পাঁচজনে বলে যাহা, তুমিও বলিবে তাহা— এই আপ্তবাক্য মেনে চলাই সমাজের নিয়ম। তবেই ‘ভাল’র তকমা মেলে। সমাজ অবশ্য চিরকালই অন্যের মতামত তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এখন সে চেষ্টায় শরিক হয়েছে সমাজমাধ্যম। আজকের ডিজিটাল যুগে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় মতামত নির্ধারক শক্তিই তা। কিন্তু এর নেপথ্যে কাজ করে ‘অ্যালগরিদম’— এক অদৃশ্য তত্ত্বাবধায়ক, যা ঠিক করে দেয় আমরা কী দেখব, কী বিশ্বাস করব, যার ফলে ক্রমশ সচেতন বা অসচেতন ভাবে আমরা এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছি।
মগজধোলাইয়ের নেপথ্যে
গবেষক গবচন্দ্রের কথা মনে আছে? ‘হীরক রাজার দেশে’র বিজ্ঞানী, আবিষ্কার করেছিল মস্তিষ্ক প্রক্ষালণ যন্ত্র। যে যন্ত্র মস্তিষ্কে রোপণ করে মন্ত্র। ‘যারে যা শেখাতে চান, যা অভিলাষ, তাই শেখাবে’, থাকবে আমরণ। ডিজিটাল ফরেন্সিক অ্যান্ড ফিনানশিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেটর পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় বলছেন, “অ্যালগরিদমের নেপথ্যেও লুকিয়ে সেই বীজ। এ এমন এক প্রযুক্তি, যা ঠিক করে দিচ্ছে কোন পোস্ট ভাইরাল হবে, কোন হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং হবে। আর একে ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে সুবিধাভোগীরা।”
অ্যালগরিদম— কী ভাবেকাজ করে?
আদতে অ্যালগরিদম জনস্বার্থে তৈরি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর। এর মূল উদ্দেশ্য কোনও পণ্য, নির্দিষ্ট বিষয়, মতবাদ, দল বা প্ল্যাটফর্মের জন্য উপভোক্তা তৈরি করা। ব্যবহারকারীকে দীর্ঘ সময় একই প্ল্যাটফর্মে ব্যস্ত রাখা। সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ অভিষেক মিত্র বলছেন, “ব্যক্তি কী ধরনের কনটেন্ট পছন্দ করেন, কতক্ষণ কী দেখেন, কী শেয়ার করেন— সে ডেটা ব্যবহার করে ডিজিটাল মাইন্ড প্রোফাইল তৈরি করা হয়। তার পরে ঠিক সে রকম কনটেন্টই দেখাতে থাকে।” যার ফলে তৈরি হচ্ছে ‘ইকো চেম্বার’, এমন এক পরিসর যেখানে ব্যক্তি শুধুই নিজের মতের প্রতিধ্বনি শুনতে পান। বিরুদ্ধ মত তাঁর কাছে পৌঁছয়ই না।
সমাজ দর্পণ
অ্যালগরিদম যতক্ষণ পণ্য ও তার বাজার তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ, সমস্যা কম। কিন্তু তা যখন ব্যক্তির মননে ও যাপনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে, তখন দুশিন্তার কারণ হয় বইকি। ভাল-মন্দ বিচার করার জন্য দরকার নিজস্ব যুক্তি, বুদ্ধি। সমাজতত্ত্ববিদ ডালিয়া চক্রবর্তী বলছেন, “বিপরীত মতামত, মতভেদ আমাদের ভাবতে শেখায়। পছন্দের বিষয় হাতের কাছে জোগান দিয়ে সমাজমাধ্যম ভুলিয়ে দিচ্ছে এর বাইরেও কিছু রয়েছে। ক্রমশ বিপরীত যা কিছু, তার প্রতি ব্যক্তি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।” উদাহরণ হিসেবে বলছেন, এক দিকে আধুনিক প্রজন্মকে এখন ‘উদ্ধত’, ‘অসভ্য’ বলা হয়। আবার একই ভাবে যাঁরা ঐতিহ্য আঁকড়ে রয়েছেন, তাঁদের ‘প্রাচীনপন্থী’ বলে চিহ্নিত করা হয়। অথচ এই দুই প্রজন্মের বড় হওয়ার পরিবেশ আলাদা, ভাবনাচিন্তাও আলাদা। তাঁদের নিজ নিজ সময়ের নিরিখে বিচার করা দরকার। কিন্তু সেই উদারতা দেখাতে শেখাচ্ছে না সমাজমাধ্যম।
ব্যবসার জায়গা
রিচ কমে গিয়েছে, পোস্ট বেশি সংখ্যক লোকের কাছে পৌঁছচ্ছে না— সমাজমাধ্যমের পরিচিত সমস্যা। সমাধান, অর্থের বিনিময়ে পোস্ট বুস্ট করা। সেখানেই কাজ করে অ্যালগরিদম। এ হল প্রযুক্তির বিপরীতে তাকেই ব্যবহার করে তৈরি এক ব্যবসার ক্ষেত্র। রাজনীতির ময়দান থেকে বিনোদন দুনিয়া— সর্বত্র এর জাল বিছিয়ে। প্রায়ই সমাজমাধ্যমে নতুন ছবি, বই, রেস্তরাঁর হাইপ দেখা যায়। তার অনেকটাই প্রযুক্তির দাক্ষিণ্যে। পার্থপ্রতিম বলছেন, “নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলি অ্যালগরিদম নিয়ে খেলে, ব্যবহারকারীর ফিড ভরে যায় পছন্দের রাজনৈতিক দলের ভূয়সী প্রশংসা কিংবা বিপরীত দলের সমালোচনায়।”
সমস্যা কোথায়?
‘ফ্রেন্ডস অব ফ্রেন্ডস’-এর হাত ধরে অ্যালগরিদমের কল্যাণে ছড়িয়ে যাচ্ছে একঘেয়ে ক্লিশে চিন্তাধারা। দু’মিনিটের রিলও ফাস্ট ফরোয়ার্ডে দেখার এই সময়ে মুদ্রার অপর পিঠে কী আছে, তা তলিয়ে ভাবছেন না কেউ। এই মেকি দুনিয়াটাকেই সত্যি বলে ভাবছে। তা ছাড়া, অ্যালগরিদম ব্যক্তিগত তথ্যনির্ভর। ফলে তথ্য চুরির সমস্যা আছে। সঙ্গে ভুয়ো বিজ্ঞাপন, ভুয়ো খবরের মতো সাইবার ক্রাইমও বাড়ছে।
ছবি: জয়দীপ মণ্ডল।
সঙ্গী মন খারাপ
সমাজমাধ্যমে এমনিতেই দেখনদারি বেশি। সেটাকেই ভাল থাকার মাপকাঠি ধরে নিয়ে নিজেকে ব্যর্থ মনে করছেন অনেকেই। ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন, ডুবে যাচ্ছেন হতাশায়। আবার এক্স, মিলেনিয়ালস, জ়ি, আলফা প্রজন্ম নির্বিশেষে পোস্টে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেলেই জায়গা করে নিচ্ছে ফিয়ার অব মিসিং আউট (ফোমো)র মতো সমস্যা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, “এর ফলে মানসিক অস্থিরতা, একাকিত্ব বাড়ছে, কমছে আত্মবিশ্বাস। সহমর্মিতা, সহানুভূতি ছেড়ে ক্রমশ আক্রমণাত্মক, অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে সে। জায়গা করে নিচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় ভেদাভেদ, বিদ্বেষ।” প্রতিবাদ, সমালোচনার আগুন সেখানে প্রতি মুহূর্তে জ্বলছে। আর তাপ কমে এলে তাতে হাওয়া দিচ্ছে অ্যালগরিদম।
শেখাবে কে?
সমস্যাটা জানা, তবে সমাধান কঠিন। সমাজতত্ত্ববিদ ডালিয়া বলছেন, “হীরক রাজার দেশেতে উদয়ন পণ্ডিত ছিল। ঠিক-ভুলের হিসাব সে ঠিক ঠিক শিখিয়েছিল। এখন মা-বাবা, শিক্ষক সকলেই সমাজমাধ্যমে বুঁদ। বাচ্চার স্ক্রিন টাইম বেঁধে তো দিলেন, কিন্তু সেই বাঁধা সময়ে সে কী দেখছে, কী শিখছে তার নজরদারি করছেন কি আদৌ! অ্যালগরিদম গ্রাস করেছে তাদেরও। ছোট থেকেই এর কবলে পড়ে বাড়ছে জেদ, অবাধ্যতা।”
ভেবে দেখেছ কি!
তবে প্রযুক্তির ঘাড়ে সব দায় চাপাতেও নারাজ ডালিয়া। বলছেন, “এই স্ক্রল করতে করতেই একদিন মানুষ ঠিক বিরুদ্ধযুক্তির কাছে পৌঁছে যায়। তা না হলে এত আন্দোলন, পরিবর্তন আসে কী করে!” এই প্রযুক্তির হাত ধরেই একজনের সৃষ্টি পৌঁছে যাচ্ছে সমমনস্ক আর একজনের কাছে। বাড়ছে কাজের সুযোগ। ডালিয়ার মতে প্রয়োজন শুধু কতক্ষণ, কী দেখছেন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং কনটেন্ট লিস্টে বৈচিত্র রাখা।
ডিজিটাল লিটারেসি
প্রযুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ পিছিয়ে পড়া। বরং সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা জরুরি। অভিষেক বলছেন “এখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মতোই ডিজিটাল লিটারেসিও দরকার।” নিজের মতামতই ঠিক— সেই গোঁ ধরে বসে না থেকে, ভেবে দেখতে হবে সেই মত অ্যালগরিদম প্রভাবিত কি না। বিপরীত মতের সংস্পর্শে এলে ‘এমনটাও কি হতে পারে?’ খোলা মনে সেই প্রশ্ন নিজেকেই করা দরকার। সেই সঙ্গে যে কোনও স্পর্শকাতর খবর বিশ্বাস না করে তার অ্যালগরিদমিক ট্রান্সপারেন্সি কতটা রয়েছে, তা বিচার করার চেষ্টা করতে হবে। ডা. মুখোপাধ্যায় বলছেন, “তা সম্ভব না হলে বরং কমেন্ট বা শেয়ার করার আগে সময় নিন।”
এ পথের ‘শেষ’ আছে
সমাজমাধ্যমের একটু সচেতন ব্যবহারই এই কোডিং জাল ভাঙতে পারে। নিজেকেই ফিল্টার করতে হবে, কী দেখবেন। পর পর একই জিনিস আসছে মনে হলে ‘স্কিপ’ করে যাওয়া যায়। ভিডিয়ো, রিলস ‘হাইড’ করার অপশনও থাকে। কোনও পোস্টে ‘ডাজ় নট ম্যাচ মাই ইন্টারেস্ট’ অপশনে ক্লিক করলে, সে ধরনের বিষয়বস্তু ফিডে আসা কমতে শুরু করবে। ব্রাউজ়ারে কিছু খোঁজার জন্য ইনকগনিটো উইন্ডো ব্যবহার করুন। এতে থার্ড-পার্টি কুকিজ়ের অ্যাক্সেস ব্লক করা থাকে, যাতে এড়ানো যাবে অ্যালগরিদমের নিয়ন্ত্রণ। জেন জ়ি, আলফা যারা ডিজিটাল দুনিয়ায় বড় হচ্ছে, তারা এমনিতেই ভীষণ টেক-স্যাভি। প্রযুক্তির ক্ষতির দিকটা তাদের যথাসম্ভব বোঝাতে হবে। ছোট বাচ্চাদের কনটেন্টে যাতে শিক্ষণীয় কিছু থাকে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
ভার্চুয়াল দুনিয়া ছেড়ে বাস্তব দুনিয়ায় মেলামেশার বিকল্প কিছু হতে পারে না। অ্যালগরিদম আপনি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে ব্যবহার করুন। কিন্তু তা যেন আপনাকে গ্রাস না করে নেয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ছবি: জয়দীপ মণ্ডল, মডেল: সুস্মেলি দত্ত, প্রমিত সোম, মুনমুন দত্ত
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)