মাছে-ভাতে বাঙালি এখন আর স্রেফ বঙ্গীয় রান্নায় থেমে নেই। স্বাদকোরকেও নতুনের হাতছানি। তাতে খানিকটা বিজাতীয় প্রভাব, খানিকটা মৌলিক স্বাক্ষর। চিনা, তাই, তিব্বতি— কলকাতায় সব রকম খাবারেরই অবারিত দ্বার। মালাইকারি ছেড়ে বাঙালি এখন চেটেপুটে খেতে পারে গুং সালোংযের মতো খাস তাইল্যান্ডের জনপ্রিয় চিংড়ির পদ। এগ চাউমিনের তো সেকেলে, চিয়াং মাই চিকেন কারিতে মাখিয়ে গ্লাস নুড্লসের স্বাদ এখন বেশ লাগে অনেক বাঙালিরই। তাই কলকাত্তাইয়া বাঙালিকে তাইল্যান্ডের স্থানীয় খাবারের স্বাদ চাখাতে খুশি মনেই খুন্তি ধরেছেন তাইল্যান্ডের রাঁধুনি তানিয়া।
উত্তর তাইল্যান্ডের বাসিন্দা তানিয়া। চিয়াং মাই শহর থেকে এসে এ দেশের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাই খাবার রেঁধে খাওয়াচ্ছেন লোকজনকে। মূলত চিয়াং মাইয়ের স্থানীয় সব পদ রাঁধতেই বেশি পছন্দ করেন তানিয়া। তাঁর হাতের রান্নায় তাই সে শহরের ঘরোয়া খাবারেরই স্বাদ। মেনল্যান্ড চায়নার ‘এশিয়া কিচেন’-এ কিছু দিন আগেই ‘তাইল্যান্ড ফুড ফেস্টিভাল’ হয়ে গেল। সেখানে তানিয়ার রাঁধা হরেক রকমের তাই খাবারের পদ ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে এ দেশেই আছেন তানিয়া। এখানকার মানুষজনের খাদ্যাভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ বেশ বোঝেন। তাঁর রান্নাতেও সেই ছাপ বেশ স্পষ্ট।
আনন্দবাজার অনলাইনকে তানিয়া বললেন, “উত্তর তাইল্যান্ডের নানা খাবারের স্বাদ এখানকার লোকজনকে দিতেই আমি এসেছি। এ শহরকে আমি ভালবাসি। এখানকার মানুষজনও খুব প্রিয়। নিজের দেশের রান্না খাওয়াব বলেই তো আমার আসা!”চিয়া
চিয়াং মাই-এর জনপ্রিয় সব পদ। নিজস্ব চিত্র।
উত্তর তাইল্যান্ডের সীমান্ত বরাবর মায়ানমার। সেখানকার স্থানীয় খাবারের প্রভাবও পড়েছে তানিয়ার রান্নায়। বললেন, যত উত্তরে যাওয়া যাবে, ততই রান্নায় মশলার ব্যবহার বাড়বে। রান্নায় নানা রকম মশলা, হার্বস ব্যবহার করেন তানিয়া। নারকেলের দুধ তো বটেই। রান্নায় ঝালের মাত্রাও একটু বেশি। ট্যামারিন্ড চিকেন উইংস মশলা মাখিয়ে রসিয়েই রাঁধেন তাইল্যান্ডের রাঁধুনি। কাঁচালঙ্কা চিরে দেন রান্নায়। খেতে গেলে ঝাল তো লাগবেই। তবে চিকেন উইংসের সঙ্গে যদি সব্জি দেওয়া রাইস নুডল্স মিলিয়ে খাওয়া যায়, তা হলে স্বাদটাও বাড়ে আর ঝালটাও কিঞ্চিৎ কম লাগে। এই নুড্লসের সঙ্গে কিন্তু কলকাত্তাইয়া ‘চাউমিন’-এর বিস্তর তফাৎ। নানা রকম হার্বস আর সব্জি কুচিয়ে, তার সঙ্গে ডিমের কুচি আর ছোট ছোট কিমা করা মাংস দিয়ে তাই নুড্লস রাঁধা হয়। উপরে ছড়ানো ব্রকোলি সিদ্ধ। যিনি কস্মিন কালেও ব্রকোলির মতো স্বাস্থ্যকর খাবার মুখে তোলেন না, তিনিও রান্নার গুণে ব্রকোলি চেটেপুটেই খাবেন।
তানিয়া বলছেন, তাঁদের দেশে সম টম স্যালাড খুব বিখ্যাত। আনারস ও নানা রকম ফল দিয়ে এই স্যালাড বানান তানিয়া। তবে চিয়াং মাইয়ের জনপ্রিয় একটি চিংড়ির পদ রাঁধতে বেশি পছন্দ করেন তিনি— ‘প্রন ইন ব্ল্যাঙ্কেট’। স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘গুং সালোং’। মাঝারি মাপের চিংড়ির উপর সরু সুতোর মতো নুড্লস ঠিক উল বোনার মতো করে বুনে দেওয়া হয়। অর্থাৎ নুড্লসে পেঁচানো চিংড়ি। এই নুড্লস আবার খানিকটা খাস্তা। বেশ বোঝাই যায়, নুড্লস জড়িয়ে চিংড়িখানি আরও একপ্রস্ত ভেজে নেওয়া হয়। নানা রকম সব্জি, ধনেপাতা দিয়ে তেল ছাড়া হালকা স্যুপও বানান তানিয়া। বললেন, “যাঁরা হালকা খাবার খান, তাঁদের জন্য ধনেপাতা দেওয়া এই ঝোল খুবই উপকারী। চিকেন মিটবলও রাঁধি আমি। নারকেলের দুধ দেওয়া চিকেনের গ্রেভির সঙ্গে ভাত খেতে পছন্দ করেন চিয়াং মাইয়ের লোকজন।”
থাই ককটেল বানানোতেও পারদর্শী তানিয়া। লিচুর রসের সঙ্গে গন্ধরাজ লেবু আর জিনের ককটেল তাইল্যান্ডের খুবই পরিচিত একটি পানীয়। উত্তর-পূর্ব তাইল্যান্ডের স্বাদগন্ধের ঝাঁপি উপুড় হয়েছে তানিয়ার হাত ধরে। আর বাঙালিরাও এশীয় এই পড়শি দেশের মায়ায় মজেছেন।