সুজাপুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন ইমাম। — নিজস্ব চিত্র।
‘তোমাদের বাড়িতে কারও জ্বর-টর হয়নি তো গো?’
সদর দরজার বাইরে থেকে প্রশ্নটা উড়ে আসতেই সাবিনা ইয়াসমিন প্রথমে ভেবেছিলেন স্বাস্থ্য দফতরের কেউ হবে। কিন্তু বাড়ির বাইরে বেরিয়ে তিনি অবাক। শনিবার সাতসকালে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রঘুনাথগঞ্জের সুজাপুরের মসজিদের ইমাম মহম্মদ আনারুল ইসলাম। সাবিনার থতমত অবস্থা দেখে ইমাম তাঁকে আশ্বস্ত করেন, ‘‘ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। চারদিকে জ্বর হচ্ছে। গ্রামে একজনের ডেঙ্গিও ধরা পড়েছে। তাই সকলকেই সাবধান করছি।’’ তাঁর পরামর্শ, ঘরে-বাইরে কোথাও জল জমিয়ে রাখবেন না। মশারি টাঙিয়ে ঘুমোবেন। আর জ্বর হলেই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। ইমামকে দেখে ততক্ষণে ভিড় জমিয়েছেন আরও অনেকে। সেখানকার পাঠ চুকে যেতে ইমাম হাঁটা দিলেন পাশের বাড়ির উদ্দেশে।
জ্বর নিয়ে সচেতনতার প্রথম পাঠটা শুরু হয়েছিল শুক্রবার গ্রামের ইদগাহ ময়দানেই। নমাজের শেষে ইমাম উপস্থিত কয়েক হাজার লোকজনকে মাইকে সচেতন করা হয় এই ব্যাপারে। তারপর থেকেই কখনও তিনি একা, কখনও মসজিদেরই কয়েকজনকে নিয়ে সুজাপুরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করছেন। ইমামের সেই কথা মন দিয়ে শুনছেন গ্রামের বাসিন্দারাও। আব্দুল আসিফ মণ্ডলের কথায়, ‘‘আমাদের ইমাম সাহেব বহু বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। বিপদ এড়াতে তাই তিনি সকলকে সতর্ক করছেন। আমিই তো এই গরমে মশারি টাঙাতাম না। কিন্তু এখন দেখছি মশারি না টাঙালে বিপদ বাড়বে।’’
মুর্শিদাবাদে পোলিও খাওয়ানো, নাবালিকার বিয়ে বন্ধ কিংবা বার্ড ফ্লু-এর মতো বিষয়ে লোকজনকে সচেতন করতে এর আগেও পথে নেমেছিলেন ইমামরা। কিন্তু হঠাৎ জ্বর নিয়ে এমন হইচই কেন?
হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে খবর, সুজাপুর গ্রামের পাঠানপাড়ার বাসিন্দা ফজলু খাঁ প্রায় পনেরো দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। প্রথমে তিনি বিষয়টিকে আমল দেননি। কিন্তু জ্বর না কমায় তাঁকে প্রথমে জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে রক্ত পরীক্ষার পরে জানা যায় তিনি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। ২২ সেপ্টেম্বর তাঁকে বহরমপুরে পাঠানো হয়। সেখানেও তাঁর রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গি ‘পজিটিভ’ হওয়ায় ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে। জঙ্গিপুরের সহকারি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তথা হাসপাতালের সুপার শাশ্বত মণ্ডলও জানান, ফজলু খাঁয়ের রক্তে ডেঙ্গি পজিটিভ মিলেছে। তাই তাঁকে চিকিৎসার জন্য বহরমপুর হয়ে কলকাতায় পাঠানো হয়েছে।
ইতিমধ্যে দেশ জুড়ে ডেঙ্গির কারণে বেশ কয়েকজনের মারা গিয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ে বাড়িতে জমিয়ে রাখা পরিষ্কার জলে এডিস ইজিপ্টাইয়ের লার্ভা মেলায় বেশ কয়েকজন চিত্রতারকাকে নোটিস পাঠিয়েছে মুম্বই পুরসভা। এই দিনই কলকাতার দু’টি হাসপাতালে মারা গিয়েছে দু’জন। মুর্শিদাবাদের সুজাপুরের ফজলু এখনও কলকাতার এনআরএসে চিকিৎসাধীন। ওই ইমামের কথায়, ‘‘এমন অবস্থায় এই এলাকাতেও তো বিষয়টি নিয়ে প্রচার করা উচিত ছিল স্বাস্থ্য দফতর ও প্রশাসনের। অথচ কেউই কিছু করছেন না দেখে আমি নিজেই পথে নামলাম। টিভি ও খবরের কাগজে ভাল করে নজর রাখছি। গ্রামবাসীদের সে রকমটাই বোঝাচ্ছি।’’
বিষয়টি মানছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁরা বলছেন, ‘‘কই, জ্বর-জ্বালা নিয়ে তো স্বাস্থ্য দফতরের কোনও লোকজন আসেননি।’’ অথচ জঙ্গিপুর হাসপাতালের সুপার শাশ্বতবাবু বলছেন, ‘‘স্বাস্থ্যকর্মীদের বলা হয়েছে গ্রামে গিয়ে আর কেউ জ্বরে আক্রান্ত কি না তার খোঁজ করে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু কেন এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রামে গেলেন না কেন তা খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’
তবে স্বাস্থ্য দফতর বা প্রশাসনের কে কবে আসবেন সে ব্যাপারে ভরসা রাখছেন না ইমাম। তিনি বাসিন্দাদের বলে চলেছেন, ‘‘ঘরের বিষয়টি যেহেতু মহিলারা দেখেন তাই আপনাদেরও সবসময় খেয়াল রাখতে হবে, ঘরের ভিতরেও যাতে জল না জমে। প্রতিবেশীদেরও খবর রাখুন। কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy