Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মানসিক রোগীদেরও চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলানো হোক

‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা’-২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী এই রোগের প্রকোপ ভয়াবহ আকারে বাড়ছে।

রত্নাবলী রায় (মানবাধিকার কর্মী)
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৯ ০০:২৯
Share: Save:

মানসিক রোগ নিয়ে আগের চেয়ে জড়তা কেটেছে, সে কথা ঠিক। কিন্তু যতটা খোলা মন এবং স্বচ্ছ ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন, এখনও তা থেকে অনেকটাই দূরে আমরা। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্য নয়, এটা উন্নয়নেরও বিষয়। যাঁদের মানসিক সমস্যা রয়েছে, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে নানা বৈষম্য এবং কলঙ্কের শিকার হতে হয়। তাঁদের উপরে শারীরিক ও যৌন হিংসা বা নির্যাতন হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা কিংবা মানসিক রোগ থাকলে উপার্জন, চাকরি, জীবিকা এবং অর্থনৈতিক অবস্থানও গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়।

‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা’-২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী এই রোগের প্রকোপ ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। এটা মনে রাখতে হবে, মানসিক রোগ— লিঙ্গ, যৌনতা, বয়স, বর্ণ, জাতি, ধর্ম, সক্ষমতা, বর্গ কোনওটাই মানে না। কাজের সূত্রে আমরা জেনেছি, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আরও খারাপ। নারী নির্যাতন, অবহেলা, মেয়েদের গুরুত্ব এবং রোজগারের সুযোগ কম থাকায় তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির পরিমাণ বেশি। অথচ ইস্তাহারে বা রাজনৈতিক প্রচারে মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা কিংবা তাঁদের প্রয়োজনের কথা উঠে আসে না। তবে এই লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম এবং কংগ্রেস সেই স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করেছে। সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক নেতা, দল, সুশীল সমাজেরও এই বিষয় নিয়ে ভাবার প্রয়োজন।

এ দেশে প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে দশ জন আত্মহননের পথ বেছে নেন। অথচ এ দেশেই আমরা দেখি, প্রতি এক লক্ষ মানুষের জন্য কেবল মাত্র এক জন পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী আছেন। এই কম সংখ্যক পেশাদার দিয়ে কী করে আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের উপশম ঘটাব? এরও পরে বলতে হয় একটি অচল বা সেকেলে পদ্ধতির কথা। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা এত বৃদ্ধি সত্ত্বেও রাষ্ট্র বা সরকার সব সময় শুশ্রূষার ক্ষেত্রে মেডিক্যাল মডেলের উপরে জোর দিয়েছে, যার মূল মন্ত্র হল ‘পাগলা গারদে যাও, ওষুধ খাও’। পরিষেবার অপ্রতুলতা এ ক্ষেত্রে মস্ত বড় অন্তরায়। মানসিক রোগী কিংবা মানসিক ভাবে বিপর্যস্তের হাতের কাছে কোনও পরিষেবা নেই। অথবা যে পরিষেবা আছে তা সহজলভ্য নয় বা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। মানসিক স্বাস্থ্যের সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে রোগীদের উপরে অত্যাচার, চিকিৎসার অবহেলা চলতেই থাকে। তার থেকে সুরাহার পথ খুঁজে বার করার চেষ্টা হয় না।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আমাদের দাবি, ২০১৯ সালের লোকসভায় যে সব প্রতিনিধিরা সাংসদ হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন, তাঁরা যেন এ রকম স্পর্শকাতর কিংবা প্রান্তিক বিষয়ের দিকে নজর দেন। যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সে সব বিচার করেন। যাঁরা লোকসভা নির্বাচনে সাংসদ হয়ে আসবেন, তাঁদের কাছে একান্ত অনুরোধ, শুধুমাত্র মেডিক্যাল মডেলের কথা ভাববেন না। ‘পাগলা গারদে যাও, ওষুধ খাও’, এই মডেলের পরিবর্তে চিকিৎসা এবং যত্নের সামগ্রিক মানবাধিকার মডেলের কথা চিন্তা করবেন।

‘মেন্টাল হেল্‌থ কেয়ার ২০১৭’, এই মানসিক স্বাস্থ্য আইনের দ্রুত বাস্তবিক রূপায়ণ আমরা চাই। কারণ, সেই আইনে স্পষ্ট করে লেখা আছে, সব নাগরিকের জন্য

বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়া যাবে। মানসিক স্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী, রাজ্য সরকারকে ‘স্টেট মেন্টাল হেল্‌থ অথরিটি’ দ্রুত তৈরি করতে হবে। ‘মেন্টাল হেল্থ রিভিউ বোর্ড’ গঠন করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যয়-বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আত্মহত্যার ঘটনা এবং ঝুঁকি কমানোয় নজর দিতে হবে। মহিলাদের প্রতি বিশেষ যত্ন দিতে হবে। যে সব মানুষের মানসিক বিপর্যয় হবে তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা নিয়ে গোঁড়ামি কমাতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের দক্ষ কর্মী পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সামাজিক-জৈবিক-মানসিক দিক চিহ্নিত করে সেই মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। শুশ্রূষার প্রতিটি স্তরে দৈনন্দিন ভুক্তভোগী মানুষের অন্তর্ভুক্তি অবশ্যই থাকতে হবে।

আসল কথা হল, ঠান্ডা ঘরে বসে আমলারা নীতি নির্ধারণ করলে চলবে না। পুরনো ধ্যানধারণা ছেড়ে মানসিক রোগীর অধিকারে জোর দিতে হবে। পরিবারের চরিত্র দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। হাজার হাজার রোগী যাঁদের পরিবার বলে কিছু নেই। রাষ্ট্রকেই পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্রকে হাসপাতালের বাইরে অন্য ধরনের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আসলে পরিবারের চরিত্র দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য আইনে স্পষ্ট বলা আছে, রোগীদের যাতে হাসপাতালের ঘরে আটকে রাখা না হয়। অথচ এখানে বেশিরভাগ হাসপাতালে ওয়ার্ড থেকে রোগী বেরোনোর সুযোগই পান না।

রোগী কল্যাণ সমিতিগুলির কাজের পদ্ধতি নিয়েও আমার বক্তব্য আছে। মন্ত্রীমশাই, কেন সমিতির বৈঠকে শুধু পূর্ত দফতরের পাইপ সারানোর মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে? রোগীদের খাবারের মান, ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা কেন আলোচনায় ঠাঁই পাবে না? যখন রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্যেরা যখন হাসপাতালে আসবেন, তখন দয়া করে একটু ওয়ার্ডের ভিতরেও যাবেন। রোগীদের চাওয়াপাওয়ার হিসেবটাও তো মেলাতে হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mental patient Ratnaboli Ray
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE