ক্যানসার কেবল শারীরিক নয়, অনেকটাই মানসিক লড়াই। ছবি: শাটারস্টক।
ক্যানসার মানেই ‘মারণরোগ’, এই ধারণাতেই কি সব খোয়ানোর আসল বীজটা লুকিয়ে আছে?
আলবাত। এই যে ‘মারণরোগ’ বলে ডেকে আসা, সেই অনুপাতে প্রচার, ক্যানসার মানেই একটা ভয়াবহ কিছু ভেবে বসা— এগুলোই আজও ক্যানসার সেরে ওঠার পথে বাধা। এমনকি, ক্যানসারের চিকিৎসার পথেও এই সব ভয় বিরাট সমস্যা তৈরি করে।
কী রকম?
ক্যানসার নিয়ে ভয়টা এমন পর্যায়ে আজও রয়ে গিয়েছে যে, এমন বহু পরিবার আছেন, যাঁরা একটা ছোট লাম্প ধরা পড়লে, তা আদৌ ক্যানসার কি না তা পরীক্ষা করাতে পর্যন্ত ভয় পান। তার আগেই আমাদের কাছে আসেন মনের জোর ফিরে পেতে। বহু সময় দেখা যায়, ক্যানসার পরীক্ষার রিপোর্ট বেরনোর দিন যত এগোতে থাকে, ততই অ্যাকিউট ডিপ্রেশনে চলে যান সেই সব মানুষ। আর ক্যানসার ধরা পড়লে তো কথাই নেই। আর্থিক চিন্তা, মৃত্যুচিন্তা, সবটাই বড় বেশি করে ঘিরে ধরে মানুষকে।
কিন্তু এই অসুখ যে আয়ুকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ে তা তো ঠিকই, আর্থিক দিকটার কথাও ভুললে চলে না...
এই প্রশ্নের দু’টো ভাগ আছে। আমি এক এক করে বলব। প্রথম ভাগ, আয়ুর প্রসঙ্গ। আজ যে মানুষ ক্যানসারে ভুগছেন, তাঁর মৃত্যু যে ক্যানসারেই হবে তার কিন্তু কোনও মানে নেই। এমনকি, তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকা সুস্থ মানুষরাও যে তাঁর আগেই মারা যাবেন না, এমনও কোনও কথা নেই। আমরা কিন্তু কেউ কারও আয়ুষ্কাল জানি না। কে কী ভাবে মারা যাব তা-ও নয়। তাই প্রথমেই একে ‘মারণরোগ’ বলে দেগে দেওয়াটা অবৈজ্ঞানিক। চিকিৎসক এবং সংবাদমাধ্যম প্রত্যেককেই আমি অনুরোধ করব এই অসুখকে ‘মারণরোগ’ বলে দেগে দেবেন না। ক্যানসারের রোগী ক্যানসার নিয়ে দীর্ঘ দিন বেঁচে আছেন,বা মারা গিয়েছেন অন্য অসুখে এমন উদাহরণ ভুরিভুরি রয়েছে। আবার ক্যানসার রোগীর আগে তাঁর সুস্থ পরিজন অন্য রোগে মারা গেলেন এমনও হয়। এই যে আমরা ক্যানসার রোগীদের মানসিক চিকিৎসা করি, বেরিয়ে হয়তো আমরাই একটা দুর্ঘটনায় মারা গেলাম। সুতরাং ‘মারণরোগ ’ বিষয়টাই ভুল ধারণা। আর আজকাল বেশ কিছু ক্যানসারের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা আছে। থার্ড বা ফোর্থ স্টেজ ক্যানসারের পরেও মনের জোরে বেঁচে আছেন এমন অনেকেই আছেন।
আরও পড়ুন: স্নেহপদার্থ মাত্রই ব্রাত্য নয়, কোন ফ্যাট খাবেন, কোন ফ্যাট খাবেন!
কিন্তু মারাও তে যান অনেকেই...
অবশ্যই। তাতে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু বলুন তো, কেউ তো আমরা অমর নই। প্রত্যেকেই মারা যাব। কারও কারও ক্ষেত্রে কোনও কোনও স্টেজের ক্যানসার হয়তো আয়ুষ্কালটা বেঁধে দেয়। তা বলে মৃত্যুকে এগিয়ে আনে বলেই তাকে মারণরোগ বলব কেন? মারা তো এমনিই একদিন যেতেই হত। তাই সারা ক্ষণ এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে, যে ক’টা দিন কাছে পাচ্ছেন রোগীকে, তাঁকে আনন্দে রাখুন। চিকিৎসাজনিত নিষেধ ছাড়া খুব বেশি বাধা-নিষেধ চাপাবেন না। আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে দিন। আর সারা ক্ষণ এই অসুখ নিয়ে কথা বলবেন না। অন্য বিষয়ে কথা বলুন বরং। এতে এই অসুখের সঙ্গে লড়তে সুবিধা হয়।
আজকাল অনেক রোগীকেই চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, তাঁদের ক্যানসার হয়েছে। রোগীরাও নান ভাবে বুঝে যান। এই জানা কি খুব প্রভাব ফেলে?
জানিয়ে দেওয়াটা অবশ্যই উচিত। খুব দুশ্চিন্তাপ্রবণ মানুষ না হলে আমরা জানিয়ে দিতেই বলি। কারণ, এতে হাতে যেটুকু সময় আছে, তাকে অন্য ভাবে কাজে লাগাতে পারবেন রোগী। প্রথমে যদি লুকিয়ে রাখি আর পরে সে কোনও ভাবে জানতে পারে, তাতে খারাপ প্রভাব আরও বেশি। মন ভাঙার প্রবণতাও বেশি সে ক্ষেত্রে। তাই নিজেও চিকিৎসকের থেকে প্রতিনিয়ত অবস্থাটা কী, তা ভাল করে জানুন, এটুকু জানার অধিকার আপনার আছে। আর রোগীকেও জানান। মনোবিদ, চিকিৎসক, রোগী ও তাঁর পরিজন লড়াইটা কিন্তু সকলের একসঙ্গে। এক জন কেউ পিছিয়ে এলেই এই যুদ্ধ জয় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই সিরিয়াসলি একসঙ্গে লড়াই করুন, ক্যানসার তাতে অনেক সময়ই পিছু হটে।
আরও পড়ুন: জল পরিশুদ্ধ থেকে ওবেসিটি রুখে দেওয়া, এই বোতলের জাদুই এমন!
অনেক সময় দেখা যায়, রোগীর বাড়ির পরিজনরা রোগীর আয়ুর সঙ্গে আর্থিক বিষয়টি নিয়েও ভাবছেন, সে ভাবনা তো অমূলক নয়!
আজকাল কিন্তু ক্যানসারের নানাবিধ চিকিৎসা বেরিয়েছে। বেশি ভাবতে গিয়ে সময় নষ্ট করাটা এই সব অসুখে কখনও কাম্য নয়। হয়তো দেখা গেল রেডিয়েশান বা ওরাল কেমোতে যা ভাল হতে পারত, তা ভাবার জন্য সময় দিতে গিয়ে অনেকটা গাড়িয়েছে। তাই সময় নষ্ট করবেন না। দরকারে আর্থিক দিক নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। এখন খুব কম খরচে কেবলমাত্র ব্যথা কমানো বা প্রাথমিক স্তরের নিরাময়ের জন্য ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’-এর মতো পরিষেবাও আছে। সরকারি হাসপাতালেও কিন্তু ক্যানসার চিকিৎসার খরচ বেশি নয়, এবং আজকাল পরিকাঠামোও বেশ ভাল। সরাসরি কথা বলুন চিকিৎসকের সঙ্গে। এবং রোগীর সঙ্গেও। অনেক সময়ই দেখা যায় রোগীও পরিবারের আর্থিক দিক নিয়ে বেশি চিন্তা করেন ও তাঁর মধ্যে একটা ‘অপরাধবোধ’ কাজ করে। এটা চরম ক্ষতিকর। ক্যানসারের আগেই এই মানসিকতা খুন করে ফেলে মানুষকে।
অনেক রোগীর ক্ষেত্রে ক্যানসার শুনলেই বাঁচার ইচ্ছা চলে যায়, আত্মহত্যাও করে বসেন অনেকেই। এটাও কি একটা মানসিক লড়াইয়ে হেরে যাওয়া মাত্র?
অনেকটাই তাই। আসলে আমরা সারা ক্ষণ রোগীর চারপাশে তাঁর অসুস্থতা নিয়ে কথা বলি, কোনও কোনও পরিবারে খুবই অসহযোগিতা ও অযত্ন পান রোগী। একটু বয়স হয়ে গেলে ক্যানসারের ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুও করান না অনেকে। কেউ কেউ আবার রোগীকেই নানা ভাবে দায়ী করেন। এগুলো স্রেফ মানবিকতার অভাব। অনেক সময় রোগী একাকিত্বেও ভোগেন। রোগের যন্ত্রণার সঙ্গে এ সব ও যোগ হয় আত্মহত্যার নেপথ্যে। তাই রোগীকে একা হতে দেবেন না। দায়ী করবেন না। বরং পাশে থাকুন, আনন্দে রাখুন তাঁকে। আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে অন্তত ‘প্যালিয়াটিভ কেয়ার’টুকু নিন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন, সরকারি হাসপাতালে রাখা যায় কি না ভাবুন।
আরও পড়ুন: এই সব লক্ষণ দেখলেই সাবধান, অজান্তে ডায়াবিটিস দানা বাঁধেনি তো?
পাশে আছি: এই বার্তাই ক্যানসার আক্রান্তের লড়াই অনেক সহজ করে দেয়।
কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো কি একই থাকে? সেখানে অভিভাবকদের মনের অবস্থা তো মোটেই স্বাভাবিক রাখা যায় না!
হ্যাঁ, দীর্ঘ দিন মনোবিদ্যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কারণে ও পেশাগত ভাবে এমন অনেক শিশুর পরিবারকে কাছ থেকে দেখার জন্য ক্যানসার-ঝড় কী ভাবে একটা বাড়ির পরিবেশকে লণ্ডভণ্ড করে দেয় তা বুঝি। তবে মজার বিষয়, শিশুরা কিন্তু অনেক বেশি জীবনীশক্তির অধিকারী। তাই তারা এমন অসুখকে বড়দের থেকে বেশি তাড়াতাড়ি জয় করে ফেলে। তাই তাদের সবটা না বললেও অন্তত তার একটা শক্ত অসুখ আছে তা বলুন, যাতে সে নিজেও সতর্ক থাকতে পারে। জানান, তার যথোপযুক্ত চিকিৎসা চলছে। অতএব ভয়ের কিছু নেই।
তবে ‘মা আমি কি আর বাঁচব না?’ টিনএজে পৌঁছনো অনেক শিশুই নিজের ক্যানসার জানার পর এই প্রশ্ন তার অভিভাবকের কাছে করে। তখন নিজেকে ধরে রাখা মুশকিল। তবে তার অভিভাবকদের বলব, জানি কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। তাই কষ্ট পাবেন না এমন নির্বোধ স্তোক দেব না। তবে বলব, কোনও ভাবেই চিকিৎসা বন্ধ করবেন না, খুব কষ্ট হলে ওকে জড়িয়ে ধরে আপনিও কাঁদুন। হালকা হোন। কিন্তু তার পরেই হতাশায় চলে যাবেন না। বরং শোকতাপ সামলে ফের উঠে দাঁড়ান লড়াইটা চালানোর জন্য। এতে ওর কষ্টও কমবে। আর কে বলতে পারে, হয়তো আপনাদের এই যৌথ লড়াই কোনও মির্যাকল ঘটিয়ে দিল!
(গ্রাফিক: তিয়াসা দাস)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy