শারীরিক যে কোনও ব্যথা, যন্ত্রণা স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। চলাফেরা, কাজকর্ম করা যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, তেমন অহরহ যন্ত্রণায় মনও বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এর মধ্যে কোমরের ব্যথা সবচেয়ে পরিচিত দৃষ্টান্ত।
কোমরে ব্যথার নানা কারণ
পেশিতে টান লেগে কোমর ব্যথা হওয়ার ঘটনা সচরাচর দেখা যায়। নিচু হয়ে বা উপুড় হয়ে অনেকক্ষণ ধরে কিছু কাজ করার জন্য বা স্বল্প পরিসরে দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে বা শুয়ে থাকলেও কোমরে ব্যথা হতে পারে। শারীরচর্চা করতে গিয়ে অনেক সময়ে কোমরের পেশিতে টান লেগে ব্যথা হয়। এই ধরনের পেশি সংক্রান্ত ব্যথাকে মাসকুলার স্প্যাজ়ম বলে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে বাত, অস্টিয়োপোরোসিস, ডিজেনারেশন বা হাড় ক্ষয় কোমরে ব্যথার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া দুর্ঘটনার ফলে কোমরের হাড় ভেঙে গিয়ে বা মেরুদণ্ডের ডিস্কে চোট থেকে ব্যথা হতে পারে। ভার্টিব্রা বা কশেরুকাতে ফ্র্যাকচার হয়েও ব্যথা হতে পারে। দুটো ভার্টিব্রার মধ্যে অস্থিসন্ধিতে স্পন্ডিলাইটিসের জন্যও কোমরেব্যথা হয়। অতিরিক্ত ওজনও এই ব্যথার আর একটি কারণ। তবে বেশ কিছু রোগের প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবেও কিন্তু কোমরে ব্যথাহতে পারে।
এই বিষয়ে মেডিক্যাল কলেজের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘ত্বক, পেশি, হাড়, স্নায়ু এবং শরীরের ভিতরের কয়েকটি অঙ্গের সমস্যায় ব্যাক পেন হয়। তাই কোমরে ব্যথার কারণ শুধুমাত্র বাত, অস্টিয়োপোরোসিস, স্পন্ডিলাইটিস নয়। যেমন, কোমরের দিকে ত্বকে হারপিস জোস্টার হওয়া জানান দেয় কোমরের ব্যথা। প্রথম তিন-চার দিন কোমরের যে কোনও একটা দিকে ভীষণ ব্যথা হবে। তার কিছু দিন পরে দেখা যাবে সেখানে ফোসকার মতো হয়েছে। এ ছাড়া কোমরে ব্যথার আরও বেশ কিছু কারণ আছে, যা চট করে অনুমান করা যায় না। যেমন কোমরের দিকে হাড়ে কোনও ম্যালিগন্যান্সি হতে পারে, বোন টিবি হতে পারে। কোমরে ব্যথা পায়ের প্যারালাইসিসেরও পূর্বাভাস। এ ছাড়া কোমরে ব্যথার অন্যতম কারণ কিডনি ও প্যানক্রিয়াসের অসুখ। কিডনি সংক্রমণ, কিডনি স্টোন, প্যানক্রিয়াটাইটিসের অন্যতম উপসর্গ কোমরে ব্যথা। ক্যানসারের কারণেও কোমরে ব্যথা হতে পারে। মহিলাদের জরায়ুতে সংক্রমণ হলে এবং বেশ কিছু স্ত্রীরোগের সঙ্কেত কোমরে ব্যথা।” এ ছাড়া নিউরোলজিক্যাল সমস্যা থেকেও এই ব্যথা হতে পারে।
কোমরে ব্যথা হলে সচেতন হতে হবে ক্যানসার আক্রান্তদের। এই বিষয়ে ক্যানসার শল্যচিকিৎসক ডা. গৌতম মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘সাধারণত যে সব ক্যানসারের ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে অর্থাৎ মেটাস্ট্যাটিক ক্যানসার, সেটা কোমরের দিকে ছড়ায়। যেমন লাং ক্যানসার, স্তন ক্যানসার ইত্যাদি। কোমরের হাড়ে ক্যানসার ছড়ালে ব্যথা হবে। তাই ক্যানসারের রোগীদের যদি আগে কোমরে ব্যথা না থাকে, নতুন করে ব্যথা হয়, তা হলে সতর্ক হতে হবে।’’
পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের কোমরে ব্যথার সমস্যা কিছুটা বেশি। এর অন্যতম কারণ মহিলাদের মেনোপজ়ের পরে ইস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শরীরে ভিটামিন ডি-র অভাব হাড়ের উপরে প্রভাব ফেলে। কিন্তু এর বাইরে মহিলাদের একাধিক রোগের উপসর্গ কোমরে ব্যথা। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ইউটেরাস, ফ্যালোপিয়ান টিউব, ওভারি এই পেলভিক অঙ্গগুলিতে রোগ হলে তার অন্যতম উপসর্গ কোমরে ব্যথা। এই অংশে অসুখের কারণে পেলভিক নার্ভের উপরে চাপ পড়ে, তার থেকে ব্যথা শুরু। ইউটেরাসে ফাইব্রয়েড হলে, অ্যাডিনোমায়োসিস হলে বা সারভাইক্যাল ক্যানসার হলে কোমরে ব্যথা অনুভূত হয়। এ ছাড়া ওভারিতে বড় টিউমার হলে তা পেলভিক নার্ভের উপরে চাপ দেয়, পরিণতি ব্যথা। পেলভিসের পেশিগুলো জরায়ুকে আগলে রাখে, সেগুলো দুর্বল হয়ে পড়লে ইউটেরাইন প্রোল্যাপ্স বা জরায়ুর স্থানচ্যুতি ঘটে বাইরে চলে আসে। এতে মারাত্মক কোমরে ব্যথা হয়। পেলভিক ফ্লোরে ডিসফাংশনের জন্য মূত্রথলি নেমে যায়, সে ক্ষেত্রেও ব্যথা হয়। গর্ভাবস্থায় রিল্যাক্সিন হরমোন নিঃসরণের জন্যও কোমরে ব্যথা হতে পারে।” কিছু পরীক্ষা করেই বলে দেওয়া যায় গাইনিকোলজিক্যাল সমস্যার জন্য কোমরে ব্যথা হচ্ছে না অন্য কারণে।
কোন সমস্যার জন্য কোমরে ব্যথা হচ্ছে, তা বোঝার উপায় কী? উত্তরে ডা. তালুকদার বললেন, ‘‘কোমরে ব্যথা কত দিন ধরে হচ্ছে, ক্রমাগত হচ্ছে না মাঝেমধ্যে হচ্ছে, সেটা জানা জরুরি। এই ব্যথার সঙ্গে বমি হচ্ছে কি না, জ্বর আছে কি না, ইউরিনে সমস্যা আছে কি না, তা দেখা জরুরি। তার পরে পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। তাতেই ধরা পড়ে ব্যথার কারণ।’’
ছবি: সংগৃহীত।
ভাল থাকার জন্য
রোগবালাই ছাড়াও কিছু অভ্যেসের জন্যও কোমরে ব্যথা হতে পারে। দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে কাজ বা পড়াশোনা করেন অনেকেই। অফিসে কাজ বা পড়াশোনার বাইরে অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে টিভি দেখেন, গেম খেলেন, সিনেমা দেখেন। হাঁটাচলা প্রায় হয়ই না। এতে কোমরে ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। ‘‘যাঁরা অনেকটা সময় চেয়ারে বসে কাজ করেন, তাঁরা ব্যথা এড়াতে কাজের ফাঁকে চেয়ারে বসেই একটা ব্যায়াম করতে পারেন। প্রথমে চেয়ারে সোজা হয়ে বসুন। পা দুটো চেয়ারের ধার বরাবর প্রসারিত করুন। দু’হাত দিয়ে কোমর ধরুন। বুড়ো আঙুল দিয়ে কোমর সামনের দিকে পুশ করুন। এর পরে আপনার পেলভিক পার্ট সামনের দিকে পুশ করুন। ১৬ অবধি গোনার পরে রিল্যাক্সড হন। এ ভাবে আট থেকে দশ বার করতে হবে,’’ বললেন ফিটনেস এক্সপার্ট সৌমেন দাস।
এ ছাড়া যাঁরা নিয়মিত অনেকটা পথ মোটরবাইক চালান, তাঁদেরও পরে কোমরে ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ‘‘নিয়মিত মোটরবাইক চালালে রোজ অন্তত ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি ভুজঙ্গাসন করতে পারলে ভাল। এ ছাড়া প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছ’বার দেওয়ালে একটা হাত দিয়ে চাপ দিয়ে পিছনে পা ওঠানো-নামানো করতে হবে। এতে হিপ মাসল টাইট থাকে,’’ পরামর্শ দিলেন সৌমেন দাস।
এ সবের বাইরে মধ্যবয়সে মহিলা ও পুরুষদের, বিশেষ করে মহিলাদের মেনোপজ়ের পরে বছরে একবার ভিটামিন ডি, ক্যালশিয়ামের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। কোনও রোগ ধরা পড়লে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া, ব্যায়াম করা ও ডায়েট মেনে চললে ভাল থাকা যায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)