E-Paper

দুই মলাটের গুপ্তধন

সমীক্ষা বলছে, বই পড়ার আগ্রহ কমছে। ছাপা অক্ষরে বা ডিজিটাল মাধ্যমে গল্পপাঠের অভ্যাস ফেরাবেন কী ভাবে।

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:১১
ছবি: সর্বজিৎ সেন।

ছবি: সর্বজিৎ সেন।

একটা সোনার চাবি ছিল। সেটা দিয়ে অ্যালিসের আশ্চর্য দুনিয়ার দরজাটা খোলে, সেটাতেই বুরাতিনোদের বাড়ির ছোট্ট কপাট খুলে জমকালো থিয়েটারের খোঁজ মেলে। পুরনো কাঠের আলমারিটাও সেটা দিয়ে খুললেই জামাকাপড় সরিয়ে নার্নিয়া-য় যাওয়া যায়, যেখানে গ্রেকো-রোমান উপকথার প্রাণীদের বাস, সিংহ কথা বলে।

কুড়ি-তিরিশ বছর আগে যাঁরা ছোট ছিলেন, তাঁদের কাছেও ছিল এই সোনার চাবি। অর্থাৎ, বই পড়ার সময় ও অভ্যাস। কিন্তু ডিজিটাল বিনোদনের স্তূপে কোথায় যেন সেটা হারিয়ে গিয়েছে। ফলে সন্তানকেও সেই ‘রাজার বাড়ি’র খোঁজ দেওয়া মুশকিল। অথচ তাকে পেলেই হাজির হবে আলিবাবার গুহা। রত্নরাজির ছোঁয়ায় মনের মধ্যে ভিন্ন জগৎ গড়ে উঠবে। শব্দভান্ডার, মেধা, বোধশক্তি, সৃষ্টিশীলতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ঝিকিয়ে উঠবে। বই পড়ার মজার সঙ্গে সন্তানের পরিচয় করাতে কিছু কৌশল প্রয়োগ করা যাক।

গপ্পের গরু গাছেই থাকুক

সিনেমা, রিলসের দাপটে বই পড়া যাতে কঠিন না মনে হয়, সে জন্য জোর করে নয়, আনন্দ করে পড়ান। সিলেবাসের বইও পড়ান গল্পের মতো করে। পড়া বুঝবে, মনে রাখবে সহজে।

ছোট বাচ্চাকে প্রিয় কার্টুন চরিত্রদের রংচঙে ছবির বই দিন। গল্প পড়ুন অভিনয়ের মতো হাত-পা নাড়িয়ে, চরিত্র বদলালে ভাবভঙ্গি পাল্টান। ওরা টিভি ছেড়ে ছুটে আসবে। গল্প বলে ঘুম পাড়ান। যখন নিজে পড়তে শুরু করবে, তখন গল্প বলতে বলতে জায়গা বুঝে চুপ করে যান। বলুন, ক্লান্ত লাগছে, বাকিটা পরে বলবেন। নিজেই বই টেনে বাকিটা শেষ করে ফেলবে। দেশিবিদেশি রূপকথা, উপকথার সঙ্গে কুইজ়ের বইও দিন। খেলার ছলে আকর্ষক প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করুন। ছোটদের উপযোগী মহাকাব্যের গল্প, পৌরাণিক কাহিনির মধ্যেও অলৌকিকের রেশ রোমাঞ্চরস বোঝাই রয়েছে। বরং বিভিন্ন সংস্কৃতির লোককাহিনি জানা যায়, নীতিবোধ গড়ে ওঠে। এর পরেও টান না জন্মালে প্রায় অব্যর্থ কমিকস। বাসে-ট্রেনে— সর্বত্র বাচ্চার সঙ্গে বই রাখুন, খেলনার সঙ্গেই। সুকুমার রায় থেকে এডওয়ার্ড লিয়ার— চিত্রবিচিত্র আজব ছড়া শেখান আবৃত্তির ঢঙে।

প্রযুক্তিনির্ভর বই-চিত্র

প্রযুক্তির দুনিয়া কিন্তু ব‌ইপাড়ার কট্টর বিরোধী নয়। বরং, আধুনিক রিডিং অ্যাপগুলি এমন ভাবে তৈরি যে কায়দা করে কাহিনি মনে গেঁথে দেয়। জরুরি অংশ ‘হাইলাইট’ করার, নতুন বিষয় বোঝার বিশেষ সুবিধা থাকে— পড়ার অনুভূতি মসৃণ হয়। ই-বুক বা কিন্ডল-এ এক মুহূর্তে শত-সহস্র বইয়ের সুবিশাল লাইব্রেরি মেলে, সাশ্রয়ীও। বইগুলির আয়তন দেখা যায় না। ফলে, তাড়াতাড়ি অনেকটা পড়া হয়ে যায়। আবার অডিয়ো-বুকও এখন খুব জনপ্রিয়। পুরনো মোবাইল থাকলে সব অ্যাপ সরিয়ে কিছু অডিয়ো বুক ভরে ছোটদের দিন। যেমন, ‘দ্য সিক্রেট গার্ডেন’ বা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্পগুলি। মোবাইলের শখ মিটবে, স্ক্রোলিংয়ের ফাঁদেও পড়বে না। বরং এক মনে গল্প শুনবে। এর পরে ভাল বাঁধাই, সুদৃশ্য প্রচ্ছদ, ছবিওয়ালা বই দেখলে নিজেই তা নিয়ে পড়বে। আবার টেক্সট টু স্পিচ অপশন থাকে মোবাইলে। সেটির ব্যবহার করেও কোনও গল্প শুনে ফেলতে পারে বাড়ির কচিকাঁচারা।

বাড়িতে অ্যালেক্সা থাকলে একদম ছোট বাচ্চাদের জন্য তা ব্যবহার করা যায়। অ্যালেক্সাও গল্পদাদুর মতো গল্প শুনিয়ে দেবে। অনেক বাচ্চারই অভ্যাস থাকে, গল্পের মাঝে থামিয়ে নানা প্রশ্ন করে। সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে, এমন ইন্টারঅ্যাক্টিভ স্টোরি রিডি‌ং-এর সুযোগও থাকে কিছু অ্যাপে। বই হোক বা প্রযুক্তিনির্ভর গল্পের দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ তৈরি করতে হবে বাচ্চাদের। আর সেখানে বাংলা-ইংরেজি কোনও ভাষাকে বাদ দেবেন না। দুই দুনিয়াতেই শিশু-কিশোর সাহিত্যে অগাধ হিরে-জহরত।

যা পড়ল, তার সঙ্গে সম্পর্কিত জায়গায় ঘুরিয়ে আনুন। পঞ্চতন্ত্র, ঈশপের গল্প পড়লে চিড়িয়াখানায় যান। ঘুরতে গেলে ডায়েরি লিখতে বলুন। সাহিত্যের সঙ্গে সংযোগ গড়ে উঠবে। অ্যাসটেরিক্স, ফেলুদা, শঙ্কু, কাকাবাবু, হ্যারি পটার, পার্সি জ্যাকসন— এক বার সিরিজ়গুলোয় ঢুকে পড়লে পড়ার অভ্যাসে একেবারে ডুবে যাবে। এখন বইয়ের চরিত্রদের নিয়ে নানা বোর্ডগেম বা ট্রাম্পকার্ডও রয়েছে। সেগুলোও পড়ার, জানার খিদে বাড়ায়।

পড়া পড়া খেলা

বইবিপণিতে নিয়ে গিয়ে বই বাছার, নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ করে দিন। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরিগুলি এখনও কিছু টিকে আছে। সেখানেও নিয়ে যেতে পারেন। বাড়ির একটা অংশে কিছু বই সাজিয়ে আয়েশ করে পড়ার ব্যবস্থা রাখুন। নিজের লাইব্রেরি পেয়ে খুশিই হবে ও। অনেক জায়গায় বুক রিডিং সেশন হয়, বিভিন্ন বই ও খেলনার বিপণি এমন সেশনের আয়োজন করে। একটু খোঁজখবর করে তেমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন। বাড়িতেও বসাতে পারেন গল্পদাদুর আসর। আপনি নিজেই গল্পবলিয়ে হয়ে যান। খুদের বন্ধুদের ডেকে নিন, সুন্দর করে বসার ব্যবস্থা করে দিন, ওর গল্পে বুঁদ হয়ে যাবে।

বাচ্চার পছন্দ খেয়াল করে বই উপহার দিন। খেলা-অন্ত প্রাণ হলে খেলোয়াড়দের ছোটবেলার গল্পের বই, মতি নন্দীর কাহিনি। মহাকাশে নজর হলে কল্পবিজ্ঞান। রহস্যগল্পে ঝোঁক হলে তো বৈচিত্র অঢেল। হেমেন্দ্রকুমার রায়, সুকুমার-সত্যজিৎ, লীলা মজুমদার, এনিড ব্লাইটন, রোয়াল্ড ডালের পাশাপাশি আজকের উইম্পি কিড।

বইমেলায়, সাহিত্য-উৎসবে নিয়ে যান। প্রিয় সাহিত্যিককে কাছ থেকে দেখার, তাঁদের গল্প শোনার, প্রচুর বইয়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ মিলবে। অ্যাপ বা যন্ত্রের মাধ্যমে গল্প পড়লেও ক্ষতি নেই, তবে চোখ বাঁচিয়ে। যদিও কাগজে ছাপা অক্ষরমালা, আঁকা ছবির আরাম আলাদাই। তবে যে ভাবেই পড়ুক, ওদের ঘিরে থাকুক গল্পের দুনিয়া। সেখানে টিনটিন দৌড়য়, অপু কর্ণ সাজে, উম্পা-লুম্পারা গান শোনায়, কুমিরের পেটে বসে সাঁওতালনি এক গা গয়না পরে বেগুন বেচে। তাই এক বার যে সেই মায়াজালে জড়িয়েছে তার কাছে ফোনের রিলস বা অবান্তর ভিডিয়ো একেবারেই পিটুলির দলা।

চিরশ্রী মজুমদার

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

reading habit

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy