সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তাঁরা আসেন। ভাগীরথী পার হয়ে কলকাতার বিভিন্ন গঙ্গার ঘাটেই মেলে দেন ক্লান্ত শরীর। সঙ্গে থাকে অল্পবয়সি সঙ্গী কেউ। আবছায়া হয়ে থাকা অমারাত্রিতে ঘুমন্ত সেই সব ছায়াশরীরগুলিকে রক্তমাংসের কেউ বলে মনে না-ও হতে পারে। বরং মনে হতে পারে এই রাত্রেই তো এ বছরের মতো শেষ বার অন্ন-পান চাইবেন পিতৃলোকের বাসিন্দারা। তাঁরাও তো সব ছায়াপুরুষ! গঙ্গার ঘাটে আশ্বিনের মৃদু হিম চুঁইয়ে পড়া রাতে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা অবয়বগুলি সেই ছায়ালোকের বাসিন্দাদের বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু যখন উষালগ্নে রেডিয়োর নব (অধুনা অনেক জায়গাতেই এমপিফোর) ঘুরে যায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠস্বরের দিকে, তখন জড়তা কাটিয়ে গণশৌচালয়ে প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে সেই ছায়াপুরুষেরা কায়ারূপ ধারণ করে নেমে পড়েছেন ভাগীরথী তথা গঙ্গার জলে। একে একে জুটছেন যজমানেরা। কায়াপুরুষেরা শুরু করছেন দেবতর্পণ… মনুষ্যতর্পণ… ঋষিতর্পণ।
‘তর্পণ’, এই ছোট শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অগণিত বঙ্গজের আবেগ। কারণটি অবশ্যই সোজা— মহালয়ার তর্পণ মানেই পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে দেবীপক্ষের আরম্ভ এবং দুর্গোৎসবের সূচনা। কিন্তু মহালয়ার তাৎপর্যে যে দেবীর কোনও ভূমিকাই নেই, সে কথা মনে করিয়ে দেন শাস্ত্রজ্ঞজন। নবকুমার ভট্টাচার্যের বর্তমান আবাস বৈদ্যবাটী। অবশ্য কলকাতার আহিরীটোলা অঞ্চলে তাঁর একটি টোল রয়েছে, যেখানে তিনি পৌরোহিত্য ও সংস্কৃত শিক্ষাদান করে থাকেন। নবকুমারবাবু জানালেন, ‘তর্পণ’ শব্দটির অর্থ তৃপ্ত করা। ‘মহালয়া’ শব্দটির পিছনে রয়েছে এক ‘মহান আলয়’-এর ধারণা। যে আলয়ে পিতৃপুরুষেরা সমবেত হন, উত্তরপুরুষের হাত থেকে জলগ্রহণ করেন। মহালয়া পিতৃপক্ষের অন্তিম দিন। এক পক্ষকাল যাঁরা তর্পণ করতে পারেননি, তাঁরা এই দিন একসঙ্গে পক্ষকালের তর্পণ সারেন। তিনি আরও জানালেন, দেবীপক্ষ শুরু হওয়া মাত্রই পিতৃলোক থেকে আগত আত্মারা ফিরে যান না। তাঁরা অপেক্ষা করেন দীপান্বিতা পর্যন্ত। এক অমাবস্যা থেকে আর এক অমানিশীথ। দীপান্বিতার আলোই তাঁদের ছায়ালোকে ফিরে যেতে পথ দেখায়। নবকুমারবাবুর কথা শুনতে শুনতে মনে হল, বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিতে প্রাপ্ত ভূত চতুর্দশী তিথি তা হলে পিতৃপুরুষদের ইহলোকের অবস্থানের শেষ দিন? চতুর্দশ পুরুষকে চোদ্দো প্রদীপ দেখিয়ে বচ্ছরকার মতো বিদায় জানানোর উৎসব?
বিশ্বের সপ্তদ্বীপের মানুষকে জলদানের বিধি রয়েছে তর্পণক্রিয়ায়। সেখানে জাত নেই, বর্ণ নেই, ধর্ম পর্যন্ত, লিঙ্গভেদও নেই। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
নবকুমারবাবু জানালেন, তর্পণ আসলে এক নিত্যকর্ম। তিনি নিজে প্রত্যহই তর্পণ করেন। সারা বছর জল দিয়ে তর্পণ করা হলেও পিতৃপক্ষের প্রতিটি দিন তিল ও জল দিয়ে তর্পণ করাই বিধেয়। কিন্তু নিজে তর্পণ করলেও অন্যকে তর্পণ করান না। যে সময়ে তিনি কলকাতায় থাকতেন, তখন কেউ যদি পুরোহিত না পেতেন, তিনি করাতেন। আসলে তর্পণে যজমানের তাঁর নিজস্ব নাম, গোত্র-সহ ঊর্ধ্বতন পুরষদেরও নামোচ্চারণ করার রীতি রয়েছে। মহালয়ার ভোরে গঙ্গার ঘাটে যে তর্পণক্রিয়া চলে, তা এক প্রকার বারোয়ারি ব্যাপার, মত নবকুমারবাবুর। এক জন পুরোহিত জনা পনেরো মানুষকে তর্পণ করাচ্ছেন। এক জনের গোত্রের উপরে অন্যের গোত্র চেপে বসছে, এক জনের পিতামহের নামে মিশে যাচ্ছে অন্য জনের প্রপিতামহের নাম…! সে এক গোলমেলে ব্যাপার।
তবে এ বিষয়ে একমত হলেন না নতুন প্রজন্মের পুরোহিত উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তমের বাড়ি দক্ষিণেশ্বর। মহালয়ার দিন সেখানে এলাহি ব্যাপার। একসময়ে অগণিত মানুষ আসতেন ভবতারিণীর মন্দির সংলগ্ন ঘাটে তর্পণ করতে। ইদানীং মন্দিরে কড়াকড়ি বেড়েছে। কিছু ক্ষণের জন্য তর্পণকারীদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। উত্তম অবশ্য সেখানে যান না। তিনি যান দেওয়ান দাতারাম মণ্ডল ঘাট অথবা মুক্তকেশী ঘাটে। একসঙ্গে একাধিক যজমানকে তর্পণ করাতে কোনও সমস্যা হয় না, জানালেন উত্তম। তর্পণের প্রারম্ভিক পর্ব সকলের জন্যই এক। একসঙ্গে পাঁচ-ছয় জনকে তর্পণ করালে একসঙ্গে দেব, মনুষ্য, ঋষি তর্পণ করানোর পর পিতৃতর্পণের সময় আলাদা করেই করান। কোনও সমস্যা কখনও হয়নি।
মহালয়ার দিন কলকাতার ঘাটে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
তবে একটি বিষয় নবকুমারবাবু এবং উত্তম, দু’জনেই জানালেন। সেটা পূর্বোল্লেখিত ‘ছায়াপুরুষ’ তথা বহিরাগত পুরোহিতদের নিয়ে। মহালয়ার আগের দিন জেলা থেকে অগণিত পুরোহিত কলকাতায় পা রাখেন। সঙ্গে থাকেন কোনও সহায়ক। সাধারণত সপুত্রই বেশি আসেন তাঁরা, তবে ভাইপো, ভাগ্নে, শ্যালকেরাও আসেন। তাঁদের হাতে থাকে বড়সড় বস্তা বা থলে। কলকাতার গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটেই চাদর মুড়ি দিয়ে কোনওক্রমে রাতটুকু কাটিয়ে ভোর হতেই নেমে পড়েন গঙ্গায়। শুরু হয় তর্পণ করানো। কলকাতার বাবুঘাট থেকে শোভাবাজার, বরাহনগরের কুঠিঘাট থেকে দক্ষিণেশ্বরের ঘাটগুলিতে এই বহিরাগতেরা যজমান ধরে তর্পণ করান। নগদ টাকার সঙ্গে জোটে নৈবেদ্য বা উৎসর্গের চাল, ফলমূল। সে সবই ঢুকে পড়ে সঙ্গে আনা বস্তা বা থলের ভিতর। বেলা বাড়লে সেই বস্তা ভরে টইটম্বুর। সন্ধের ট্রেনে বাড়ি ফিরে যান বহিরাগতেরা। কোত্থেকে আসেন তাঁরা— প্রশ্ন করায় জানা গেল, মেদিনীপুর থেকেই বেশি সংখ্যক পুরোহিত আসেন, তবে দক্ষিণবঙ্গের অন্য জেলাগুলি থেকেও যে তাঁরা আসেন না, এমন নয়। তর্পণ এমনই এক কাজ, যাতে আয় মন্দ নয়। উত্তম জানালেন, প্রতি বছর মহালয়ার দিন তাঁর হাতে চার-পাঁচ হাজার নগদ টাকা আসেই। যত বেশি যজমান, তত বেশি আয়। বহিরাগত পুরোহিতেরা তাই একই সঙ্গে বেশ কিছু যজমান নিয়ে তর্পণে নামেন।
একসময়ে দক্ষিণেশ্বরের মতো জনপদে মহালয়া এক বিপুল উৎসবের চেহারা নিত। অসংখ্য মানুষ, বলা যেতে পারে, আবালবৃদ্ধবনিতা সমবেত হতেন সেই জনপদে। গাড়ি, মোটরবাইক, সাইকেল রাখার জন্য স্থানীয় ছোকরাদের মধ্যে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। পুজোর আগে বোনাসের মতো মহালয়া একটা আয়ের বন্দোবস্ত করে দিত স্থানীয় বেকার ছেলেদের। এখন কিন্তু সেই রমরমা আর নেই। আগে যাঁরা আসতেন, তাঁদের একটি বড় অংশের সঙ্গে তর্পণের কোনও সম্পর্ক ছিল না। বেশির ভাগ লোক এসে জুটতেন অমাবস্যায় ভবতারিণী দর্শনে অথবা নেহাতই দক্ষিণেশ্বর ভ্রমণে। এখন মন্দিরে নিয়মকানুন কড়া হওয়ায় সেই ভিড়টা কমেছে, এ কথা উত্তম জানালেন। তবে মুক্তকেশী বা মণ্ডল ঘাটে একান্ত ভাবে তর্পণেচ্ছুদেরই ভিড়।
শুধুমাত্র তিল আর জলের অঞ্জলিতেই কি তৃপ্ত হন পিতৃপুরুষ? ঐহিকতার বাইরে এ এক অন্য জগৎ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
তর্পণে কি উৎসাহ হারাচ্ছে নতুন প্রজন্ম? চল্লিশ বছর আগে যা আবশ্যিক ছিল সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে, তাতে কি ভাটা পড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। নবকুমারবাবু বললেন, “একেবারেই নয়। বরং তর্পণ করার লোক বেড়েছে। বহু মানুষই তর্পণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।” কেন এই উৎসাহ বৃদ্ধি, প্রশ্নের উত্তরে নবকুমারবাবু খানিক উদাস হয়ে পড়লেন। বললেন, “অন্য ধর্মের মানুষদের মধ্যে যেমন ধর্ম নিয়ে একটা প্রকাশ্য প্রদর্শনের জায়গা তৈরি হয়েছে, তার পাশাপাশি সনাতনীরাও ধর্মীয় আচার পালনে খানিক বেশিই সচেতন হয়ে পড়ছেন। তা থেকেই হয়তো এই সংখ্যাবৃদ্ধি।”
কোথাও কি একটা রাজনীতির গন্ধ পাওয়া গেল? গলির মোড়ে মোড়ে শনি আর কালী মন্দিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হনুমানের মন্দির। বাঙালি পুরোহিতকেও আয়ত্ত করতে হচ্ছে ‘হনুমান চালিসা’-র পাঠ। তারকেশ্বর যাত্রায় বেড়েছে স্পনসরশিপের ধুম। সারা বছরই নাকি এখন তারকেশ্বর যাত্রা চলে। বড় বড় ট্যাবলো আর তাতে প্রায় ডিজে-প্রতিম বাক্সে বেজে চলা বলিউডি গানের সুরে শিবভজন। তা হলে তর্পণও কি সে দিকেই ঢলছে? নবকুমারবাবু অবশ্য একেবারেই উড়িয়ে দিলেন এই সব ‘দুর্ভাবনা’। জানালেন, তর্পণের মধ্যে তো কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই! যে কোনও মানুষ যে কোনও প্রয়াতকে জলদান করতে পারেন। বিশ্বের সপ্তদ্বীপের মানুষকে জলদানের বিধি রয়েছে। সেখানে জাত নেই, বর্ণ নেই, ধর্ম, এমনকি লিঙ্গভেদও নেই। বারাণসীতে শাস্ত্র অধ্যয়নের সময়ে এক মুসলমান শিক্ষকের কাছেও সংস্কৃতের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন নবকুমারবাবু। সেই শিক্ষক তাঁর পিতৃতুল্য। বহু দিন হল তিনি প্রয়াত। তাঁকেও প্রতি পিতৃপক্ষে তিল ও জল দান করেন, তাঁরও তর্পণ করেন তিনি। তবে ইদানীং মহিলাদের মধ্যে তর্পণের প্রবণতা যে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে, সে কথা জানালেন নবকুমারবাবু।
ক্রমশ নিবে আসে শরতের ছোট হতে থাকা বেলা। আলো কমে আসে। জনহীন হতে থাকে গঙ্গার ঘাট। যে সব ছায়াশরীর আগের দিন থেকে থানা গেড়েছিল ঘাটে, তারা এ বার ঘরমুখী। বাঁধা হয়ে গিয়েছে বস্তার মুখ। সঙ্গের সহায়ককে নিয়ে ফেরার ট্রেন ধরতে হাওড়ামুখী পুরোহিতেরা। পিতৃপক্ষের অন্ত হল। অন্ন-পান লাভ করলেন পিতৃপুরুষ। এ বার দেবীপক্ষ উৎসবের সূচনা। পরলোক থেকে যাঁরা স্পর্শ করছিলেন ঐহিক ভূমি, তাঁরা কি তৃপ্ত হলেন? অন্নে, দুগ্ধে, বৈভবে কাটানো ইহজীবন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ছায়ালোকে কি তাঁদের প্রয়োজন সামান্য তিল আর জল? সম্বৎসর উন্মুখ হয়ে থাকেন শুধুমাত্র এইটুকুর জন্য! কোথাও যেন ঘূর্ণিপাক দিয়ে ওঠে শ্মশানবৈরাগ্যের হাওয়া। ইহজীবন মানে তা হলে সামান্য এক সময় পরিসর! যার আগে অন্ধকার অ-জ্ঞান আর পরে যাবতীয় আড়ম্বরের আকৃতি ঝরে যাওয়া এক পরলোক, যেখানে তিলই খাদ্য ও জলই পানীয়? উন্মুখ প্রতীক্ষা শুধু উত্তরপুরুষের হাতে সেটুকু পাওয়ার জন্যই? দেবীপক্ষে জ্বলে ওঠে আলোকমঞ্জির। উৎসবের আভা এসে ভুলিয়ে দেয় সাময়িক বৈরাগ্য-ভাবনা। পিতৃপুরুষেরা, মহামাতারা অপেক্ষা করেন পরবর্তী অমাবস্যার জন্য। দীপান্বিতার আলোয় পথ চিনে নিজেদের লোকে ফিরে যাওয়ার জন্য। মণ্ডপ, রোশনাই, আতশবাজি আর গানবাজনার উল্লাসের পিছনে কি থমকে থাকে তাঁদের দীর্ঘশ্বাস? হয়তো তা-ই। হয়তো নয়। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে লালন করে আসা বিশ্বাসের ভূমিকে টলানো সহজ নয়। পিতৃপুরুষেরা তাই অপেক্ষায় থাকেন পরবর্তী পিতৃপক্ষের জন্য। সম্ভবত উত্তরপুরুষেরাও।