পয়লা বৈশাখের উদ্যাপন আছে, কিন্তু হালখাতা কি হারিয়ে যাচ্ছে? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
লম্বা গজা, লাড্ডু, দানাদার, চিনির রসে ডোবানো খাজা, তিনকোণা নিমকি— হালখাতার বাক্স খুললেই মন খুশিতে ভরে ওঠে। মিষ্টি নয়, যেন একবাক্স আবেগ নিয়ে বাড়ি ফেরা। বাঙালির সঙ্গে বাংলা ভাষার যেমন সম্পর্ক, পয়লা বৈশাখের সঙ্গেও হালখাতার তেমনই নাড়ির টান। বৈশাখের প্রথম দিনে বাঙালি বাড়িতে হালখাতার প্যাকেট আসবে না, একটা সময় সেটা ভাবাই যেত না। পয়লা বৈশাখের কয়েক দিন আগে থেকেই হালখাতার প্যাকেটে সম্ভাব্য কোন খাবারগুলি থাকতে পারে, সেটা নিয়ে কল্পনার জাল বোনা চলত মনে মনে। নববর্ষ যত এগিয়ে আসত, মনে মনে উত্তেজনার পারদ তত চড়ত। যত ক্ষণ না নিজের হাতে হালখাতার বাক্স খোলার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসছে, তত ক্ষণ উত্তেজনা জারি থাকত।
আকবরের আমলের কর আদায়ের একটি ক্যালেন্ডারেই পয়লা বৈশাখ নিয়ে জাঁকজমক শুরু। বাঙালির নতুন বছর সেই তারিখপঞ্জিরই উদ্যাপন। হালখাতার সঙ্গেও তেমনই এক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। হালখাতা ফারসি শব্দ। ফারসিতে হাল মানে নতুন। পয়লা বৈশাখের দিন ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে নতুন খাতা খোলার সময়। সময়ের বিবর্তনে এই রীতির সঙ্গে জুড়েছে মিষ্টিমুখ। বাঙালির যে কোনও শুভ কাজ এমনিতেই মিষ্টিমুখ ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। ইতিহাস যা-ই বলুক, হালখাতা মানেই রকমারি মিষ্টিভরা বাক্স আর সঙ্গে বিচিত্র সব ছবি দিয়ে সজ্জিত বাংলা ক্যালেন্ডার।
সময় বদলেছে। প্রজন্ম পাল্টেছে। ক্রমশ ডিজিটাল হচ্ছে সব কিছু। বাঙালি বাড়ির দেওয়ালে এখন আর বাংলা ক্যালেন্ডার ঝুলতে দেখা যায় না। পয়লা বৈশাখের উদ্যাপন রমরমিয়ে চললেও এই দিনটির সঙ্গে যে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে, সেটাও অনেকটাই বিস্মৃত। তেমন ভাবেই হালখাতার প্রথাও কি ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্মের মন থেকে মুছে যাচ্ছে? হালখাতার গিয়েছে যে দিন, তা কি একেবারেই গিয়েছে?
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজর্ষি ধারা বলেন, "ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে দোকানে হালখাতা করতে যেতাম। বেশ কয়েক বছর হল আর যাওয়া হয় না। তবে হালখাতায় এখন কলেজ স্ট্রিটে যাই। বইপাড়ার হালখাতা বেশ অন্য রকম। মজা হয়।’’ সদ্য কলেজে পা রেখেছেন অন্তর্জিতা পাল।যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মফস্সলের মেয়ে। পড়াশোনার সূত্রে শহরে থাকেন। হালখাতার উত্তেজনা তাঁর মনে কিন্তু এখনও অটুট। অন্তর্জিতার কথায়, ‘‘হাওড়া সংলগ্ন জায়গায় আমার বাড়ি। আমাদের ওখানে এখনও হালখাতা হয়। বাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট আসে। সঙ্গে থাকে বাংলা ক্যালেন্ডার। তবে শহরে হালখাতার চল খুব একটা চোখে পড়ে না। আমার কলকাতা নিবাসী বন্ধুদের মধ্যে হালখাতা নিয়ে কোনও উত্তেজনা দেখি না।’’
মফস্সলের দোকানগুলিতে পয়লা বৈশাখের দিন তিলধারণের জায়গা থাকে না। দোকান মালিকেরা পুরনো এবং নতুন ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুন বছর শুরু করেন। তবে শহরের ঝাঁ-চকচকে শপিং মল আর অভিজাত দোকানে অবশ্য এমন ছবি বিরল। বাঙালির আবেগ উদ্যাপনে যে মফস্সল এগিয়ে আছে, সে বিষয়ে একমত টলিপাড়ার নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রী অঙ্গনা রায়। তিনি বলেন, ‘‘আসানসোলে আমার মামারবাড়ি। হালখাতার সব স্মৃতি সেখানকার। বয়স যখন আরও একটু কম ছিল, পয়লা বৈশাখের আগে মামাবাড়ি চলে যেতাম। হালখাতার দিন দাদু দু’ব্যাগ ভর্তি মিষ্টি, ক্যালেন্ডার, পেন নিয়ে আসতেন। খুব আনন্দ হত। কিন্তু এখন সেই উত্তেজনা আর নেই। দাদু আমাদের সঙ্গেই থাকেন। আসানসোলে যাওয়া হয় না। কলকাতাতে সে ভাবে হালখাতার চল নেই। মিস্ করি ভীষণ।"
টলিউডের আরও এক তরুণ অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি নাকি এখনও প্রতি বছর হালখাতার নিমন্ত্রণ পান পাড়ার দোকানে। ঋতব্রতর কথায়, ‘‘হালখাতার মিষ্টি আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের আলাদা স্বাদ আছে। তবে আমাদের পাড়ায় আবার হালখাতায় ফুচকা খাওয়ানো হয়। টকজলে মেশানো হয় গন্ধরাজ লেবুর রস। সারা পাড়ায় সেই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায়। তখন আর নিজেকে ঘরে আটকে রাখা যায় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy