Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

প্রতিরোধে অবহেলা, উত্তরবঙ্গে তাই দাপাচ্ছে এনসেফ্যালাইটিস

রোগটা ছড়াচ্ছে তিন বছর ধরে। অথচ, হেলদোল ছিল না রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের। শুরু হয়েছিল জলপাইগুড়িতে। তিন বছরে রোগ ছড়িয়েছে কোচবিহার, দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর এবং লাগোয়া রাজ্য অসমেও। উত্তরবঙ্গে সোমবার পর্যন্ত এই রোগে মারা গিয়েছেন ২১ জন। ৮৩ জনের রক্তে পাওয়া গিয়েছে রোগের জীবাণু। মশা-বাহিত রোগ জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ত্রাসের সৃষ্টি করেছে উত্তরবঙ্গ এবং পার্শ্ববর্তী অসমে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৪ ০২:৪৩
Share: Save:

রোগটা ছড়াচ্ছে তিন বছর ধরে। অথচ, হেলদোল ছিল না রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের। শুরু হয়েছিল জলপাইগুড়িতে। তিন বছরে রোগ ছড়িয়েছে কোচবিহার, দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর এবং লাগোয়া রাজ্য অসমেও। উত্তরবঙ্গে সোমবার পর্যন্ত এই রোগে মারা গিয়েছেন ২১ জন। ৮৩ জনের রক্তে পাওয়া গিয়েছে রোগের জীবাণু।

মশা-বাহিত রোগ জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ত্রাসের সৃষ্টি করেছে উত্তরবঙ্গ এবং পার্শ্ববর্তী অসমে। সবার ক্ষেত্রে জীবাণু চিহ্নিত করা না গেলেও, গত ১৪ দিনে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে যত রোগী ভর্তি হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর জানুয়ারি থেকে এখনও অবধি এই উপসর্গে আক্রান্ত ১০২জন রোগী মারা গিয়েছেন এই মেডিক্যাল কলেজে।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ২০১১ থেকেই উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ-সহ রোগী পাওয়া যাচ্ছিল। ’১১, ’১২-তে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে ২৭৮ জন ভর্তি হন। ১০৮ জন মারা যান। জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের পরীক্ষা হয়েছিল উত্তরবঙ্গের ৩৭৩ জন রোগীর। ৩৮ জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু মিলেছেজনের রক্তে। ২০১৩-তে ওই সব উপসর্গ নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি হন ৩৮৫ জন। তাঁদের মধ্যে ১১৫ জন মারা যান। তখন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি রোগী এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা ২৯৮ জনের রক্ত পরীক্ষা হয়েছিল। ৫৩ জনের শরীরে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু মেলে।

সংক্রামক রোগ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা বলছেন, উত্তরবঙ্গের আদিবাসী এলাকায় মাঝেমধ্যে এনসেফ্যালাইটিস রোগী দেখা যেত। কিন্তু এমন ব্যাপক হারে রোগ ছড়ায়নি আগে। মূলত মশাবাহিত এক ধরনের ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া (ফরেস্ট ম্যালেরিয়া)-র জন্যই ডুয়ার্সে যাওয়া পর্যটকদের সতর্ক করা হতো। ওই গবেষকদের মনে হয়েছে, ২০১১-তে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ধরা পড়ার পরে রাজ্য সতর্ক হলে এ বার রোগটা এমন ভাবে ছড়াত না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকায় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের মতো পতঙ্গবাহিত রোগের প্রাদুর্ভার বেশি হলেও এখানে স্বাস্থ্য দফতরের কোনও পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ নেই। ফলে, কোন ধরনের মশার প্রকোপ কোন এলাকায় বাড়ছে, তারা কী কী রোগ ছড়াচ্ছে তা বুঝে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ারও উপায় নেই। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীবলেন, “অভাব রয়েছে। তবে এখনই মন্ত্রবলে লোক জোগাড় করা অসম্ভব নয়।”

কী বলছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য? ৬৫জন মারা যাওয়ার পরেও সোমবার তিনি নিশ্চিত নন, রোগটা কী। গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ সফরে যাওয়া চন্দ্রিমা জানিয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গে ওই রোগ সংক্রমণ নিয়ে তিনি রিপোর্ট পাননি। সোমবার চন্দ্রিমা বলেন, “রোগটা জাপানি এনসেফ্যালাইটিস কি না, তা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত বলতে পারছি না। তবে তিন জনের একটি মেডিক্যাল দল ১৭ জুলাই উত্তরবঙ্গ গিয়েছিল বিষয়টি দেখতে। সোমবার ওঁরা ফিরেছেন। রিপোর্ট পাইনি।”

মন্ত্রী জানান, স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী উত্তরবঙ্গে গিয়েছেন। সোমবার তিনি বিশেষ দলকে নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে গিয়ে স্বাস্থ্য আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। কী থেকে এই রোগ হচ্ছে, খতিয়ে দেখেছেন। আজ, মঙ্গলবারও স্বাস্থ্য অধিকর্তার জলপাইগুড়ি, মালবাজার-সহ উত্তরবঙ্গের এনসেফ্যালাইটিস আক্রান্ত জায়গা ঘুরে দেখার কথা।

স্বাস্থ্য অধিকর্তা এ দিন শিলিগুড়িতে বলেন, “এ বছর উত্তরবঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের মৃত্যুর হার বেড়েছে। রোগ সংক্রমণ মহামারীর আকার নিতে পারে ধরে নিয়েই তা ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” স্বাস্থ্যকর্তার দাবি, বিভিন্ন ধরনের এনসেফ্যালাইটিস রয়েছে। সাধারণত, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে ২০ শতাংশ মৃত্যুর হার স্বাভাবিক। জাতীয় সমীক্ষা অনুসারে ‘এন্টারো ভাইরাস’-এর আক্রমণে যে এনসেফ্যালাইটিস রোগ হয় তাতে মৃত্যুর হার ৪০-৫০%। রাজ্যে নির্দিষ্ট ওই এনসেফ্যালাইটিস রোগের কোনও তথ্য নেই। বাকিদের অন্য কারণে এনসেফ্যালাইটিস হয়। এ বছর অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে যাঁরা মারা যান তাঁর মধ্যে এখন পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে মারা গিয়েছেন ২৫%। এই সময় রোগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে তা বাড়বে। তাই পরিস্থিতি দেখতে আসতে হয়েছে।”

আগাম ব্যবস্থা নয় কেন? স্বাস্থ্য অধিকর্তা জানান, ২০০৯ থেকেই এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ দেখে কেন্দ্রের কাছে বারবার রোগ নির্ণয় কেন্দ্র চালুর জন্য বলা হয়েছিল। বসতি এলাকায় শুয়োর পালন বন্ধের বিষয়টি স্বাস্থ্য দফতরের হাতে নেই। শুয়োর পালনের সঙ্গে অনেকের রুজিরুটিও জড়িয়ে। প্রত্যন্ত এলাকায়, চাষের জমিতে মশা নিয়ন্ত্রণে ‘স্প্রে’ করার রীতি কম। বাসিন্দাদের সচেতন করতে ব্যবস্থা হয়। গত বছর থেকে প্রতিষেধক দেওয়া চালু হয়। ১৫ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের ৮০% প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে, দাবি তাঁরা।

বিশ্বরঞ্জনবাবু বলেন, “এ বার সংক্রমণ ঘটছে বয়স্কদের ক্ষেত্রে। কিন্তু যে প্রতিষেধক দেওয়া হয় তা বয়স্কদের জন্য নয়। বয়স্কদের জন্য প্রতিষেধক চালু করেত অসমে পরীক্ষা চলছে। আমরাও সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

japanese encephalitis health department
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE