Advertisement
E-Paper

খেলতে গিয়ে চোট? হাল্কা ভাবে না-নিয়ে নজরে রাখুন

কাঁধে ক্রিকেট ব্যাট। মায়ের হাত ধরে নামী ক্রিকেটারের কোচিং ক্যাম্পে যাচ্ছে বছর দশেকের ছেলে। উৎসাহে টগবগ করছে চোখ-মুখ। এ দিকে মায়ের মুখ পাংশু। এক সময়ে ছেলেকে খেলা শেখাতে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এখন প্রতি মুহূর্তে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন। বিকেলে পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে যাওয়া কিশোরদের অনেকের বাড়িতেও দুশ্চিন্তা।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৫ ০৩:২২

কাঁধে ক্রিকেট ব্যাট। মায়ের হাত ধরে নামী ক্রিকেটারের কোচিং ক্যাম্পে যাচ্ছে বছর দশেকের ছেলে। উৎসাহে টগবগ করছে চোখ-মুখ।

এ দিকে মায়ের মুখ পাংশু। এক সময়ে ছেলেকে খেলা শেখাতে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এখন প্রতি মুহূর্তে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন। বিকেলে পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে যাওয়া কিশোরদের অনেকের বাড়িতেও দুশ্চিন্তা। ছেলে যতক্ষণ অক্ষত অবস্থায় না-ফিরছে, ততক্ষণ স্বস্তি নেই। স্কুলের ভলিবল কোর্টে, হকির মাঠে, এমনকী টিফিনের সময়ে ছেলেমেয়েদের দামালপনা দেখে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও উদ্বেগের অন্ত নেই। সকলেরই চিন্তা— কারও চোট লাগল না তো! আঘাত যদি লাগেও, পরের দেখভালটা ঠিকঠাক হবে তো?

তরুণ ক্রিকেটার অঙ্কিত কেশরীর আঘাতজনিত মৃত্যু এক ধাক্কায় শহরের খেলাধুলোর জগতে খানিকটা যেন আশঙ্কা-অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি করেছে। সিডনিতে ২০১৪-র ২৫ নভেম্বর শন অ্যাবটের বাউন্সার কানের নীচে লেগে মারা গিয়েছিলেন ফিল হিউজ। দিন কয়েক আগে সল্টলেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ক্যাচ ধরতে গিয়ে সতীর্থের হাঁটুর আঘাতের জেরে শেষ হয়ে গিয়েছেন অঙ্কিত। আপাতদৃষ্টিতে কিন্তু তিনি ‘সেরে’ উঠেছিলেন। অথচ আচমকাই তাঁর জীবনে দাঁড়িচিহ্ন পড়ে গেল!
যার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, অঙ্কিতের চিকিৎসা কি যথাযথ হয়েছিল?

খেলতে গিয়ে খেলোয়াড়দের নানা ধরনের চোট হামেশাই লেগে থাকে। মামুলি আঘাত সামলে অনেকে ফের মাঠে নেমে পড়েন। কিন্তু অঙ্কিত বা হিউজের যেমন চোট লেগেছিল, তেমন সম্ভাবনা কী ভাবে এড়ানো যেতে পারে, কেউ আঘাত পেলে কী ভাবে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে সব নিয়ে চারদিকে আলাপ-আলোচনা চলছে বিস্তর। একটা বিষয়ে সব মহলই মোটামুটি একমত— আঘাত-পরবর্তী দেখভালটাই হল সর্বাধিক জরুরি। সেখানে সামান্য বিচ্যুতি কেড়ে নিতে পারে একটা তাজা প্রাণ।

সাধারণত যে কোনও খেলায় বুকে, মাথায় ও পেটে আঘাতকে ‘গুরুতর’ হিসেবে ধরা হয়। ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ অরিন্দম কর জানালেন, তাতে ‘ব্লান্ট কার্ডিয়াক ইনজুরি’ হতে পারে, যার জেরে হার্ট বন্ধ হওযার সম্ভাবনা। রাগবি, ক্রিকেটের মতো তীব্র গতির খেলায় পেটে আঘাত লেগে লিভার, কিডনি বা অন্য অঙ্গ ফেটে যেতে পারে। মেরুদণ্ড জখম (সার্ভাইকাল স্পাইন ইনজুরি) হতে পারে। মাথায় আঘাত লেগে ইন্টার সেরিব্রাল হেমারেজ-ও বিচিত্র নয়। যা-ই হোক না কেন, তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা শুরু হওয়াটা অতীব জরুরি। ঘটনার কিছুক্ষণ বাদে মনে হতে পারে, আহতের অবস্থা হঠাৎ যেন অনেকটা ভাল হয়ে এসেছে। সেটা ভেবে নজরদারিতে ঢিলেমি দিলে বড় বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। ‘‘একে বলে লুসিড ইন্টারভ্যাল। চোট লাগল। খেলোয়াড় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। সামান্য চিকিৎসা হল। তিনি উঠে বসলেন, হেঁটে বাড়ি গেলেন। সবাই নিশ্চিন্ত, যাক, বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু খানিক বাদে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিতে পারে।’’— হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন অরিন্দমবাবু। আর তাই আহতকে অন্তত বাহাত্তর ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখায় জোর দিচ্ছেন তিনি। স্পোর্টস ইনজুরি বিশেষজ্ঞ পুষ্পকেতু কোনারও এই ‘লুসিড ইন্টারভ্যাল’ সম্পর্কে সচেতনতায় গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আঘাতের পরে হয়তো সাময়িক ভাবে সব ঠিক হল। তার পরেও অনেক সময়ে মস্তিষ্কে নতুন করে চাপ তৈরি হয়। তখন রোগী ফের সংজ্ঞা হারাবেন। অবস্থা দ্রুত খারাপ হবে। তাই অন্তত তিন দিন কড়া নজরে রাখা উচিত।’’

পাশাপাশি মাঠে জীবনদায়ী ব্যবস্থা (লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম) এবং আধুনিক অ্যাম্বুল্যান্স রাখাটাও সমান জরুরি। যদিও পুষ্পকেতুবাবুর অভিজ্ঞতা বলছে, ছোটখাটো কোচিং ক্যাম্পে তো বটেই, বড়সড় বহু খেলার মাঠেও লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত লোকজন বা আধুনিক অ্যাম্বুল্যান্সের বালাই থাকে না। ‘‘আনাড়ি কর্মীরা যে ভাবে আহতকে ধরে সাধারণ অ্যাম্বুল্যান্সে তোলেন, সেটা খুবই ঝুঁকির। বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়।’’—
মন্তব্য তাঁর। খেলায় চোট-আঘাত এড়াতে হেলমেট কিছুটা কার্যকর হলেও সব পরিস্থিতিতে যে হেলমেট পরা যায় না, তা-ও ওঁরা মেনে নিচ্ছেন। তা হলে কী করণীয়? স্পোর্টস ইনজুরি চিকিৎসক বিবেক গুপ্ত বলেন, ‘‘বেশি ক্লান্ত হয়ে থাকলে কিংবা শরীরের কোথাও বেশি যন্ত্রণা থাকলে মাঠে না-নামা উচিত। এ সব ক্ষেত্রে আঘাত লাগলে মাত্রাটা বেশি হয়ে যায়।’’ স্কুল-কলেজে বা ক্যাম্পের খেলার আসরেও এটা মাথায় রাখতে বলছেন তিনি।

বস্তুত বিবেক গুপ্ত কিংবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টস ফিজিওলজি’র এমেরিটাস অফিসার প্রতিমা চট্টোপাধ্যায়— সকলেরই পরামর্শ, খেলার কোনও চোটকে যেন হাল্কা ভাবে দেখা না-হয়। কারণ, কোন আঘাতের প্রভাব পরে কতটা মারাত্মক হয়ে উঠবে, তা আগেভাগে বোঝা যায় না। আঘাত লাগলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। চোট বেশি হলে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার সময়ে সাবধান হতে হবে। এক চুল এ-দিক-ও-দিক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। সে জন্যই মাঠে বা কোচিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান রাখতে হবে।

স্কুলের খেলাধুলোয় বড় বিপর্যয় এড়াতে জোর দেওয়া হচ্ছে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর)-এর উপরেও। মানে, আচমকা বুকে আঘাত লেগে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলে মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম ভাবে তা চালু করার প্রক্রিয়া। ডাক্তারদের মতে, খেলাধুলোয় কিংবা বন্ধুদের মধ্যে মারপিটে বুকে আঘাত লেগে শরীর নিষ্পন্দ হয়ে গেলে সিপিআর-ই পারে প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়ে আনতে। তাঁদের বক্তব্য, ক্লাবে বা স্কুলে অন্তত কয়েক জন কর্মীকে এর ট্রেনিং দিয়ে রাখাটা এখন প্রাথমিক কর্ত্যব্যের মধ্যে পড়ছে।

দুর্ঘটনাজনিত আঘাতের মোকাবিলায় (ট্রমা কেয়ার) কলকাতার ট্র্যাফিক পুলিশের একাংশকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন যিনি, সেই অস্থি-বিশেষজ্ঞ রামেন্দু হোমচৌধুরীর অভিমত, খেলার মাঠেও প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক্যাল কর্মী থাকা একান্ত প্রয়োজন। শুধু তা-ই নয়, মাঠ থেকে হাসপাতাল কিংবা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের সময়ে আহতকে শোওয়াতে হবে স্পাইন বেডে। বোর্ডের মতো শক্ত সেই শয্যায় শায়িত ব্যক্তির ঘাড় কোনও ভাবে নড়বে না। মেরুদণ্ডে চোট পেলে ‘ডিটাচেবল কলার’ পরিয়ে রাখাটাও জরুরি।

এই সব পরিকাঠামো ছাড়া কোনও ম্যাচ বা কোচিং ক্যাম্প হওয়াই উচিত নয় বলে মনে করেন রামেন্দুবাবু।

guradians take care sports injury playing injury soma mukhopadhyay guardians children injury doctors opinion on sports injury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy