আমাজ়নের প্রসঙ্গ উঠলেই মানসপটে ভেসে ওঠে এক গহিন অরণ্যের ছবি। দক্ষিণ আমেরিকার এক ঘন, দুর্গম জঙ্গল, যার সঙ্গে কলকাতাবাসীর বেশির ভাগেরই পরিচয় সাহিত্য, সিনেমার পর্দা কিংবা ইন্টারনেটের ভিডিয়োয়। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকেও কলকাতা আর অ্যামাজ়নের দূরত্ব নেহাত কম নয়, ১৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি। সেই সুদূর আমাজ়নের জঙ্গলের ক্ষুদ্র সংস্করণ যদি শোভা পায় কোনও কলকাতাবাসীর বৈঠকখানায়, তবে কেমন হয়? না কোনও ছবি বা মডেল নয়, একেবারে সজীব জঙ্গল। যা দিব্যি বেঁচে থাকবে, বাড়বে গাছপালাও। এমনও কি সম্ভব?
উত্তর হল, সম্ভব। যদি সঠিক চিন্তাভাবনা, পরিশ্রম এবং গবেষণায় একটি টেরারিয়াম তৈরি করা যায়। টেরারিয়ামের কথা অনেকে শুনেছেন। কেউ হয়তো শোনেননি। ইদানীং অন্দরসজ্জায় টেরারিয়াম ব্যবহার করছেন অনেকেই। কিন্তু কী সেটি?
জিনিসটি কিছুটা কাচের অ্যাকোয়ারিয়ামের মতো। এতে জল বা মাছ নয়, থাকে উদ্ভিদ। বলা চলে, কাচের পাত্রের মধ্যে আবদ্ধ জঙ্গল বা সবুজ প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম সংস্করণই হল টেরারিয়াম। তবে, সেই প্রকৃতি বা সবুজ, কাচের মধ্যে জীবন্ত থাকে। গাছপালা বেড়ে ওঠে। কাচের জগতেই তৈরি হয় ভিন্ন বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম।
কাচের পাত্রেই উদ্ভিদ জগৎ। ছবি: সংগৃহীত।
এ এক মজার ব্যাপার। অ্যাকোয়ারিয়ামে যেমন জলজ প্রাণী খেলে বেড়ায়, দিব্যি বেঁচে থাকে, এখানেও তেমনই বাঁচে গাছ এবং সেই বাস্তুতন্ত্রে টিকে থাকার মতো প্রাণীও ।শুধু অ্যামাজ়নের রেনফরেস্ট নয়, এ নিয়ে চর্চাকারীরা বলছেন, কাচের মধ্যে উপযুক্ত বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে পারলে, এর ভিতরে পৃথিবীর নানা প্রান্তের জঙ্গলকেই ঠাঁই দেওয়া সম্ভব।
কী ভাবে তৈরি হল টেরারিয়াম?
টেরারিয়ামের ভাবনা, উৎপত্তি অবশ্য এ যুগের নয়। সে কথা জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৮২ বছর আগে। ১৮৪২ সালে ইংরেজ চিকিৎসক নাথানিয়েল বাগশ ওয়ার্ডের হাত ধরেই টেরারিয়ামের উদ্ভাবন। তখন অবশ্য এই নামকরণ হয়নি। একটি পতঙ্গের আচরণ পর্যবেক্ষণে মগ্ন ছিলেন চিকিৎসক। দিন কয়েক পরে তাঁর নজরে আসে একটি ঢাকা দেওয়া কাচপাত্রের মধ্যেই বেড়ে উঠছে ফার্ন। একটি বদ্ধ জায়গায় কোনও রকম পরিচর্যা ছাড়া কী ভাবে বীজ থেকে গাছের জন্ম হতে পারে, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ওয়ার্ড। পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। কাচের বাক্সের মধ্যে গাছ বেড়ে ওঠার মতো বাস্তুতন্ত্র তৈরি করে একটি গাছ তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পাঠান। আবার সেখান থেকে গাছ আনা হয় লন্ডনে। দেখা যায়, সেই গাছ দিব্যি বেঁচে আছে। সে সময় তার নাম ছিল ওয়ার্ডিয়ান কেস। তা পরবর্তী কালে নানা গবেষণার ধাপ পার হয়ে আধুনিক টেরারিয়ামের রূপ ধারণ করে।
টেরারিয়ামের ধরন-ধারণ
সাধারণত দুই ধরনের টেরারিয়াম হয়। উন্মুক্ত এবং বদ্ধ।
বদ্ধ টেরারিয়ামে কাচের পাত্রের মধ্যে মস, অর্কিড, ফার্ন রাখা হয়। উপযুক্ত মাটি দিয়ে সেই গাছপালা বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করা হয়। পাত্রের মুখ আটকানো থাকে। মস, অর্কিড, ফার্ন বেড়ে ওঠার জন্য কার্বনডাইঅক্সাইড, জল, নাইট্রোজেনের মতো জরুরি উপকরণ কাচের মধ্যে আবদ্ধ পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করে। কাচের পাত্রের ভিতরেই তৈরি হয় আলাদা বাস্তুতন্ত্র। যে অঞ্চলের উদ্ভিদ সেখানে রাখা হবে, সেখানকার মতো জল, তাপমাত্রার ব্যবস্থা করতে হয় সেই বদ্ধ পাত্রে।
উন্মুক্ত টেরাররিয়াম। ছবি: সংগৃহীত।
উন্মুক্ত টেরারিয়ামেও গাছপালা কাচের পাত্রেই বেড়ে ওঠে। তবে সেই পাত্রের মুখ থাকে উন্মুক্ত। ফলে বাইরের আলো-হাওয়া তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।
তফাত কোথায়?
বদ্ধ টেরারিয়ামে গাছপালা বেড়ে ওঠার জন্য বাইরে থেকে জল-হাওয়া প্রবেশের দরকার হয় না। কাচের ভিতরের পরিবেশই যথেষ্ট। অন্য দিকে, উন্মুক্ত টেরারিয়ামে বাইরের আলো, হাওয়া, জলের দরকার পড়ে।
বদ্ধ টেরারিয়ামে কাচের পাত্রে তাপমাত্রা বেশি তৈরি হয়। ফলে, সেই তাপমাত্রার উপযোগী গাছপালা বেড়ে ওঠার জন্য এটি কার্যকর। মূলত, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উদ্ভিদ এই টেরারিয়ামে ভাল থাকে। অন্য দিকে, উন্মুক্ত টেরারিয়ামে তাপ বেরিয়ে যেতে পারে বলে, কাচের ভিতরে তুলনায় কম তাপ তৈরি হয়।
ইদানীং বাড়িঘর সাজানোর ক্ষেত্রে টেরারিয়ামের ব্যবহার বাড়ছে। অনেকেই এই জীবন্ত উদ্ভিদজগৎ নিয়ে আগ্রহী হচ্ছেন। আবার উপহার হিসাবেও এটি বেশ ভাল।
টেবিল হোক বা টিভি ক্যাবিনেট, ঘরের যে কোনও প্রান্তেই তা সাজিয়ে রাখা যায়। চাইলে এমন জিনিস তৈরি করে কাউকে উপহারও দেওয়া যায়।
কী ভাবে তৈরি করবেন টেরারিয়াম?
দিল্লির টেরারিয়াম শিল্পী ফারিয়াল সাবরিনা উন্মুক্ত টেরারিয়াম তৈরির সহজ কয়েকটি কৌশল বলেছেন।
১. ওয়াইন গ্লাস হোক বা স্বচ্ছ কাচের কোনও পাত্র, চওড়া বোতল, যেটা পছন্দ সেটাই বেছে নিতে পারেন টেরারিয়ামের জন্য। প্রথমেই সেটি খুব ভাল করে পরিষ্কার করে নিন। প্রথম ধাপে দিতে হবে পাথর। সাদা, রঙিন পছন্দের যে কোনও পাথর, নুড়ি এ জন্য বেছে নিতে পারেন।
২. পরের ধাপে দিতে হবে মাটি। কোকোপিট এবং ভার্মিকম্পোস্ট মেশানো মাটি ব্যবহার করলে ভাল। কারণ এই মাটি থেকে গাছ পু্ষ্টি পাবে।
৩. মাটিতে সামান্য গর্ত করে তাতে ডোয়ার্ফ সিনগোনিয়াম, ফিটোনিয়া, মস জাতীয় উদ্ভিদ বসিয়ে দিন।
৪. টেরারিয়াম সাজাতে ব্যবহার করতে পারেন বিভিন্ন ধরনের পাথর। এ ছাড়া, গাছের ছোট ডাল, ঝিনুক, ছোট শাঁখ, যা-ই ব্যবহার করুন তা যেন মানানসই হয়।
৫. মাঝে মধ্যে গাছ, মাটিতে জল স্প্রে করতে হবে, যাতে আর্দ্রতা বজায় থাকে।
কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন?
কী ভাবে সাজাতে চাইছেন, তা আগে ভেবে নিন। সেই মতো জিনিসপত্র জোগাড় করুন।
গাছের পাতা ঝরে গেলে তা পরিষ্কার করতে হবে।
রোদ আসে, এমন কোনও জায়গায় টেরারিয়াম রাখা চলবে না।