E-Paper

গরমের ‘শীতল’ভোজ

শহরের উষ্ণতম দিনগুলোয় এমন খাবার বেছে নিন, যাতে শরীর, মন দুই-ই ঠান্ডা থাকে। এ পার বাংলা, ও-পার বাংলার খাবারে শরীর ঠান্ডা রাখার অনেক উপকরণই মজুত।

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৩৪
A Photograph of a dish

পানিফলের তরকারি। ফাইল ছবি।

গরমের ছুটিটা ছিল ছোটবেলার রূপকথা। সেই ছুটির দুপুরগুলো ছিল লুকোচুরি, হজমিগুলি আর কাঁচা-পাকা আমে ভরা। গাছপাকা আমের মাথায় ফুটো করে তার রসাস্বাদন চলত বিকেল পর্যন্ত। শেষবিকেলে একটা বড় জামবাটি নিয়ে বসতেন ঠাকুমারা। কাঁচা আম ঝিরিঝিরি করে কেটে তাতে এক খাবলা আখের গুড়, বিট নুন, কাসুন্দি, লঙ্কা ঠেসে তৈরি হত আমমাখা। মুখে দিলে একেবারে ব্রহ্মতালু অবধি বিদ্যুৎ খেলে যেত। তবু তপ্ত দুপুরশেষে বৈশাখী বিকেলে সেই আমমাখা চাই-ই চাই। আর তার পরে কুঁজো থেকে ঢেলে ঠান্ডা-ঠান্ডা জল। পাড়ায় দু’এক বাড়িতেই তখন ফ্রিজ। কিন্তু কুঁজোর পাত্রে সেই সোঁদা মাটির গন্ধ আর ঠান্ডা জলের সঙ্গতে যেন স্বর্গীয় স্বাদ তৈরি হত। সন্ধে নামার মুখে কোনও কুলফিওয়ালা পাড়ায় এলে তো কথাই নেই। ডাব কুলফি, মালাই কুলফি হাতে সেই সন্ধে তোফা কাটত।

এই ঊর্ধ্বগামী তাপমানের দিনে গাছগাছালিতে ঢাকা শৈশবের ছায়া পাওয়া মুশকিল। কিন্তু বোশেখের গরমে পেট ঠান্ডা রাখার কিছু উপায় বার করা যায়। এ পার বাংলা, ও-পার বাংলার খাবারে শরীর ঠান্ডা রাখার অনেক উপকরণই মজুত।

ধন্য ধন্য মুড়ি তুমি...

আসি এই বঙ্গভূমি/ উদ্ধারিছ বঙ্গবাসীজন... চিঁড়ে, মুড়ি, খই তো বাংলার ঘরের লোক বলা যায়। তার সঙ্গে আম-দই মেখে নিলেই প্রাতরাশ সম্পূর্ণ। দই মুড়ি, গুড়-মুড়ি, দুধ-মুড়ি তো রইলই। কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা ও আমতেলের সঙ্গতে ছাতুমাখা দিয়ে মুড়ি খেতে পারেন। ছাতুর শরবতেও পেট ঠান্ডা থাকে। আবার মুগ ডালেও সারতে পারেন প্রাতরাশ। আগের দিন রাতে খানিক মুগের ডাল ভিজিয়ে রাখুন। সকালে অল্প শসাকুচি, পাতিলেবুর রস আর নুন দিয়ে খাবার তৈরি। মিষ্টিমুখীরা চিনি দিয়েও খেতে পারেন ভেজানো মুগ ডাল। দুধ-সাবু বা নুন, পাতিলেবু-লঙ্কা দিয়ে সাবুমাখাও রাখতে পারেন সকালের খাবারে। সাহেবি কায়দায় সুপ, স্যালাডও রইল। তবে অবশ্যই কোল্ড স্যালাড বা কোল্ড সুপ। শসা, তরমুজের টুকরো কেটে উপরে অল্প নুন, লেবুর রস ও নারকেল কোরা ছড়িয়ে দিন। তার পর ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে খান।

Cold Salad

কোল্ড স্যালাড ফাইল ছবি।

কাঞ্জিবড়া দুগ্ধচিড়া দুগ্ধলকলকী

দুপুরের কড়া গরমে ও চড়া রোদে ভরসা রাখতে পারেন পান্তা ভাতে। কাঞ্জি অর্থাৎ পান্তা ভাতের জল, শরীর ঠান্ডা রাখার মোক্ষম দাওয়াই। তবে পান্তা করতে ভাতের ফ্যান ঝরিয়েই তাতে জল ঢালবেন না। ভাত ঠান্ডা হলে জল দিয়ে সাত-আট ঘণ্টা রেখে দিন। পান্তা খাওয়ার পাতে মেখে নিন গন্ধরাজ লেবুর রস আর পাতা। সঙ্গে ছাঁচি পেঁয়াজ ও আলু চোখা থাকলেই পান্তার আয়োজন সম্পূর্ণ। পান্তার জল অর্থাৎ কাঞ্জিও পুষ্টিকর। তা যেমন শরীর ঠান্ডা রাখে, তেমনই পুষ্টিগুণে ভরপুর। কাঞ্জির মধ্যে গন্ধরাজ লেবুর রস, নুন, চাট মশলা ও অল্প আখের গুড় মিশিয়ে নিন। আখের গুড়ে শরীর ঠান্ডা হবে।

গরমে ভাত সহজপাচ্য। তাই রুটির বদলে এ সময়ে ভাতই ভাল। প্রয়োজনে দই-ভাত রেঁধে নিন। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর রান্না অনুসরণে, প্রথমে পাত্রে ঘি দিয়ে তার মধ্যে গোবিন্দভোগ বা ভাল চাল, কিশমিশ, শুকনো লঙ্কা দিয়ে নাড়াচাড়া করে নিন। এর মধ্যে ফেটানো টক দই, নারকেল কোরা, হিং ও কারিপাতা মেশাতে হবে। চালের দ্বিগুণ পরিমাণ জল দিয়ে ভাত রান্না হলে নামিয়ে নিন। এটি ঠান্ডা করে খান। টক দই গরমে পেট ঠান্ডা রাখবে। একই ভাবে দইয়ের বদলে আনারস দিয়েও রাঁধতে পারেন ভাত। তবে তাতে আখের গুড় পড়বে খানিক।

তেতোর বদলে টক

কী খাবেন যেমন জানা জরুরি, বাদ দেওয়ার তালিকাও জেনে রাখা ভাল। বেশি ঝাল, মশলা বা হাই প্রোটিন আপাতত বাদ। আবার তেতো খাওয়াতেও রয়েছে গেরো। খিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের বিখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক ছিলেন হিরোফিলাস। বাইজান্টাইন সম্রাটদের শরীর ঠিক রাখার জন্য খাদ্যাভ্যাসের দিনপঞ্জিকা বানিয়েছিলেন তিনি। সেই দিনপঞ্জিকা অনুসারে মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু করে গোটা গরমকালেই তেতো খাবারে নিষেধ করে গিয়েছেন তিনি। এ দিকে বাঙালির ঘরে-ঘরে তেতো খাওয়া শুরু সেই ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ। জলবসন্তের হাত থেকে রক্ষা পেতে তখনই সজনেফুল থেকে নিমপাতা খাওয়ার সময়। কিন্তু এই খাদ্যাভ্যাসের দিনপঞ্জিকা মানলে সেপ্টেম্বর থেকে তেতো খাওয়া শুরু করে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হবে। তার পরে তেতো নয়। এমনকি অন্য আনাজের তিতকুটে ভাব কাটাতেও হানি ভিনিগার ব্যবহারের নিদেন দিচ্ছেন হিরোফিলাস।

বরং গরমে টক খাওয়া অনেক স্বাস্থ্যসম্মত। এ সময়ে রান্নায় তেঁতুলের ক্বাথ, পাকা আম, পাতিলেবু, গন্ধরাজ লেবু ব্যবহার করতে পারেন। কাঁচা আম বা তেঁতুল দিয়ে টক ডাল বা মাছের টকও গরমে উপকারী। একটু খেয়াল করে দেখবেন, উপকূলবর্তী অঞ্চলে গরমের সঙ্গে মোকাবিলার জন্যই রান্নায় টকের আধিক্য। তবে তেতো খেতে চাইলে মটর ডালে উচ্ছে দিয়ে বা সব আনাজ দিয়ে একটা শুক্তো রেঁধে নিতে পারেন।

আনাজ-কানাচে

গরমে লাউয়ের মতো আনাজ রাখা যায় রোজকার পাতে। কোনও দিন মুগ ডালে লাউ দিয়ে রেঁধে নিলেন। কোনও দিন লাউ কুরিয়ে নিয়ে পোস্ত বাটা দিয়েও রাঁধতে পারেন। লাউ ভাপাও করতে পারেন টক দই আর সরষে বাটা দিয়ে। লাউ শুক্তো তো রইলই, লাউ পাতায় মসুর ডাল ভাপাও লাজবাব। অন্য দিকে রেঁধে নিতে পারেন পুরনো দিনের পানিফলের তরকারি। জিরে-আদা বাটা ও টম্যাটোর ক্বাথে এই নিরামিষ রান্না খুব সহজ। আর একটা ডাল রান্না করতে পারেন ডাবের জল দিয়ে। মৌরি ফোড়নে কাঁচা মুগ ডাল রেঁধে ডাবের জল মিশিয়ে নিন। এই ডালে শরীর ঠান্ডা হয় দারুণ। লেবুপাতা দিয়েও মুগের ডাল রাঁধা যায়। তখন আবার ফোড়ন পড়বে মেথি, সরষে। আবার মৌরি-তেজপাতা ফোড়নে কাঁচা বিউলির ডালও সুস্বাদু। এ ছাড়াও চালতার অম্বল, জলপাইয়ের টক, এঁচোড়ের ডালনা, দুধ ঝিঙে, গরমে নটে ও জলসাচি শাকের মতো পদও রাখতে পারেন। শেষ পাতে ডাবের মালাই বেটে চিনি ও দুধ মিশিয়ে কুলফি করে নিন। খুদে সদস্যদেরও ভাল লাগবে।

স্থানীয় খাদ্যাভ্যাস ও মরসুমি আনাজপাতিতে ভরসা রাখুন এ সময়ে। গ্রামবাংলার ভাঁড়ারে শীতলপাটির অভাব নেই। ঠাকুমা-দিদিমার হেঁশেলের দিনগুলো মনে করতে পারলে হয়তো মিলবে এমন কত প্রাণজুড়ানো রান্নার হদিস।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Summer Diet Summer Care Health care

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy