মা, মাসি, দিদাকে হারিয়েছিলেন ক্যানসারে। তাই, ঝুঁকি নিতে চাননি ছয় সন্তানের জননী। জিন পরীক্ষা করতেই জেনেছিলেন, তাঁরও স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর পরেই দশ বছর আগে প্রথমে ম্যাস্টেকটমি করে দু’টি স্তন এবং আট বছর আগে ডিম্বাশয় ও ফ্যালোপিয়ান টিউব বাদ দিয়েছিলেন অস্কারজয়ী অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। তাঁর পথে এখন হাঁটতে চাইছেন অনেকেই। আগাম জেনে নিতে চাইছেন, শরীরে ক্যানসার বাসা বাঁধার কোনও আশঙ্কা রয়েছে কি না।
ক্যানসার নিয়ে একাংশের এমন চিন্তাধারাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, ক্যানসার আক্রান্তদের অন্তত ৯-১০ শতাংশের ক্ষেত্রে এই রোগ বংশগত। এই বংশগত ক্যানসারের ক্ষেত্রে জিনের পরিব্যক্তি (মিউটেশন) প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। আর যাঁদের জিনে পজ়িটিভ ভ্যারিয়েন্ট থাকে, তাঁদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের থেকে অনেক বেশি। চিকিৎসকদের মতে, স্তন, জরায়ু, কোলন, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার, রেটিনোব্লাসটোমা ও মেলানোমা (ত্বকের বিশেষ ধরনের ক্যানসার)-সহ আরও কয়েকটি ক্যানসার বংশগত। ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “অনেক ক্যানসারই জিনগত। তাই জিনের পরীক্ষা করে ঝুঁকি আছে কি না, তা আগাম জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাতে ক্যানসার নিয়ে আতঙ্কও কমানো সম্ভব।”
যদিও বংশগত ক্যানসারের ঝুঁকি জানতে নির্দিষ্ট ভাবে শহরের কোথাও কোনও ব্যবস্থা চালু হয়নি, জানাচ্ছেন অঙ্কো-প্যাথলজিস্ট দেবমাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ক্যানসার আক্রান্তের জিনের বিশ্লেষণের ব্যবস্থা কয়েকটি হাসপাতালে রয়েছে। সে জন্য ন্যূনতম খরচ ৪০ হাজার টাকা। তবে তা চিকিৎসকের পরামর্শেই করা হয়।”
তবে এ ক্ষেত্রে কয়েক পা এগিয়ে গেল মুম্বই। ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস থাকা মানুষের ভবিষ্যৎ ঝুঁকি নির্ণয় করতে হেরেডিটারি ক্যানসার ক্লিনিক চালু করল মুম্বইয়ের ‘কোকিলাবেন ধীরুভাই অম্বানী হসপিটাল অ্যান্ড মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। সেখানকার ক্যানসার বিভাগের অধিকর্তা, চিকিৎসক রাজেশ মিস্ত্রি বলেন, “পরিবারের কারও ক্যানসার থাকলেই যে অন্যের হবে তেমনটাও কিন্তু নয়। আবার আশঙ্কা একেবারে নেই, সেটাও বলা যায় না। সে জন্যই হেরেডিটারি ক্লিনিকে জেনেটিক কাউন্সেলিং, পরীক্ষা ও ঝুঁকির মূল্যায়ন সম্ভব।” তিনি জানাচ্ছেন, যদি কারও ঝুঁকি আছে বলে মনে হয়, তা হলে সেই মতো পর্যবেক্ষণ ও রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
চিকিৎসকদের মতে, আনুপাতিক হারে কম হলেও বংশগত ক্যানসার নিয়ে ঝুঁকির দিকটিও আগাম জানা প্রয়োজন। যেমন, অ্যাঞ্জেলিনার শরীরে বিআরসিএ-১ জিনের অস্তিত্ব মিলেছিল। যা স্তন ক্যানসারের প্রভূত আশঙ্কার কারণ। আবার, স্তন ক্যানসারে অনুঘটকের কাজ করে ইস্ট্রোজেন হরমোন। তাই ইস্ট্রোজেনের উৎসস্থল ডিম্বাশয়কে বাদ দিলে সেই আশঙ্কা অনেকটাই প্রশমিত হয় বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
স্তন ক্যানসারের শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার জানাচ্ছেন, পিজিতে আসা স্তন ক্যানসার আক্রান্তদের ৫ থেকে ১০ শতাংশ বংশগত ভাবে আক্রান্ত। ১১টি জিন রয়েছে যা ক্যানসারের কারণ হতে পারে। তার মধ্যে বিআরসিএ-১ জিনের কারণে স্তন ক্যানসার তো বটেই, ডিম্বাশয়ের ক্যানসারেরও যোগ রয়েছে। বিআরসিএ-২ জিনের সঙ্গে থাইরয়েড ক্যানসারের যোগ রয়েছে।
সম্প্রতি মুম্বইয়ের ওই হাসপাতাল আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বিষয়ই ছিল ‘প্রিসিশন অঙ্কোলজি ও পার্সোনালাইজ়ড মেডিসিন’। সেখানে হাসপাতালের চেয়ারপার্সন টিনা অম্বানী বলেন, “প্রিসিশন অঙ্কোলজি ও পার্সোনালাইজ়ড মেডিসিন ক্যানসার পরিচর্যার নতুন দিগন্ত। হেরেডিটারি ক্লিনিক দ্বারা পরিবারে ক্যানসারের ঝুঁকি পূর্বানুমান করতেও বিশেষ সুবিধা হবে।”
প্রিসিশন অঙ্কোলজি পদ্ধতিতে টিউমারগুলিকে একেবারে মলিকিউলার স্তর থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। তার পরিবর্তনগুলিকে চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট ভাবে চিকিৎসা পদ্ধতিও স্থির করা যায় বলেই মত মেডিক্যাল-অঙ্কোলজির চিকিৎসক সন্দীপ গোয়েলের। আর এক ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “মলিকিউলার বায়োলজি ও জেনেটিক্স আগামী দিনে ক্যানসারের চিকিৎসার বড় দিক খুলে দিতে চলেছে। যেখানে রোগীভিত্তিক ওষুধ নির্বাচন করে তা প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যানসার আক্রান্ত কোষের বায়োলজিক্যাল অগ্রগতি আটকানো সম্ভব।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)