কী করছে স্বাস্থ্য দফতর? সরকারি যে লাল ফিতের ফাঁস কাজের গতিকে সবচেয়ে বেশি আটকে রেখেছে, এ বার সেই ফাঁসই কিছুটা আলগা করতে উদ্যোগী হয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, অনন্তকাল কোনও টেন্ডার প্রক্রিয়া আটকে না রেখে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে টেন্ডার ডেকে কাজ শুরু করার নির্দেশ এসেছে সর্বোচ্চ স্তর থেকে।
স্বাস্থ্য দফতরের এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন, “ঠিকাদার সংস্থাগুলি নানা রকম চাপ তৈরি করত। নির্দিষ্ট সময় ধরে কাজ করা বেশির ভাগ সংস্থারই ধাতে নেই। এটা আমরা আর বরদাস্ত করছি না। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি জানান, ইতিমধ্যেই দু’টি সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তারা ভবিষ্যতে সরকারি কাজে করার সুযোগ হারাল।
শুধু টেন্ডার প্রক্রিয়ার সরলীকরণ নয়, কাজ শেষ করানোর জন্য প্রত্যেক কর্মীর দায়িত্বও বেঁধে দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। অর্থাৎ, কোন কাজের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হচ্ছে, সেটা নির্দিষ্ট করা থাকছে। এ ভাবে দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার সুবিধে হল, সে ক্ষেত্রে কোনও কর্মীই আর অন্যের উপরে কাজের দায় চাপাতে পারবেন না।
এর পাশাপাশি, মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অবিলম্বে আর এক প্রস্ত নিয়োগ শুরু হচ্ছে। এমসিআই-এর নির্দেশ মানতে শিক্ষক-চিকিৎসকদের কাজের জায়গার কিছু রদবদল হচ্ছে। এমনকী বেশ কয়েক বছর আগে অবসর নেওয়া চিকিৎসকদের ফিরিয়ে আনারও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে সব মেডিক্যাল কলেজে নির্মাণের বহু কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে এবং যা খুব দ্রুত শেষ হওয়া সম্ভব নয়, সেই সব জায়গায় ‘প্রিফ্যাব্রিকেটেড স্ট্রাকচার’ (কারখানায় বাড়ির বিভিন্ন অংশ তৈরি করে এনে জুড়ে দেওয়া) বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গ্রন্থাগারের বইয়ের অভাব মেটাতে দ্রুত বইয়ের দীর্ঘ তালিকা তৈরি করে বই কেনার ব্যবস্থা হচ্ছে। তড়িঘড়ি বরাত দিয়ে কেনা হচ্ছে আসবাবপত্রও।
এমসিআই-কে জমা দেওয়া মুচলেকায় রাজ্য বলেছিল, পরিকাঠামোগত যে সব ত্রুটির জন্য আসনে অনুমোদন পাওয়া আটকাচ্ছে, তা দ্রুত দূর করা হবে। এই ‘দ্রুততা’র মাপকাঠি সর্বাধিক ছ’মাস। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন রাজ্যকে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা উদ্যোগী হয়ে এমসিআই-কে অনুরোধ করার জন্যই এই দফায় ছাড়পত্র মিলেছে। ফলে এ বার যদি রাজ্য কথা না রাখে, তা হলে মুখ পুড়বে কেন্দ্রেরই। হর্ষ বর্ধনের কথায়, “এত দিন যা হয়েছে, তা নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। আর নিজেদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে রাজ্যকে ছ’মাসের সময়সীমা মানতেই হবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, অন্য রাজ্যগুলিকেও এটি অনুসরণ করতে হবে।”
এমসিআই-এর এথিক্যাল কমিটির সদস্য সুদীপ্ত রায়ও বলেন, “আসন ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে শুধু স্বাস্থ্যকর্তারা নন, খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিলেন। এর পরে রাজ্যের কলেজগুলি দ্রুত তাদের পরিকাঠামোগত সমস্যা দূর করে ফেলতে পারবে বলে আমরাও আশাবাদী।”
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সব পদক্ষেপের কোনওটিই তো অভিনব কিছু নয়। সে ক্ষেত্রে এত দিন তা করা হয়নি কেন? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তার একটাই কারণ, এর মধ্যে অধিকাংশই খুব বাস্তবসম্মত নয়।” উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “২৫০ পড়ুয়ার জন্য মেডিক্যাল কলেজে ৬৫০ আসনের লেকচার থিয়েটার চাই। এটা কি বাস্তবসম্মত? আমাদের কোনও উপায় নেই, তাই মেনে নিচ্ছি। ভেঙেচুরে জায়গা বের করা হচ্ছে। একই ভাবে বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজে গ্রন্থাগার বাড়াতে হচ্ছে বলে জানান সুশান্তবাবু। তাঁর দাবি, এই যুগে গ্রন্থাগারের পরিধি এ ভাবে চার দেওয়ালে আটকে থাকে না। কিন্তু সবটাই হচ্ছে জবরদস্তি করে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোট ৭৩টি মেডিক্যাল কলেজকে পরিকাঠামো বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে এমসিআই। এক কর্তার প্রশ্ন, “তা হলে কি ধরে নিতে হবে দেশের ওই ৭৩টি কলেজে পড়ানোর পরিকাঠামো নেই? সেখান থেকে যাঁরা পাশ করে বেরোচ্ছেন, তাঁরা কেউ ডাক্তার নন? শুধু ঝাঁ-চকচকে বাড়ি, দামি সরঞ্জাম দিয়ে যে ডাক্তার তৈরি হয় না, সেটা এমসিআই-এর বোঝার সময় এসেছে।”