Advertisement
E-Paper

ঝর্না, হ্রদ, অরণ্যে ঘেরা মুগ্ধতার রঙে মোড়া সাতশো পাহাড়ের দেশ

রোদের তেজ আরও বেড়ে ওঠার আগেই বরং সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঢুঁ মারতে পারেন সারান্ডার জঙ্গলে। মেঘাতুবুরু, কিরিবুরুর রূপ মোটেই হতাশ করবে না।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৫ ০৯:২৬
শীতের মরসুমে ঝিকিরা জলপ্রপাতের রূপ। বর্ষায় তা হয়ে ওঠে আরও সুন্দর।

শীতের মরসুমে ঝিকিরা জলপ্রপাতের রূপ। বর্ষায় তা হয়ে ওঠে আরও সুন্দর। —নিজস্ব চিত্র।

চারদিকে জঙ্গল বেশ ঘন। তারই বুক চিরে পিচের রাস্তা। পথ যেখানে বাঁক নিয়ে উতরাইয়ে নেমেছে, ঠিক সেখান থেকেই চড়াইয়ে উঠেছে আরও একটি রাস্তা। মিনিট ২-৩ হাঁটলেই রেলিংঘেরা বাঁধানো চত্বর। তার ঠিক নীচে পাহাড়ের ঢাল নেমেছে অতল খাদে। নীচে ঘন বন। সামনে ঢেউখেলানো অনুচ্চ পাহাড় স্তরে স্তরে সাজানো। এই জন্যই কি একে বলে সাতশো পাহাড়ের দেশ?

ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড সীমানায় ‘সারান্ডা’ পরিচিত ‘সাতশো পাহাড়ের দেশ’ নামে। এখানে রয়েছে প্রকৃতির আদিমতা, লাল মাটির গন্ধ।

বর্ষায় মেঘ আর শীতে কুয়াশার বাড়াবাড়ি না থাকলে কিরিবুরুর ‘সানসেট পয়েন্ট’ থেকে গোধূলির এক অভূতপূর্ব রূপের সাক্ষী থাকা যায়। আকাশে লাল আবির ছড়িয়ে পাহাড়-অরণ্যের গহীনে ডুব দেয় সূর্য। তার পরেই ঝুপ করে আঁধার নামে। ঝুপসি অন্ধকারে আকাশ যেন জ্বলে ওঠে ঝিকিমিকি তারায়।

কাকভোরে কলকাতা থেকে রওনা দিলে, বিকেলে সাক্ষী থাকা যায় এমনই রূপের। সন্ধে উপভোগ করা যায় আদিবাসী হাটে, মহুয়া-গুলগুলার স্বাদে।

এখানে আছে এক ভাললাগার গল্প। যে গল্প শুরু হয় শাল, সেগুনে আচ্ছাদিত বড়বিল স্টেশন থেকেই। মেঘাতুবুরু, কিরিবুরু, কারো নদী, ঝিকিরার ঝর্না, বোলানি খনি, থলকোবাদের ঘন অরণ্য, ভালু পাহাড়, জটেশ্বর শিব— এই সব কিছু নিয়েই সারান্ডা।

কিরিবুরুর ‘সানসেট পয়েন্ট’ থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আজন্ম মনে রাখার মতো।

কিরিবুরুর ‘সানসেট পয়েন্ট’ থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আজন্ম মনে রাখার মতো। —নিজস্ব চিত্র।

বড়বিল শহর ছাড়িয়ে গেলেই শুরু জঙ্গল। তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা। পথের ধারে ছোট ছোট গ্রাম। লোকজন হাতেগোনা। গাড়িঘোড়াও তাই। গাড়িতে যেতে যেতেই দৃশ্যগোচর হয় স্তূপাকৃতি লৌহচূর্ণ। তা থেকেই মেলে লোহা।

সে সব পার করে আরও এগোলে ঝিকিরা। যেখানে গাড়ি দাঁড়ায় সেখান থেকে দৃশ্যগোচর হয় বয়ে যাওয়া ক্ষীণ জলস্রোত। শুরুতে মনে হতেই পারে, এই দেখতে শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে এত দূর ছুটে আসা!

ভুল ভাঙে জলস্রোতের উৎস সন্ধানে মিনিট দশেক এগোলেই। উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে ঝরে পড়ছে ঝিকিরা জলপ্রপাত। সূর্যরশ্মি জলে বিচ্ছুরিত হয়ে মেলে ধরেছে রামধনুর সাত রং।

চারপাশ ভীষণ রকম লাল। আকাশছোঁয়া বৃক্ষের পাতা ঢেকেছে মিহি লৌহকণায়। জলের মধ্যে লোহার চূর্ণ। শীতল জলের স্পর্শে আরাম বটে, তবে খালি পায়ে সেই স্রোতে নেমে ঘোরাঘুরি করলেই পা নিমেষে রক্তিম হয়ে ওঠে।

ঝিকিরা ছেড়ে গন্তব্য ঘাঘীরথী। পথ গিয়েছে অরণ্যের গহীনে। সে পথে যেতে হলে মেঘাতুবুরু থেকে বন দফতরের অনুমতি অত্যাবশ্যক। প্রত্যেকের পরিচয়পত্র দেখে কাগজে ছাপ্পা পড়লে তবেই পাওয়া যায় থলকোবাদের অরণ্যে যাওয়ার অনুমতি। সে পথে রয়েছে লোহার খনি। পাহাড়ের গা থেকে অনবরত লোহা খনন করেছে যন্ত্র। খানিক এগোলেই ঘন হয়ে ওঠে বন। তারই মধ্যে সশব্দে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় ঘাঘীরথী। সুবিশাল অরণ্যরাজির মধ্যে ধাপে ধাপে সিঁড়ি। টিকিট কাটলে ওঠার সুযোগ মেলে ‘নেচার ট্রেল’ বা ঝুলন্ত সেতুতে ওঠার। পা ফেললেই কেঁপে ওঠে সেতু। এখান থেকে বনানী ও জলপ্রপাতের দৃশ্য মনে রাখার মতোই। ঝিকিরার মতো ঘাঘীরথীর উচ্চতা ততটা না হলেও, জঙ্গলের পরিবেশ সেই সৌন্দর্যে বাড়তি মাত্রা যোগ করে। এখানেই অদূর ভবিষ্যতে বন দফতরের আধুনিক পর্যটক আবাস তৈরি হতে চলেছে।

লোহার খনি। ঘাঘীরথী যাওয়ার পথে দূর থেকে তা দেখা যায়।

লোহার খনি। ঘাঘীরথী যাওয়ার পথে দূর থেকে তা দেখা যায়। —নিজস্ব চিত্র।

শাল, সেগুনের পাতা ঝরা, ছায়া-রোদের কাটাকুটি খেলা, জঙ্গলের জানা, অজানা ফুল, পাখি দেখতে দেখতেই কোথা দিয়ে যেন সময় কেটে যায়। থলকোবাদের গহীনে বন্যপ্রাণ দেখার তেমন সুযোগ না মিললেও রয়েছে ভালু গুহা, নজরমিনার। এই জঙ্গল, পথঘাটের কোনও কোনও অংশ হাতিদের করিডর।

মেঘাতুবুরু, কিরিবুরের পথেই সন্ধান মিলবে আদিবাসীদের গ্রামীণ হাটের। টাটকা সব্জি, পোশাক, চুড়ি, সাজের জিনিস—এমন সব পসরা নিয়ে হাজির দোকানিরা। বিক্রি হচ্ছে গুলগুলা (আটা দিয়ে তৈরি একপ্রকার বড়া)। হাটের এক প্রান্তে হাঁড়িয়ার আসর। পেঁয়াজি, চপ, সেদ্ধ করা ছোলামটর বিক্রি হচ্ছে ‘টাকনা’ হিসাবে। আদিম হাটে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়াচও লেগেছে। এ সবের পাশাপাশি জায়গা করে নিচ্ছে চাউমিন, এগরোল।

ঠাকুরানি পাহাড়ের পায়ের নীচে জটেশ্বরের মন্দির। মন্দিরের পাশে ঝর্না। পাহাড়ের মাথা থেকে অনবরত জল পড়ে তৈরি হয়েছে ছোট্ট জলাধার। মন্দির শিবের থান। নিত্যপূজা হয়। গা বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠেছে সিঁড়ি। উপরে গুহামুখ বন্ধ পাথরে। তবে সেখানেও যে পুজো হয়, ত্রিশূল, পাথরে লেপা সিঁদুর তার প্রমাণ।

মুর্গ মহেশ্বর মন্দির চত্বরের প্রাকৃতিক ঝর্নায় স্নান করতে আসেন পুণ্যার্থীরা।

মুর্গ মহেশ্বর মন্দির চত্বরের প্রাকৃতিক ঝর্নায় স্নান করতে আসেন পুণ্যার্থীরা। —নিজস্ব চিত্র।

জটেশ্বরের অদূরেই সুবিশাল জলাশয়। তার বিস্তৃতিও নেহাত কম নয়। বড়বিল থেকে ১৪৭ কিলোমিটার দূরে বৈতরণী নদী। পাথরের বুকে আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলেছে জলধারা। স্বল্প পরিসরেই দেখা যায় বৈতরণীর রূপের বৈচিত্র। কোথাও স্রোতের প্রাবল্য, কোথাও আবার জল শান্ত। আর আছে মুর্গমহেশ্বর। এমন নামকরণের হেতু স্পষ্ট না হলেও, এর স্থানমাহাত্ম্য স্থানীয়দের কাছে যথেষ্ট।

মন্দির সংলগ্ন চত্বরে পাহাড়ের উপর থেকে কয়েক হাত অন্তর একই সঙ্গে ঝরে পড়েছে তিনটি জলধারা। স্থানীয়দের কাছে এই জলধারা খুবই পবিত্র।

কিরিবুরু, মেঘাতুবুরুর রূপে মন হারাতে চাইলে সপ্তাহান্তে চলে আসতে পারেন এই ঠিকানায়। শীত, বসন্তে আবহাওয়া মনোরম থাকে। তবে সবুজ প্রকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ মেঘ, বৃষ্টির ধারাপাত দেখতে চাইলে সারান্ডার জঙ্গল হতে পারে বর্ষার গন্তব্য।

কী ভাবে যাবেন?

ট্রেনে গেলে হাওড়া-বড়বিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ধরতে পারেন। হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ে সকাল ৬টা ২০ ও বড়বিল পৌঁছয় বেলা ১২টা ৫০-এ । ডাউন ট্রেন বড়বিল স্টেশন থেকে ছাড়ে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ও পৌঁছয় রাত ৮টা ৫৫-তে। জঙ্গলে শুধুমাত্র অনুমতিপ্রাপ্ত গাড়ি যায়। সড়কপথে হাওড়া থেকে বড়বিল যেতে পারেন।

Weekend Destination Travel Tips Saranda Forest
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy