ভোর চারটেয় মোবাইলের পর্দায় মায়ের নম্বর দেখে ঘাবড়ে গেল অনন্যা। দেশে তখন বিকেল হলেও, কলকাতা থেকে সাড়ে ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে এই বস্টনে এখনও সকাল হতে ঢের দেরি। হুড়মুড় করে ফোন ধরতেই ও-প্রান্তে মায়ের আর্ত চিৎকার— ‘কী হয়েছে তোর? এত কান্নাকাটি করছিস কেন? তুই তো কাঁদার মেয়ে নয়। কী হয়েছে বল আমাকে। তোকে কি ইউনিভার্সিটি থেকে বার করে দিয়েছে? ভিসা বাতিল হয়ে গিয়েছে? তোর মাথার ভিতরে কী চলছে বল তো। খারাপ কিছু করার কথা ভাবছিস, না কি? লুকোস না আমাদের কাছে।’
ঘুমটুম ততক্ষণে উড়ে গিয়েছে অনন্যার। কাল অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের সঙ্গেই চ্যাট করেছে। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কী হল মায়ের?
মা কিন্তু ও দিকে বলেই চলেছে— ‘তুই অতগুলো কান্নার ইমোজি কেন পাঠালি আমাকে। সঙ্গে আবার কয়েকটা খুলির ছবি। তখনই আমি মেসেজ করলাম পরপর। উত্তর দিলি না। কয়েক ঘণ্টা খুব টেনশনে কাটিয়েছি, জানিস। তার পরে আর না পেরে তোকে ফোনই করলাম।’
এ বার অনন্যার-ই কাঁদার পালা। ‘মা, ওগুলো কান্না বা মরে যাওয়ার ছবি নয়। ওগুলো হাসির ইমোজি। দু’চোখ থেকে জল মানে হাসতে হাসতে আমার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসছে, আর খুলির ছবিটার মানে হাসতে হাসতে মরে গিয়েছি, যেমন আমরা বলি, হাসতে হাসতে পেট ফেটে গিয়েছে, ঠিক তেমনই। আমার টেক-স্যাভি মা যে এমন ‘উল্টা বুঝলি’ হবে, তা তো আমি বুঝিনি।’
মা অবশ্য অত সহজে দমবার পাত্র নয়। ‘আমাকে যা তা বলে বোঝানোর চেষ্টা করবি না একদম। হাসতে হাসতে চোখ থেকে জল বেরোনোর ইমোজি কোনটা, আমি জানি। সেটা তো চোখের কোণে দু’ফোঁটা জল। আর তুই তো পাঠিয়েছিস দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। আর হাসি বোঝাতে কেউ খুলির ছবি দেয় নাকি? তোদের কাণ্ডকারখানা বুঝি না বাবা।’
বছর কয়েক আগেও যার কোনও অস্তিত্ব ছিল না, সেই ইমোজি বা ছোট্ট ছোট্ট ছবির সাহায্যে মনের ভাব বোঝানো এখন বার্তা বিনিময়ের সবচেয়ে সহজ উপায়। প্রথমে শুরু হয়েছিল গুটি কয়েক সহজ সরল ছবি দিয়ে। আনন্দ বোঝাতে কেউ টাইপ করতেন :), দুঃখ বোঝাতে :(। অমনি ফোন বা কম্পিউটারের পর্দায় হলুদরঙা হাসিহাসি বা দুঃখী মুখ ভেসে উঠত। কিন্তু গত কয়েক বছরে পাল্টে গিয়েছে ইমোজির ধরন-ধারণও। এক দিকে যেন একই ইমোজি বিভিন্ন রঙের করে বর্ণ সচেতনতা আনা হয়েছে, তেমনই আবার কোনও একটি ছবিই বিভিন্ন মানে নিয়ে হাজির হয়েছে বিভিন্ন মানুষের কাছে। এই যে ‘পাল্টে যাওয়া মানে’, তা অনেক প্রকট একটি প্রজন্ম থেকে আর একটি প্রজন্মে, ঠিক যেমন হয়েছে অনন্যা ও তার মায়ের ক্ষেত্রে।
আমেরিকার একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, একটি প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে কী ভাবে ইমোজির মানে পাল্টে যায়। ফলে এখন যাঁদের বয়স ৪৫ থেকে ৬০-এর মধ্যে, সেই জেনারেশন এক্স-এর ইমোজি ব্যবহারের চেয়ে যারা সবে টিনএজে পড়েছে, সেই জেনারেশন জ়ি-র ইমোজি ব্যবহারে অনেক তফাৎ। একটা খুব ‘সহজ’ ইমোজির কথাই ধরি না কেন। একটা বুড়ো আঙুলের ছবি, যার পোশাকি নাম ‘থাম্বস আপ’। ‘লাইক’ অর্থাৎ পছন্দ বোঝাতে এই ইমোজি হামেশাই ব্যবহার করি আমরা। মোটেই না, বলবে কিশোর-কিশোরীরা। টিনএজারদের কাছে এই ‘থাম্বস আপ’ চ্যাটের অন্য প্রান্তে থাকা ছেলে বা মেয়েটিকে চুপ করিয়ে দেওয়ার একটা ‘প্যাসিভ-অ্যাগ্রেসিভ’ পন্থা। ক্লাস নাইনের ছাত্রী মেঘার কথায়, “আমি যখন কারও সঙ্গে চ্যাট করছি, আমাকে কেউ যদি ‘থাম্বস আপ’ পাঠায়, ধরে নেব, সে আমার সঙ্গে আর কথা বলতে চাইছে না। শুধু তা-ই নয়, সেটা আমাকে সোজাসুজি বলার মতো ভদ্রতাটুকুও নেই তার।”
এ রকমই আর একটা গোলমেলে ইমোজি ‘হৃদয়’। কোনও ওয়টস্যাপ গ্রুপে বন্ধুর পাঠানো ছবি দেখে লাল রঙের হার্ট ইমোজি পাঠিয়ে ভাবলেন, দারুণ ভাবে ভাললাগা ও ভালবাসা প্রকাশ করেছেন? আপনার কলেজপডুয়া মেয়ে কিন্তু ‘মা, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না’ বলে কপাল চাপড়াতে শুরু করে দেবে। কারণ সে মনে করে, “খুব কাছের বন্ধু বা ভালবাসার মানুষকে ছাড়া এই ইমোজি পাঠানো যায় না।” কলেজপড়ুয়া ময়ূরিকা যেমন বলল, “আমরা অল্পস্বল্প হার্ট ইমোজি ব্যবহার করি ঠিকই, কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন রঙের। লাল বা গোলাপি হার্ট ইমোজির দিন আর নেই। যে দু’-এক জনকে আমি মনের সব কথা বলি, শুধু সেই বন্ধুদের জন্যই রেড হার্ট ইমোজি তোলা থাকে। যাকে-তাকে ওটা পাঠালে ভুল বার্তা যাবে।” বিভিন্ন রঙের হার্ট ইমোজির আবার আলাদা আলাদা অর্থ। ফলে আপনি লালের থেকে বেগুনি রংটা বেশি পছন্দ করেন বলে ফট করে যদি কাউকে পার্পল হার্ট পাঠিয়ে ফেলেন, তা হলে সমূহ বিপদ। কারণ, দুষ্টু-মিষ্টি ফ্লার্টিংয়ের জন্য নতুন প্রজন্ম ব্যবহার করে বেগুনি হৃদয়। তেমনই বন্ধুদের সাধারণ কথাবার্তায় হামেশাই ব্যবহার হয় হলুদ হৃদয়, ‘আমি কিন্তু তোমাকে নেহাতই ভাইয়ের মতো দেখি, অন্য কিছু ভেবে বোসো না’, এটা বোঝানোর জন্য সবুজ হৃদয় আর ‘তুমি আমার ওপর ভরসা করতে পারো’, বোঝানোর জন্য নীল হৃদয়।
‘ভুল’ ইমোজি ব্যবহার নিয়ে হালকা হাসি-ঠাট্টার মধ্যে কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে বড়সড় ভুল করে ফেলার বিপদও। যে বিপদের উপরের সারিতেই আছে যৌনগন্ধি ইমোজি। ফলে রান্নার রেসিপি পাঠাচ্ছেন ভেবে হুট করে কোনও ফল বা আনাজের ছবি পাঠিয়ে বসবেন না। বেগুন ও নাশপাতির মতো অনেক কিছুর মধ্যেই কিন্তু ‘দ্বিতীয়’ মানে লুকিয়ে রয়েছে।
এখানে মনে পড়ে যাবে একটি সাম্প্রতিক টিভি সিরিজ় ‘অ্যাডোলেসেন্স’-এর কথা। বছর চল্লিশের পুলিশটি কিশোর খুনি ও খুন হওয়া কিশোরীর চ্যাটের যা অর্থ বুঝেছিল, তা আমূল পাল্টে যায় তার নিজের ছেলের সঙ্গে কথা বলে। ছেলের কাছ থেকেই এই পুলিশ অফিসার জানতে পারেন, লাল কালিতে লেখা ‘১০০’ মানে ‘তুমি একশো শতাংশ ঠিক’ নয়। এই ইমোজির মানে, ‘১০০ শতাংশ মেয়েই তোমাকে পছন্দ করবে না, ফলে তোমার চিরকুমার থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই ১০০ শতাংশ।’ তেমনই, আপাত নিরীহ চেহারার একটি লাল-হলুদ ওষুধের ক্যাপসুলের ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে প্রবল নারীবিদ্বেষ, এবং ‘মেয়েটার খুব বাড় বেড়েছে, ওকে শিক্ষা দিতে হবে’ মার্কা বিপজ্জনক একটা পুং অহংবোধ।
এ বার থেকে ‘হৃদয় বিনিময়ের’ আগে তা হলে দু’বার ভেবে দেখবেন তো?
সীমন্তিনী গুপ্ত
ছবি: চিরঞ্জীব বণিক; মডেল: ঐশানী দে, নিশান্ত শীল; মেকআপ: দীপঙ্কর দাস; পোশাক: ইমেজ অ্যান্ড স্টাইল (গড়িয়াহাট); গয়না: অঞ্জলি জুয়েলার্স; লোকেশন ও হসপিটালিটি:
অঞ্জলি কুঞ্জ (বারুইপুর)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)