অসম্মান।’’ এখনও কানুপ্রিয়া কলকাতায় এলেই দেখা করেন সুনীতবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ভিতরে একটা হাহাকার তো থেকে গিয়েছে। ওঁর সঙ্গে কথা বলে মনে শান্তি পাই। আর প্রতি বছর ১৯ জুন, সুভাষের মৃত্যুদিনে ওঁর মা-বাবার সঙ্গেও যোগাযোগ করি। সুভাষ তো নেই। যোগসূত্রটা আমিই বাঁচিয়ে রেখেছি।’’

কানুপ্রিয়া এখন বিয়ের পরে কানুপ্রিয়া জায়সবাল। কর্মসূত্রে পুণের বাসিন্দা। বহুজাতিক সংস্থার দায়িত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। সংসার পেতেছেন পুণেতেই। নিজেও মেয়ের মা। ছুটিছাটায় কলকাতায় আসেন। এ বারে জন্মদিনের আগের রাতে, শুক্রবার কলকাতা পৌঁছেছেন তিনি। ভবানীপুরে অগ্রবাল পরিবারে এ দিন তাই উৎসবের মেজাজ। বাবা প্রভাত অগ্রবালের কথায়, ‘‘সুভাষবাবুকে স্বীকৃতি জানানো হোক, সেটা আমরাও চাই। আমাদের জীবনটা এমন আনন্দে ভরে উঠেছে ওঁর অবদানেই।’’

আজ, কানুপ্রিয়ার জন্মদিনে ফুল-কেক নিয়ে ভবানীপুর এলাকায় তাঁর বাড়িতে যাবেন ইসার-এর সদস্যরা। রবিবার কলকাতায় ঘটা করে তাঁর জন্মদিন পালনেরও ব্যবস্থা হয়েছে। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘বাঙালিদের যে সবাই ‘কাঁকড়ার জাত’ বলে, সেটা কতটা ঠিক তা সুভাষবাবুর জীবনকে দেখলে বোঝা যায়। এ বার আমরা এককাট্টা হয়ে সেই ভুল শোধরাব।’’

তাঁকে নিয়ে নতুন করে এই তোলপাড়ে কী বলছেন কানুপ্রিয়া নিজে? তাঁর কথায়, ‘‘আমার ভূমিকাটা এখানে নেহাৎই গৌণ। কিন্তু একজন ‘জিনিয়াস’কে এই দেশ যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারল না, সেই লজ্জা আমাদের সকলের। আজ যদি সেই লজ্জা দূর করার কোনও প্রয়াস হয়, আমি সব সময় তার সঙ্গে আছি।’’

কী এই আইভিএফ

ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এমব্রায়ো ট্রান্সফার, সংক্ষেপে আইভিএফ। এই পদ্ধতিতে শরীরের বাইরে ডিম্বাণু-শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে ভ্রূণ তৈরি করে জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই প্রথম গোনাডোট্রপিন নামে একটি ওষুধ বাইরে থেকে শরীরে প্রবেশ করিয়ে নারীশরীরে প্রচুর সংখ্যায় ডিম্বাণু তৈরি করেন এবং প্রসবদ্বারের মাধ্যমে সেই ডিম্বাণু শরীরের বাইরে আনেন। তার পরে তা শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত করা হয়। যে হেতু অনেক ডিম্বাণু তৈরি হয়েছিল, সেই কারণে একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার পরে বাকি ডিম্বাণুগুলিকে হিমায়িত করে পরবর্তী প্রয়াসের জন্য সংরক্ষিত করার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। গোটা পৃথিবী এখন এই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করে।

durga test tube baby india
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy