লন্ডনে ‘দার্জিলিং এক্সপ্রেস’ রেস্তরাঁর কর্ণধার কলকাতার মেয়ে আসমা খান। আসমার রেস্তরাঁয় গিয়ে তাঁর হাতে তৈরি কলকাতার বিরিয়ানি চেখে দেখেছেন স্বয়ং ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস আর রানি ক্যামেলিয়া। সম্প্রতি এক ঝটিকা সফরে কলকাতায় তিনি। কর্মজীবনের ওঠাপড়া থেকে ব্যক্তিগত জীবনের আক্ষেপ— আসমার সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় আনন্দবাজার ডট কম।
লন্ডনের হোটেল শিল্প জগতে এখন পরিচিত মুখ আসমা। আইনের ছাত্রী হয়েও রেস্তরাঁর ব্যবসা সামলাচ্ছেন দক্ষ হাতে। কেমন ছিল কলকাতা থেকে লন্ডনের সেই যাত্রাপথ? সালটা ১৯৯৬, মাত্র ২১ বছর বয়সে বিয়ে করে লন্ডনে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন আসমা। দুই ছেলে, সংসার, সবটা সামলিয়ে শুরু করেন আইন নিয়ে পড়াশোনা। তবে কখনওই উকিল হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি তিনি। বদলে আসমার চোখ জুড়ে ছিল রন্ধনশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন।
আসমার রান্নার প্রতি ভালবাসাটা জন্মায় বিয়ের পর। লন্ডনে গিয়ে আসমা বুঝতে পারেন মায়ের হাতে তৈরি খাবার আদতে কতটা দামি। সেই স্বাদের কোনও তুলনা নেই। রান্না করতে পারতেন না আসমা। একটা সময় তিনি মায়ের হাতের রেসিপিগুলি বানাতে শুরু করেন, এবং পাড়াপড়শিদের নিমন্ত্রণ করে ভারতীয় সেই পদগুলি খাওয়াতেও শুরু করেন। পাড়াপড়শি ও বন্ধুবান্ধবদের প্রশংসা পেয়ে আসমা বুঝেছিলেন, তাঁর মায়ের রেসিপিগুলি একেবারে ‘সুপারহিট’, তার হাতেও রয়েছে ‘আম্মু’র মতো স্বাদ। দেশে ফিরে তিনি মা-কাকিমাদের হেঁশেলে ঢুকে তাঁদের থেকে গোপন সব রেসিপি হাতেকলমে শেখেন। তার পর ২০১২ সালে বাড়িতেই তিনি ‘সাপার ক্লাব’ শুরু করেন। প্রথমে বন্ধুবান্ধব আর প্রতিবেশীদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও একটা সময় আসমার হাতের রান্না খেতে দূর দূর থেকে লোক আসতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে সেই ‘সাপার ক্লাব’-এর হাত ধরেই লন্ডনের বুকে ভারতীয় রেস্তরাঁ ‘দার্জিলিং এক্সপ্রেস’-এর যাত্রাপথ শুরু হয়। তবে কলকাতার মেয়ে হয়েও রেস্তরাঁর নামে কেন দার্জিলিং? মুচকি হেসে আসমা বলেন, ‘‘যে দিন আমি পিএইচডির ডিগ্রি হাতে পাই, সে দিনই আমার সাপার ক্লাবের নামের রেজিস্ট্রেশন করাই। কী নাম রাখব, ছেলের প্রশ্নের উত্তরে আচমকাই আমি বলে ফেলি ‘দার্জিলিং এক্সপ্রেস’। আসলে আমার মা জলপাইগুড়ির মেয়ে। ছোটবেলায় দার্জিলিং এক্সপ্রেসে চড়া মানেই আরও একটা গরমের ছুটির আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ যেন হাতছানি দিত। আইনের পড়াশোনা শেষ করে খাবারের দুনিয়ায় প্রথম পা রাখার সময় আমার মনে যেন ঠিক সেই আনন্দটাই জেগে উঠেছিল। সেই কারণে রেস্তরাঁর নামেও কোনও বদল করিনি।’’
‘দার্জিলিং এক্সপ্রেস’-এ ব্রিটেনের রাজা-রানির হঠাৎ আগমন, কী রকম অনুভূতি হয়েছিল আসমার? রন্ধনশিল্পী বলেন, ‘‘আমার রেস্তরাঁর হেঁশেলে ব্রিটেনের রাজা-রানি, গোটা বিষয়টি যেন আজও আমার কাছে স্বপ্নের মতো। সে দিন ভোর ৭টা থেকেই আমার হেঁশেলে রাজা-রানির নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যস্ততা ছিল তুঙ্গে। তার বেশ কিছুটা সময় পর রাজা চার্লস আর রানি ক্যামেলিয়ার আগমন ঘটে। দু’জনেই ভারতীয় খাবার চেখে দেখার বিষয় বেশ উৎসাহী ছিলেন। আমি তাঁদের জন্য নিজের হাতে কলকাতা স্টাইল চিকেন বিরিয়ানি বানিয়েছিলাম। রাজা চার্লসের বিরিয়ানিটা দারুণ পছন্দ হয়েছিল। তাঁরা খুব বেশি সময় রেস্তরাঁয় ছিলেন না। তাই বাকি খাবারগুলি আমাকে তাঁরা তাঁদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি তাঁদের জন্য বিরিয়ানির পাশাপাশি মোমো, ট্যাংরা স্টাইল প্রন, ভাপা দই পাঠিয়ে দিই। রাজা আমার কাছে মজা করে জানতে চেয়েছিলেন যে শাহি টুকরাটা আমি প্যাক করেছি কি না। শাহি টুকরার স্বাদ বেশ মনে ধরেছিল দু’জনের।’’
আসমার রেস্তরাঁয় এত ধরনের ভারতীয় খানাপিনার সম্ভার মেলে। তবে তাঁর পছন্দের খাবার কী? কোন খাবার রোজ খেতে পারেন তিনি? আসমা বলেন, ‘‘আমার রেস্তরাঁয় কর্মীদের জন্য যা খাবার তৈরি হয়, আমিও রোজ সেটাই খাই। তবে রেস্তরাঁয় কর্মরত কর্মীদের অধিকাংশই নেপালি। তাঁরা নিজেদের জন্য যে খাবার বানান, তাতে অনেক বেশি ঝাল থাকে, আমি খেতে পারি না। তাই ডাল, ভাত আর শসা— এটাই আমার রোজের খাবার। ভাত ছাড়া আমার চলে না।’’
এখন চারদিকে ফিউশন খাবার নিয়ে এত হইচই। আসমার কি সে দিকে ঝোঁক আছে? নিজের রেস্তরাঁয় কি ফিউশন খাবার রাখেন তিনি? খানিক ক্ষণ ভেবে আসমার জবাব, ‘‘আমি ফিউশন খাবারের বড় ভক্ত নই। এখন তো চার দিকে মাচা নিয়ে উন্মাদনা তুঙ্গে, সে দিয়ে কেক, কুকিজ়, আইসক্রিম, প্যানকেক সবই তৈরি হচ্ছে। আমার কাছে মাচা খাওয়া ঘাস খাওয়ার সমান।’’
আসমার দুই ছেলে আরিজ় আর ফারিজ়। বিদেশে দুই ছেলেকে সামলিয়ে রেস্তরাঁ চালানো কতটা কঠিন ছিল তাঁর কাছে? আসমা বলেন, ‘‘আমি মনে করি আমি মা হিসাবে ব্যর্থ। রেস্তরাঁ খোলার পর আমি দুই ছেলেকে একদমই সময় দিতে পারিনি। স্কুলের মিটিংয়ে তাদের পাশে থাকতে পারিনি। শনিবারের সন্ধ্যাগুলি ওরা আমাকে ছাড়াই কাটিয়েছে। এই আক্ষেপগুলি আমার সারাটা জীবন থেকে যাবে। আমার ব়ড় ছেলে এখন ব্যবসায় আমাকে সাহায্য করছে। আমি মনে করি, এখন ও বুঝতে পারবে একা হাতে ব্যবসা সামলানো ঠিক কতটা কঠিন। আশা করি আমার সন্তানেরা এখন আমাকে ক্ষমা করে দেবে।’’
লন্ডনের হোটেল শিল্প জগতে এখন পরিচিত মুখ আসমা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।
মহিলাকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত আসমার রেস্তরাঁ ‘দার্জিলিং এক্সপ্রেস’। পুরুষ রন্ধনশিল্পীদের উপর কি ভরসা নেই আসমার? আসমা বলেন, ‘‘আমার মতো কালো, মোটা, সাধরণ মেয়েকে পরিবারের লোকজন খুব একটা পছন্দ করতেন না। মা-বাবা নয়, পরিবারের বাকি লোকজনের কথা বলছি। দিদি হওয়ার পর আমার জন্ম হওয়ায় সবাই খুবই হতাশ হয়েছিল। পরে ভাইয়ের জন্মের পর তাদের সেই আক্ষেপ কিছুটা হলেও কমেছিল। আমার দিদি বেশ সুন্দরী। তার সঙ্গে তুলনা করে ঠাকুরমা আমাকে বলতেন, তোকে কেউ বিয়ে করবে না। সুন্দরী নয় বলে আমার কোনও ছবিও তোলা হত না। বড় হয়ে আমি লক্ষ করেছি, আমার মায়ের সঙ্গে আমার একটাই ছবি ছিল যেখানে আমি মায়ের পেটে ছিলাম। মহিলা হওয়ার যন্ত্রণা ছোটবেলা থেকেই আমাকে তাড়া করত। মহিলারাও পারে ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে, এটা আমাকে প্রমাণ করতেই হত। রেস্তরাঁ খোলার পর তাই মেয়েদের সঙ্গে নিয়েই এগোব বলে স্থির করেছিলাম। রেস্তরাঁয় যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কিন্তু কেউই প্রশিক্ষিত রন্ধনশিল্পী নন। আমি যেমন আম্মুকে দেখে রান্না করতে শিখেছি, তাঁরাও পরিবারের লোকজনের কাছ থেকেই রান্না শিখেছেন। এখনও কিন্তু খুব কম রেস্তরাঁতেই মহিলা হেড শেফ রয়েছেন। আমার রেস্তরাঁয় আমি চিরাচরিত প্রথা ভাঙার চেষ্টা করেছি।’’
রেস্তরাঁ চালানোর পাশাপাশি এখন আসমা লেখালেখিও করছেন। অভিনেতা অনিল কপূর থেকে ক্রিকেটার যশপ্রীত বুমরা, নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই লন্ডনে গিয়ে আসমার হাতের বিরিয়ানি খেয়েছেন। নিয়মিত তাঁর রেস্তরাঁয় ভিড় জমাচ্ছেন তারকারা। আসমার হাতে তৈরি খাবারের ভক্ত অভিনেত্রী আলিয়া ভট্টও।
আগামী দিনে আরও বেশ কিছু রেস্তরাঁ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে আসমার। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যবসার জগতে রাজত্ব করার জন্য ছেলে হওয়ার প্রয়োজন নেই, মহিলারাও পারে একা হাতে ব্যবসা সামলাতে— আমি চাই এটা সকলকে বোঝাতে। তবে মহিলাদেরও নিজেদের নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, পিছিয়ে পড়লে চলবে না।’’