Advertisement
২২ মার্চ ২০২৩
Organ Transplant

সার্জারির পর কমিয়ে রাখা হয় 'ইমিউনিটি', অর্গ্যান ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে যা জানতেই হবে

রোনাল্ড লি হেরিক আর রিচার্ড জে হেরিক। ক্যালিফোর্নিয়ার এই যমজ ভাই ( আইডেন্টিকাল টুইন) চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু কেন?

দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের নজির আছে কলকাতাতেই। প্রতীকী ছবি।

দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের নজির আছে কলকাতাতেই। প্রতীকী ছবি।

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২০ ১১:৪২
Share: Save:

করোনা আবহে অন্য রোগের ক্ষেত্রে অবহেলার নানা ঘটনা সামনে এসেছে। বিশেষ করে কিডনি, লিভার, হার্টের সমস্যায় প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে মেলেনি তা। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কী বলছেন চিকিৎসকরা? অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে কী ভাবছেন তাঁরা? মরণোত্তর দেহদানের বিষয়েই বা কী মত তাঁদের?

Advertisement

অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে বলতে গেলে কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে হবে। রোনাল্ড লি হেরিক আর রিচার্ড জে হেরিক। ক্যালিফোর্নিয়ার এই যমজ ভাই ( আইডেন্টিকাল টুইন) চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু কেন?

রিচার্ড ক্রনিক নেফ্রাইটিসে ভুগছিলেন। কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন মাত্র ২৩ বছর বয়সে। ঠিক সেই সময় চিকিৎসক জোসেফ মুরে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। যমজ ভাই রোনাল্ডের একটি কিডনি বের করে নিয়ে রিচার্ডের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। বোস্টনের পিটার বেন্ট ব্রিগহ্যাম হাসপাতালে ১৯৫৪ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর এই যুগান্তকারী সার্জারিই বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম অর্গ্যান ট্রান্সপ্লান্ট বা অঙ্গ দান। আর এর জন্যে জোসেফ ১৯৯০ সালে মেডিসিনে নোবেল সম্মান পান।

আরও পড়ুন: ‘ফেল’ নয়, ‘এসেনশিয়াল রিপিট’, সিবিএসই বোর্ডের সিদ্ধান্তে প্রভাব পড়বে পড়ুয়া মনস্তত্ত্বে?

Advertisement

১৯৫০ সালের ১৭ জুন চিকিৎসক রিচার্ড লয়েল ৪৪ বছরের রুথ টাকারের শরীরে সিরোসিস অফ লিভারে মৃত এক মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। কিন্তু ৫৩ দিনের মধ্যে সেটি অকেজো হয়ে যায়। সেই শুরু, তারপর থেকে শুধুমাত্র আমেরিকায় সাড়ে চার লক্ষেরও বেশি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে। কিন্তু অঙ্গ দানের নিরিখে অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে ভারত।

শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার, ফুসফুস, হার্ট, ত্বক, অন্ত্র, কর্নিয়া ইত্যাদি বিকল হয়ে গেলে অন্যের দান করা অঙ্গ অসুস্থ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করে তাঁকে জীবনের আলোয় ফিরিয়ে আনা যায়, কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী অঙ্গ পাওয়া যায় না। দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোনাল্ড আর রিচার্ডের মতোই আত্মীয়-স্বজনদের থেকে একটি কিডনি বা লিভারের অংশ নিয়ে রোগীকে দেওয়া হয়। অথচ সঠিক ব্যবস্থা থাকলে মৃতের শরীরের এইসব অঙ্গ সংগ্রহ করে একজন মৃতপ্রায় মানুষকে অনায়াসে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। এর জন্যে প্রয়োজন সাধারণ মানুষের সচেতনতা।

আরও পড়ুন: খাবারে অনীহা, অল্পে হাঁপিয়ে ওঠে বাচ্চা, জন্মগত হার্টের অসুখ নয় তো?

সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়লে অনেক মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শরীরে মৃতের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে তাকে সুস্থ করে তোলা যাবে, এমনই বললেন লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জেন হীরক পাহাড়ি। হীরক বাবু বললেন, দেশে প্রতি বছর পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় শরীরের কোনও অঙ্গ অকেজো হয়ে। অঙ্গ দানের সাহায্যে এদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মৃত্যুর পর একজন মানুষ অঙ্গ দান করলে কমপক্ষে ছয় জন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব, বলেন হীরক পাহাড়ি।

এবারে জেনে নেওয়া যাক মৃতের কোন কোন অঙ্গ জীবন ফিরিয়ে দেয়। কিডনি, লিভার, হার্ট, কর্নিয়া, ফুসফুস, ত্বক, অন্ত্র, হাড় ও হাড়ের কলা, অগ্ন্যাশয়, বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা মৃতের শরীর থেকে নিয়ে অসুস্থ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করে তাকে জীবনের আলোয় ফিরিয়ে আনা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে অত্যন্ত উন্নত মানের ইমিউনোসাপ্রেসিভ ( রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে রাখা) ওষুধ ব্যবহার করে প্রতিস্থাপনের পর দীর্ঘদিন ভালো থাকা যায়, বললেন নেফ্রোলজিস্ট জয়ন্ত দত্ত। আসলে কিডনি, লিভার বা হৃদপিণ্ডর মত অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর শরীরের ইমিউনিটি অচেনা অঙ্গটিকে ফরেন বডি বা শত্রু মনে করে তাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে। আর এই কারণেই ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির পর ইমিউনিটি কমিয়ে রাখতে হয়, বলেন জয়ন্ত বাবু।

মৃতের শরীরের অঙ্গ সংগ্রহ করে মৃতপ্রায় মানুষকে অনায়াসে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। প্রতীকী ছবি।

যদি মরণোত্তর দেহদানের ব্যপারে সচেতন হওয়া যায়, তাহলে অনেক মরণাপন্ন মানুষই জীবনের আলোয় ফিরবেন। এই প্রসঙ্গে একটা পরিসংখ্যান দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। দেশে প্রতি বছর দুই লক্ষেরও বেশি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করে দৃষ্টিহীনদের আলোর দিশা দেখানো সম্ভব। কিন্তু পাওয়া যায় মাত্র ৫০ হাজার, এমনই বললেন চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ জিতেন্দ্র শাহ। এছাড়া প্রায় ২ লক্ষ মানুষের কিডনি ও এক লক্ষ মানুষের লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। এর মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ মরণোত্তর দেহদান থেকে পাওয়া যায়।

কারও ক্ষেত্রে কাছের মানুষরা নিজেদের কিডনি বা লিভারের অংশ দান করেন, বললেন নেফ্রোলজিস্ট দিলীপ কুমার পাহাড়ি। বাকিরা স্রেফ মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করেন। অথচ ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের নজির আছে কলকাতাতেই। এই ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হওয়ার কথা বলেন দিলীপ বাবু।

আরও পড়ুন: খাদ্যতালিকায় রাখতেই হবে চিনাবাদাম, জেনে নিন কতটা আর কী ভাবে খাওয়া উচিত

অঙ্গ দানের কোনও বয়স নেই। সব থেকে বেশি বয়সের যে মানুষটির পরিবার মরণোত্তর দেহদান করেছেন তার বয়স ৯২। টেক্সাসের ওই ব্যক্তির মস্তিষ্কের মৃত্যু বা ব্রেন ডেথের পর তার কিডনি ও লিভার অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। অন্যদিকে সব থেকে কমবয়সি অর্গ্যান ডোনারের বয়স ১০০ মিনিট। অ্যানেনসেফালি অর্থাৎ মস্তিষ্কই তৈরি হয়নি এমন এক সদ্যোজাত জন্মের পর মাত্র ১০০ মিনিট বেঁচে ছিল। তার কিডনি ও লিভার নিয়ে বেঁচে আছে তিন জন।

করোনা অতিমারির আগে স্পেন ও ইটালিতে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের ৩৫ জন মরণোত্তর দেহ দান করেছে, আমেরিকায় প্রতি ১০ লক্ষে তা ১৪ জন। ভারতে তা এক কোটিতে এক জন। এই ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গও । তাই মরণোত্তর দেহদানের বিষয়ে আরও সচেতন হতে বলছেন চিকিৎসকরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.